You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.10 | সিলেটের সেই ভয়াবহ দিনগুলি | সাপ্তাহিক বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

সিলেটের সেই ভয়াবহ দিনগুলি
সিরাজ উদ্দিন আহমদ

২৬ শে মার্চ। ভোর চারটা। সহসা গোলাগুলির শব্দ শুনে চমকে উঠলাম আমি। ধরমর করে উঠে বসলাম বিছানায়। গাজী সাহেব (সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য) শুয়ে ছিলেন আমারই পাশে। তিনিও হকচকিয়ে গেলেন। বুঝতে পারলাম না, কেন এ গোলাগুলি? কারা করছে? কার নির্দেশে?
আতঙ্কিত চোখেমুখে বাচ্চা কাচ্চাদের নিয়ে আমার ঘরে ছুটে এলেন আপা। কান্না জুড়ে দিল সবাই। কান্নার পরিণতি বুঝিয়ে শান্ত হতে বললাম আপাকে।
আবছা আলো আঁধার। গাজী সাহেব এবং আমি বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। দেখা গেল না কিছুই। শুধু গোলাগুলির শব্দটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে— খাজাঞ্চিবাড়ির ই, পি, আর, হেড কোয়ার্টারের দিকে শব্দ হচ্ছে। [এই বাড়িটির মালিক নির্মল কুমার চৌধুরীকে ১৯৬৫ সালের ভারত পাক যুদ্ধের পর জোর পূর্বক বিতাড়িত করে পাকিস্তান সরকার দখল করে নেয় এবং বাড়িটিকে স্থানীয় ই, পি, আর, হেড কোয়াটার রূপে নির্বাচিত করে।] আমরা ভাবলাম হয়ত পাক সেনাদের সঙ্গে ই, পি, আর, বাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়েছে।
ঘরে ফিরে এলাম। সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। আপাকে চায়ের কথা বলে ভাবতে লাগলাম হাজারো কথা। মনে পড়ল সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজনের কথা। বিশেষ ভাবে মনে পড়ল সেই বারো তেরোজন দেশভক্ত তরুণের কথা— গাজী সাহেব গত রাতে ছাত্রলীগনেতা আখতার আহমদের নেতৃত্বে
যাঁদেরকে বেরিকেড রচনার জন্য পাঠিয়েছেন।
চা দিয়েই তাঁর নিজের ঘরে চলে গেলেন আপা। তাঁর মানসিক অবস্থা তখন খুবই খারাপ। দেশের অবস্থা ভয়াবহ। সিলেটের অবস্থাও তাই। চারদিকে গোলাগুলির শব্দ। স্বামী বাড়ী নেই। চট্টগ্রাম থেকে কবে নাগাদ ফিরতে পারবেন, কে জানে।
গাজী সাহেব এবং আমি চিন্তান্বিত ভাবে চায়ের পেয়ালায় থেকে থেকে চুমুক দিচ্ছি। জ্বালিয়ে চলছি একের পর এক সিগারেট। জানিনা কী হবে, কী ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। এমন সময় কড়া নড়ে উঠল দরজার। বুকের ভেতরটা টিপ্ টিপ্ করতে লাগল। অন্ধকার না যেতে কে কড়া নাড়ছে এই সাত সকালে। মিলিটারী নয়তো? ভয়ে পাংশুবর্ণ হয়ে গেল আমাদের মুখমণ্ডল। আপা সভয়ে বললেন— খবরদার! দরজা খুল না তোমরা। আমরা শ্বাস বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইলাম।
আবার কড়া নাড়ার শব্দ হলো। এবার অপেক্ষাকৃত জোরে। চেয়ারটা টেনে নিলাম এক পাশে। তার উপর বসালাম একটা টুল। উঠলাম এগুলির উপর। ঘরের ভেন্টিলেটারের মধ্য দিয়ে বাইরে তাকালাম একবার। এবার দরজায় যাকে দেখলাম তাকে দেখে ভয়ের পরিবর্তে যেন ভরসাই পেলাম। আর কেউই নয়-আমাদের মমিন, মানে সিলেট আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
দরজা খুলে দিলাম। ভিতরে এলো মমিন। তারপর আবার বন্ধ করে দিলাম দরজা। জিজ্ঞেস করলাম গোলাগুলি আর কার্ফিউর মধ্যে কোত্থেকে এলি?
গোলাগুলি, কিসের গুলি? ও তো কারা যেন পাখি মারছে।
এত দুঃখেও না হেসে পারলাম না আমরা। বুঝলাম দেশের বুকে যে, এত সব ঘটে যাচ্ছে, ও তার কিছুই জানে না। জিজ্ঞাস করলাম, গত রাতে কোথায় ছিলি?
কেন, টাউন বোর্ডিংয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। পার্টির কাজে অনেক দিন ঘুমুতে পারি নি কি না, তাই। কার্ফিউর মধ্যে সেই লালদিঘি থেকে এলে কী করে ?
স্বাভাবিক ভাবে সহজ উত্তর দিল মমিন-কেন, বন্দর পয়েন্টটা ক্রশ করে বারুদখানার গলি দিয়ে সোজা চলে এলাম।
তা, কী মনে করে?
যদি তোমার কাছে জরুরী কোন খবর থাকে।
ইঙ্গিতে চেয়ারে বসতে বললাম ওকে। আপাকে ওর জন্য এক কাপ চা দিতে বলে বাইরে বেরিয়ে গেলাম আমি।
সদর দরজাটা খুলে সামনের রাস্তা ধরে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে চললাম। উদ্দেশ্য রাস্তাঘাটের অবস্থা পরখ করা। আমি এগিয়ে চলছি। একটি গোয়ালা দুধের হাঁড়ি হাতে করে উল্টো দিক থেকে আসছে এদিকে। সহসা সামরিক ভ্যানের আওয়াজ পাওয়া গেল। রাস্তা থেকে সরে যেতে বললাম গোয়ালাকে। আমি গিয়ে নামলাম একটা শুকনো ড্রেনের মধ্যে। ভ্যান থেকে গোয়ালাকে লক্ষ্য করে হাসতে হাসতে গুলী ছুড়ল সামরিক বাহিনীর লোকেরা। দুধে আর রক্তে ভেসে গেল পিচঢালা পথটা।
ঘটনাস্থলে আরও কয়েকটি যুবক এসে জড়ো হলো। আমি ভাবছিলাম আহত লোকটাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার কথা, মুজাহিদ প্রেসের পেছন দিকের গলি পথটা ধরে ওকে নিয়ে এগোলাম খানিকটা। পাড়ার ছেলেরা আমায় আর এগুতে নিষেধ করল। তারা এও বলল যে, হাসপাতালের উল্টো দিকে উইমেনস কলেজের ছাদে রাইফেল মেসিনগান বাগিয়ে পাকসেনারা বসে আছে। সুতরাং নিরস্ত হলাম আমি। ফিরে চললাম বাড়ির দিকে। এদিকে আহত গোয়ালাটিকে একজন নিরস্ত্র বাঙালী ই পি আর নিয়ে গেল হাসপাতালে।
গাজী সাহেব এবং মমিন এমনিতরো একটা আকস্মিক দুর্ঘটনায় অনেকটা যেন বিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। গাজী সাহেবকে বলে মমিনকে সঙ্গে হাসপাতালের দিকে। তাঁতিপাড়ার গলি দিয়ে সিলেটের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী শ্রীমতি আরতি ধরের বাসার গিয়ে উপস্থিত হলাম।
কড়া নাড়তেই আরতি এসে দরজা খুলে দিল। ঘরে প্রবেশ করতে করতে দেখলাম ওদের বাড়ীতে তখনও উড়ছে একটা কালো পতাকা- অসহযোগ আন্দোলনে নিহত শহীদদের স্মৃতি বহন করে উড়ে চলছে-পাশে রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত জাতীয় প্রতীক।
ওর সঙ্গে বসার ঘরে এগিয়ে যেতে যেতে দেখলাম ওর নিটোল সুন্দর মুখখানিতে যেন একটা অকাল মেঘের ছায়া পড়েছে। লম্বা চুলগুলি একটু বশস্থ। চোখ মুখ যেন একটা অব্যক্ত প্রতিবাদে জ্বলে উঠতে চাইছে।
ওখান থেকে চা খেয়ে কাষ্টমস অফিসরের একজন পিয়নের সহায়তায় অফিসের সুমুখ দিয়ে জিন্দাবাজার বড় রাস্তাটা পার হয়ে হান্নান চৌধুরীর বাড়ীতে এসে উপস্থিত হলাম। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম যে, সদর মহকুমা হাকিম বাড়িতেই আছেন। এরপর আমরা তার বাড়ির পিছন দিকের একটা পথ দিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে হাজির হলাম। মহকুমার হাকিম আমাদেরকে দেখে পেছনের বারান্দায় ডেকে নিলেন। আমি তাঁকে দোকান থেকে সীজকরা অস্ত্রশস্ত্রগুলো জনসাধারণের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। ডি, সি, মিঃ সামাদের সঙ্গে কথা বলে তিনি তা করবেন বলে আমায় কথা দিলেন।
এরপর আবার পথে নামলাম আমরা। সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে চললাম হাসপাতালের দিকে। হাসপাতালের নিকটেই নার্স কোয়াটার। ঝটাপট সেটির পাঁচিল টপকে পড়লাম গিয়ে হাসপাতালের কম্পাউন্ডে। সোজা চলে গেলাম ডাঃ শাসুদ্দিন আহম্মদের রুমে।
ডাক্তার সাহেবের রুমে ঢুকোই দেখি ডাঃ সফিক এবং ডাক্তার শাহ্জাহান ও আরও কয়েকজন বসে কী আলোচনা করছেন। আমাদের দেখামাত্রই ডাঃ শামসুদ্দিনের মুখখানি যুগপৎ আনন্দ ও বিস্ময়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন গাজী সাহেবের কথা। তিনি ভালো আছেন বলে জানলাম। তিনি বসতে বললেন আমাদেরকে। বসলাম না কিন্তু আমরা। জানতে চাইলাম সামরিক বাহিনীর হাতে হতাহতের পরিমাণ।
তিনি জানালেন যে, তখন পর্যন্ত হাসপাতালে ১৭ জন নিহত এবং ৩৫ জন আহত ব্যক্তি আনা হয়েছে। আমরা দেখতে চাইলাম হতাহতদের। এ উদ্দেশ্যে ডাঃ সফিককে আমাদের সঙ্গে নিলাম। ডাঃ সফিক ঘুরে ঘুরে দেখালেন সব কিছু।
মৃতদেহগুলো দেখলাম- হাসপাতালের একটি কক্ষে সাত বছরের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত যেন আহত হয়ে কাল নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।
এরপর আহতদের ওয়ার্ডে গিয়ে পা দিতেই বিছানা থেকে উঠে বসল একটি সুন্দর ফুটফুটে কিশোর। মুখটা চেনা চেনা। আমরা এগিয়ে গেলাম তার দিকে জানতে পেলাম তার নাম মণিরুল ইসলাম স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার্থী। জামে মসজিদ থেকে ফজরের নামজ সেরে ফেরার পথে খানসেনারা ওকে গুলি করে। ভাগ্যিস পায়ে লেগেছে বাঁ পায়ে, তেমন কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।
হাসপাতালে আর যে সব আহত ব্যক্তি ছিলেন, তাদেরকে বড় একটা পরিচিত মনে হল না।
এক অশীতিপর বৃদ্ধকে যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবী। মাথায় তখনো রয়েছে তাঁর টুপিটা। মুখে পাকা দাড়ি। একজন ধার্মিক লোক বলেই মনে হলো।
জিজ্ঞেস করে জানতে পেলাম। বাড়ী তাঁর গ্রামে। শহরে এসেছিলেন হযরত শাহজালালের মাজার জিয়ারত করার জন্য। ঐদিন সকালে ফিরে যাচ্ছিলেন তাঁর গ্রামে। ষ্টেশনের পথে স্থানীয কিংব্রিজের উপর তাঁকে পাক সেনারা গুলি করে। সঙ্গে ছিল তাঁর এক ভাই এবং অপর একজন প্রতিবেশী। ঘটনাস্থলেই তারা মারা গেছে।
বুড়ো ভদ্রলোকের গুলি লেগেছে কোমরে। আজ হোক, কাল হোক, তিনি হয়ত একদিন নিজের গ্রামে- নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু সঙ্গী দুজনকে পথে হারিয়ে কোন মুখে তিনি বাড়ী ফিরবেন? এই বলে হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন বৃদ্ধ-গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল উত্তপ্ত অশ্রুধারা।
আমাদের বুক ভেঙ্গে কান্না আসতে চাইল। ডঃ সফিক মনের অবস্থা বুঝে বললেন, অন্য একটি রুমে আরও চারজন আহত ব্যক্তি রয়েছেন— তাদেরকে একবার দেখে আসবেন, চলুন।
বাইরের দিকে পা দিয়েছি। অমনি, “সিরাজভাই?” বলে কে যেন পিছু ডাকল। ফিরে দেখি চাঁদনী ঘাটের মনুমিয়ার চায়ের দোকানের সেই শ্যামলরঙের মিষ্টি ছেলেটি।
ফিরে এলাম ওর বিছানার কাছে। কানের কাছে গুলি লেগেছে। গালে তখনো রয়েছে রক্তের চিহ্ন।
এবার আমরা এসে উপস্থিত হলাম সেই পূর্ব বর্ণিত আহত চারজনের কক্ষে। তাদেরকে তখন ‘স্যালাইন’ দেয়া হচ্ছে। ডঃ শফিক ইশরায় নিষেধ করলেন কোন কথা বলতে। এমন সময় একটি বেড থেকে হাত তুললেন একজন। কাছে এগিয়ে গেলাম আমরা। দেখলাম, সিলেট এইডেড হাই স্কুলের শিক্ষক জনাব আব্দুল মন্নান শুয়ে আছেন আহত অবস্থায়। ডান দিকের বুকের কাছে গুলি লগেছে।
আমাদেরকে কাছে পেয়ে তিনি উত্তেজনায় উঠে বসতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। অবশেষে অর্ধশায়িত অবস্থায় আবেগভরা কণ্ঠে বললেন-সিরাজভাই, আমি হয়ত বাঁচব না। এই হয়ত শেষ শয্যা। কিন্তু আমাদের দাবী যেন আদায় হয়- আমাদের সংগ্রাম যেন গোলাগুলি আর বুলেট বেয়নেট স্তব্ধ করে দিতে না পারে।
কখনো পারবে না মন্নান ভাই, কখনো পারবে না। কে কবে বল প্রয়োগ করে একটা জাতিকে চিরকাল গোলাম করে রাখতে পেরেছে বলুন?
সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১ : ৩ ॥ ১০ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন