You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৫ই আগস্ট, রবিবার, ১৯৭৩, ২০শে শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

সেই শান্তির দূত সেই শ্বেত কপোত

সেই শান্তির দূত সেই শ্বেত কপোত উদার আহ্বান জানিয়েছেন গোটা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা তথা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমৃদ্ধির দ্বার উন্মোচনের। কমনওয়েলথ সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, বিস্তৃত বঞ্চনার সাগরে সব কিছু পাওয়া যে ক্ষুদ্র দ্বীপের সৃষ্টি হয়ে চলেছে, উন্নত দেশগুলোর উচিত তা উপলব্ধি করা। তাদের আজ অনুন্নত দেশগুলোর সমস্যা এবং উদ্বেগের ভার নিতে হবে। যে সম্পদ ব্যয়িত হয় অস্ত্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলে উত্তেজনা বজায় রাখা তথা প্রভাব বলয় সৃষ্টির কাজে সে সম্পদকে মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করবার জন্যে সম্পদশালী দেশগুলোর কাছে তিনি আকুল আহ্বান জানান।
মানবতার স্বার্থে, মানুষ হিসাবে স্বমর্যাদায় বেঁচে থাকবার প্রয়োজনে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যে বীর বিক্রমী মুক্তিযোদ্ধারা ঔপনিবেশিকতা, বর্ণবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছে বঙ্গবন্ধু তাদের প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রদান করেন। এ সমর্থন, একাত্মতা ঘোষণা করা হয় এমন একজন ব্যক্তির তরফ থেকে যিনি তাঁর নিজের জীবনে স্বদেশকে ঔপনিবেশিকতার শোষণে জর্জরিত হতে দেখেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। স্তরানুক্রমিকভাবে সংগ্রামের সোপান অতিক্রম করে অতঃপর একটা সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে চরম বিজয় লক্ষ্য অর্জনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি জানেন পরাধীনতার কি জ্বালা, মুক্তি পাগল জনসাধারণের অনুভূতি কত তীব্র, আর স্বাধীনতাত্তোর জাতির সমৃদ্ধি অর্জনের পথে কি বাঁধা।
বিশ্বের পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কমনওয়েলেথর উপর অর্পিত দায়িত্ব সম্বন্ধে তিনি সচেতন হবার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এই সম্মেলনের আলোচনায় এই চেতনার উন্মেষ ঘটুক যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর সমস্যা সম্পর্কে উন্নত দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হওয়া একান্ত প্রয়োজন। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় তথা পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশের ভূমিকা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সবিস্তার আলোচনা করেন। তাঁর ভাষণে তিনি আমাদের উপমহাদেশে বিরাজমান অস্বাভাবিক অবস্থার কথা উল্লেখ করে তার নিরসনে বাংলাদেশ সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন। বাংলাদেশ-ভারত যুক্ত ঘোষণা এবং তারই বিপরীতে পাকিস্তানের একগুঁয়েমি মনোভাব আজ আর কারো কাছে অজানা নেই। তিনি আশা প্রকাশ করেন, সংশ্লিষ্ট মহল অবিলম্বে উপমহাদেশের বাস্তবতা উপলব্ধি করবেন এবং সেখানে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যে আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবেন।
ঔপনিবেশিকতা এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশের মহানায়ক যখন কথা বলেন তখন তার ভিতর ফুঠে উঠে শান্তি আর জনগণের সমৃদ্ধির জন্যে ঐকান্তিক কামনার স্বর। দেশে বিদেশে তাঁর সেই শান্তির অন্বেষা, জনগণের সমৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু দূর দিগন্তে বাজ পাখীর শ্যেন দৃষ্টি কি বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের উপর থেকে সরে গেছে? বিপদের, অশান্তির কালোমেঘ কি অপসারিত? নব যুদ্ধবাজ, সাম্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদী আর বর্ণবাদী শক্তিগুলো পিছু হটলেও অস্তিত্ব তাদের শেষ হয়ে যায়নি। শান্তির স্বপক্ষে সংগ্রামের অভিযান তাই অব্যাহত। প্রতিক্রিয়ার দুর্গ ধসে পড়ছে, শান্তির দিন আগত ঐ। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ধ্বনিত হয়েছে সেই শান্তিরই বারতা।

যুক্তরাজ্য কনফোরেন্স লাইনের অনভিপ্রেত সিদ্ধান্ত

আমদানী-রপ্তানী ব্যবসায়ীদের জন্যে দুঃসংবাদ। বৃটেনের কনফারেন্স লাইন আগে থেকে কিছু না জানিয়ে না শুনিয়ে হঠাৎ করেই মালামাল এবং পরিবহনকারী জাহাজের ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের এ উপমহাদেশীয় তিনটি দেশের জন্যেই যুক্তরাজ্যের কনফারেন্স লাইন সম্প্রতি এই ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সিদ্ধান্তটি যেমন আকস্মিক তেমনি একতরফা। কনফারেন্স লাইনের এই অনভিপ্রেত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় দারুণ বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম হয়েছে। ঢাকার শিপিং ও ব্যবসায়ী মহল বৃটেনের কনফারেন্স লাইনের এই মাল ও জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির ব্যাপারটিকে মুনাফা লোটার এক বাজে অজুহাত বলে আখ্যায়িত করেছেন। যুক্তরাজ্য কনফারেন্স লাইন এ ধরনের ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে এবারই প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা ভাবার কোন কারণ নেই। প্রতি বছর কিংবা এক বছর অন্তর অন্তর কনফারেন্স লাইন জাহাজের ভাড়া বাড়িয়ে থাকে। এই ভাড়া বাড়ানোর প্রবণতা যুক্তরাজ্য কনফারেন্স লাইনের একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে বললেও অত্যুক্তি করা হয় না।
যুক্তরাজ্য কনফারেন্স লাইনের এই সিদ্ধান্তের ফলে উপমহাদেশীয় দেশত্রয়ের মধ্যে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এবং বাড়তি ভাড়া বাবদ বাংলাদেশকে বৈদেশিক মুদ্রায় প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে। জানা গেছে, ইউরোপীয় বিভিন্ন দেশের বন্দর থেকে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে যে সব মাল জাহাজ পরিবহনযোগে প্রেরিত হবে, তার জন্যে শতকরা সাড়ে সাত ভাগ ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এবং উপমহাদেশের এই তিনটি দেশ থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বন্দরে যে সব মালামাল পাঠানো হবে, সেজন্যে শতকরা সাড়ে বারো ভাগ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ব্যবস্থা আগামী অক্টোবর মাস থেকে কার্যকরী করা হবে। ভাড়া বাড়ানোর অজুহাত হিসেবে কনফারেন্স লাইন থেকে জানানো হয়েছে যে, পৌনঃপুনিক ব্যয় বাড়ার ফলেই মাল এবং জাহাজ ভাড়া যুগপৎ দুটোই বাড়ানো হয়েছে। অবাক হলেও সত্যি যে, ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে উপমহাদেশের দেশত্রয়ে মালবাহী জাহাজের ভাড়ার হার প্রায় তিনশ’ ভাগ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়েছে। এবং এই বাড়তি ভাড়া আগামী সপ্তাহ থেকেই চালু হবে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে বর্তমানে পুনর্গঠনের কাজ পুরোদমে অব্যাহত রয়েছে। দেশ পুনর্গঠনের এই লগ্নে বাংলাদেশকে নানাবিধ সমস্যার যাঁতাকলে পিষ্টিত হতে হচ্ছে। একটির পর একটি সমস্যা আমাদের অক্টোপাসের মতো আক্রান্ত করছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য কনফারেন্স লাইন মাল ও জাহাজ ভাড়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কার্যকরী করা হলে আমাদের ব্যবসায়ী মহলে তাই এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বক্তব্য ধুমায়িত হয়ে উঠেছে। বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের কাছে এখন সোনার হরিণ সমতুল্য। কিন্তু কনফারেন্স লাইনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বছরে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অপচয়ের পাল্লায় পড়ে আমাদের এখন বিভ্রান্ত না হয়ে উপায় নেই। কনফারেন্স লাইন প্রায়শই এ ধরনের কাজকারবার করে থাকে। এতে যৌক্তিকতা ও বিবেচনাবোধ কতটুকু বিদ্যমান তা নির্ণয় না করেও আমরা বলতে পারি যে, যুক্তরাজ্য কনফারেন্স লাইন শুধুমাত্র আমাদের উপমহাদেশের তিনটি দেশের প্রতি এই আকস্মিক ভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারটি ঘটিয়ে খুব একটি সহৃদয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি। ভাড়া বাড়ানোটা যেন বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্যে ‘মরার উপর খাঁড়ার খা’য়ে পরিণত হয়েছে।

আবাসিক সমস্যা সমাধান ত্বরান্বিত করতে হবে

সাবেক আমলে তদানীন্তন সরকার সামাজিক, অর্থনৈতিক নানা সমস্যা সমাধানের প্রেক্ষিতে সময় সময় বিভিন্ন প্রকল্পের কথা ঘোষণা করতেন। বলাবাহুল্য সে সব ঘোষিত প্রকল্পের অধিকাংশই পত্র-পত্রিকায় ঘোষণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো এবং জনগণ ‘অমুক প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আমাদের অমুক সমস্যার সমাধান ঘটবে’ এই আশায় দিন গুণতো। কিন্তু না, সেই প্রকল্পও কোন দিন বাস্তবায়িত হতো না, সমস্যারও সমাধান ঘটতো না। বরং বিরাজিত সমস্যা আরো বেড়ে যেতো।
বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের আবাসিক সমস্যা আজ নতুন নয়—দীর্ঘ দিনের। ক্রমবর্ধমান জনবসতির প্রেক্ষিতে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহরে আবাসিক সমস্যা যে কি প্রকট আকার ধারণ করেছে তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ভুক্তভোগী মাত্রেই অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে এই মহাসংকটে হাবুডুবু খাচ্ছেন। বিশেষ করে বাসা না পাওয়ার দরুণ মধ্যবিত্ত চাকুরেজীবীদের যে আজ কি নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে সে কথা বলাইবাহুল্য।
বেশ কিছুদিন আগে সরকার একবার ঘোষণা করেছিলেন আবাসিক সমস্যা সমাধানের জন্যে সরকার ৩৫ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। এই ঘোষণার পর সেই প্রকল্প সম্পর্কে আর তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়নি, তা বাস্তবায়িতও হয়নি।
গতকালকের স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুসারে দীর্ঘদিন পরে আবার জানা গেলো, দু’হাজার সরকারী কর্মচারীকে বাসগৃহ দেওয়ার ব্যবস্থাকল্পে ছ’কোটি টাকার একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রণীত পরিকল্পনা অনুসারে এক হাজার সরকারী তিন তলা বাড়ীকে চার তলায় সম্প্রসারণ করা হবে। প্রকাশিত খবরে আরো জানা যায়, ইতিমধ্যে ঢাকা শহরে সরকারী বাসগৃহ বরাদ্দের জন্যে ২৫ হাজার কর্মচারীর আবেদনপত্র জমা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যে নাকি শহরের ৭টি আবাসিক এলাকা থেকে ৯শ’ ৭৯টি বাসগৃহ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর সম্প্রসারণ কাজ শুরু হবে। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এই পরিকল্পনা অনুমোদন পেলে অচিরেই এটা বাস্তবায়নের কাজ হাতে নেওয়া হবে।
আবাসিক সমস্যা সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু এবং অর্থ মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই ভালোভাবে অবহিত আছেন বলে আমরা মনে করি। সুতরাং আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে আশা করছি, আবাসিক সমস্যা সমাধানকল্পে প্রয়োজনের তুলনায় গৃহীত প্রকল্পটি পরিপূর্ণ না হলেও তা যথাশীঘ্র অনুমোদন পেয়ে বাস্তবায়িত হলে আবাসিক সমস্যার অন্ততঃ কিছুটা নিরসন হবে এবং সাবেক আমলের সরকারের ন্যায় ঘোষিত প্রকল্প মতো তা কেবল কাগজের পাতাতেই সীমাবদ্ধ না থেকে তা বাস্তবে রূপ নেবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!