You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.19 | বিদেশী সাংবাদিকের জিজ্ঞাসা: পশ্চিম পাকিস্তানী জল্লাদ বাংলাদেশের কত লাখ লোক খুন করেছে? | জয়বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

বিদেশী সাংবাদিকের জিজ্ঞাসা
পশ্চিম পাকিস্তানী জল্লাদ বাংলাদেশের কত লাখ লোক খুন করেছে?

গত ২৫শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র নাগরিককে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করার জন্য ইয়াহিয়া-টিক্কা এবং তাদের জল্লাদ বাহিনী যে ঘৃণ্য পথ গ্রহণ করে তার কুকীর্তি বিশ্ববাসীর চোখে ঢাকা দেওয়ার ঢাকায় জন্য অবস্থানরত ৩৫ জন বিদেশী সাংবাদিককে ২৬শে মার্চ জোর করে ধরে তাদের ফিল্ম ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে বিমানে করে পশ্চিম পাকিস্তানে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে সংবাদপত্র বেতার টেলিভিশানের উপর কঠোর সামরিক সেন্সারশীপ আরোপ করে পাক হানাদার বাহিনী সারা বাংলাদেশে এক লোমহর্ষক গণহত্যা, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণ অভিযান চালিয়ে যায়। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ বাংলাদেশের সত্যকার ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। তবু লৌহ যবনিকার অন্তরালে এবং পাকফৌজের কঠোর দৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে যে সব সাংবাদিক প্রাণভয়েকে তুচ্ছ করে সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে যে টুকরো টুকরো খবর সংগ্রহ করলেন তা দিয়ে বিশ্ববাসী জোড়া করলেন বাংলাদেশের একটি বিভৎস চিত্র।
আর তখন সমগ্র বিশ্ব আজকের বিক্ষুব্ধ ও বিধ্বস্থ বাংলার চিত্র দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। বিশ্বজনমত মূল তথ্য জানবার জন্য চাপ শুরু করে দিলেন। গুটিকতক স্থান ঠিকঠাক করে ইয়াহিয়া খান বাধ্য হয়ে ৬ জন বিদেশী সাংবাদিক, যারা এর আগে কোনেদিন বাংলাদেশে আসেনি, তাদের আমন্ত্রণ করলেন। এসব নতুন সাংবাদিককে সফরে আনায় ইয়াহিয়া খানের একিট লাভ হলো এরা রেসকোর্স ময়দানের ঢাকার জনসংখ্যা দেখেনি, দেখেনি সদরঘাটের বাস, নবাবপুরের রাস্তায় ভীড় আর দেখেনি ঢাকার পথে সাইকেল রিক্সা, বেবীট্যাক্সি মোটর গাড়ীর প্রচন্ড ভীড়।
সে যাহোক সামরিক গাড়িতে সামরিক নিয়ন্ত্রণে এ সব সাংবাদিককে ৬ দিনের জন্য বাংলাদেশে সফরের অনুমতি দেওয়া হল। এই সফরের অনুমতি দেওয়া হলো। এই সফরের আগে ইয়াহিয়া সাহেব বায়না ধরলেন যে সব সাংবাদিক ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করে ছিলেন তাদের এই সফরে আসতে দেয়া হবে না। কারণ তাদেরকে এই নিয়ন্ত্রিত সফরে আসতে দিলে আদিম পৈশচিকতার মূল তথ্যকে ফাঁকি দেয়া যাবে না। তবু এই নিয়ান্ত্রিত সফরে ব্যবস্থা করেও বাংলাদেশে নবাগত সাংবাদিকের চোখকে যথার্থভাবে ফাঁকি দিতে পারলেন না বেঈমান ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্র।
এসোসিয়েট প্রেসের প্রতিনিধি সাংবাদিক মর্টসেন রোজেনরুম বলেন যে, সামরিক কর্তৃপক্ষ এই সফরের নিয়ন্ত্রিত পথে বিভিন্ন স্থানে ভাড়া করা লোক দাঁড় করে রাখে। পথঘাট মেরামত করে মূল তথ্যকে ঢাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার মধ্যে থেকেও বাংলাদেশের এক ভয়ঙ্কর বীভৎস চিত্র ফুটে উঠেছে। তাঁর সফরের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে একটা মাত্র দৃষ্টান্তের মধ্যে তিনি সারা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর পৈশাচিক নরহত্যার একটি খন্ডাংশ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন, গলিত লাশের মাংসে শকুনিগৃহিনিদের পেট এত পূর্ণ হয়েছে যে পদ্মার তীর ধরে উঠে যেতেও তাদের কষ্ট হচ্ছে। তার মতে, মাত্র ৫ সপ্তাহে হানাদার বাহিনীর হত্যালীলার বাংলাদেশের ৫ লক্ষ লোকের লাশ শকুনীরা মেজবাণীর জন্য পেয়ে গেছে।
রোজেনরুম লিখেছেন, বাংলাদেশে পাক-ফৌজ কত লাখ লোককে হত্যা করেছে তা কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু নির্ভরযোগ্য ও নিরপেক্ষ হিসাবের ভিত্তিতে এ সংখ্যা কমপক্ষে দশ লক্ষ হবে বলে তাঁর ধারণা।
কিন্তু আমাদের কাছে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্যসূত্রে যে সমস্ত হিসাব এসেছে তার থেকে বলা যায় যে এ যাবৎ অন্তত ৩০ থেকে ৫০ লক্ষ লোককে তারা হত্যা করেছে।
জয়বাংলা ॥ ১:2॥ ১৯ মে ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন