You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজশাহীতে জঙ্গীশাহীর বর্বরতা
অধ্যাপক আব্দুল হাফিজ

সেদিনের কথা ভুলবো না। পুলিশ লাইনে পুলিশের সঙ্গে পাক সেনাদের যুদ্ধ হচ্ছে। আঠারোটি ঘণ্টার যুদ্ধ। পুলিশের হাতে রাইফেল, পাক সেনারা ব্যবহার করছে গোলা ও মর্টার। একটা অসম যুদ্ধে যা হতে পারে, এ যুদ্ধেও হয়েছিল ঠিক তাই তারিখটা মনে আছে ২৭ই মার্চ, ১৯৭১ সাল, স্থান রাজশাহী শহর। পুলিশ বাহিনী প্রকৃত দেশপ্রেমিকের মত লড়াই করে মৃত্যুকে বরণ করেছে, বাকি আহত ও অন্যান্যরা হটে গেলেন রণক্ষেত্র থেকে। পুলিশের সম্বন্ধে আমার ধারণা সেদিন পালটে গিয়েছিল। পুলিশের নিন্দা না করে জল গ্রহণ করা বাঙালীর স্বভাব ছিল না, দুনিয়ার তাবৎ অপরাধ পুলিশের ঘাড়ে চাপাতে পারলে তবেই আমাদের অপরাধবোধগুলি শান্তি পেত। সেই পুলিশ ভাইরা পাক সেনাদের বিরুদ্ধে বাঙলা ও বাঙালীর প্রথম মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছে। শহীদ হয়েছে, পুলিশের সমস্ত দোষত্রুটি, অপরাধকে মহা পূণ্য রক্তে ধুয়ে পবিত্র করে দিয়ে গেছে। বারংবার সেই পুলিশ ভাইদের প্রতি আমার মাথা নত হয়েছে। সেলাম আমার শহীদ ভাইরা, সেলাম জানাই তোমাদের, সেলাম আমার পুলিশ ভাইরা, তোমরা যারা মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করেছো, সেলাম তোমাদের। বাঙলাদেশের পুলিশবাহিনী অমর হও।
আজ মনে পড়ছে, বডডো বেশী মনে পড়ছে মৌলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর কথা। পরনে লুঙি, গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি, পায়ে চপ্পল, মুখে শুভ্র দাড়ি এবং মাথায় টুপী। সভায় এসে দাঁড়াতেন, চারিদিকটা দেখে নিতেন এবং তারপর বলা শুরু করতেন বলতেন, এই যে শান্তিও শৃঙ্খলা রক্ষার নামে শত শত পুলিশ আমার মিটিংয়ে পাঠানো হয়, সেই সব অল্প মাইনের সেপাই ভাইদের কথা কি আপনারা জানেন? তারপর কিছুক্ষণ থামতেন। পরে উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলতেন,তোমরা যখন স্ত্রীপুত্র কন্যা নিয়ে সুখে মত্ত থাকো, এমন কি একদিনের ট্যুরে গেলেও বিবিকে সঙ্গে নিয়ে যাও, তোমরা কি একবারও ভাবো এসব সেপাইদের কথা। স্ত্রীর সোহাগ, পুত্র-কন্যার মুখের বুলি, মা-বাবার স্নেহ থেকে তারা বঞ্চিত, জীবন কাটে তাঁদের ব্যারাকে; শীতে-গ্রীষ্মে বর্ষায় এই সেপাইরা দেশের শান্তিরক্ষা করছে-কিন্তু তার বিবি কোথায়, বাচ্চারা কোথায়, বৃদ্ধ মা-বাবা কোথায়, সেপাই ঘুষ খেলে তা হয় আলোচনার বিষয়, তোমরা যে দিনে-দুপুরে ডাকাতি করছো, তার হিসেব তোমরা দিয়েছো?
না ঐ সামান্য মাইনের সেপাইদের খোঁজ কেউ করে না। তাদের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে তথাকথিত ‘ভদ্রলোকেরা’ বিবেকের ময়লা পরিষ্কার করেন। নিজেদের পাহাড় প্রমাণ পাপ গোপন করার কী নির্মম প্রয়াস আমলাদের। কিন্তু যেদিন মুহূর্ত এলো প্রকৃত সংগ্রামের আমার চিরবঞ্চিত-অবহেলিত চির সেপাই ভাইর পরিচয় দিলেন বীর্যের, সাহসের এবং মহান দেশপ্রেমের। আমার শহীদ সেপাই ভাইরা, তোমাদের লড়াইতে আমি ছিলাম না, কিন্তু ছিলাম তোমাদের পাশে পাশে। সামনের সারির হে বীর বাঙালী শহীদ সেপাই বন্ধুগণ, ইতিহাস তোমাদের ভুলবে না। বাঙলাদেশের মান-ইজ্জতকে তোমরাই তুলে ধরেছো, মা-বোনের লজ্জাকে তোমরাই রক্ষা করেছো। জিন্দাবাদ বীর সেপাই শহীদ ভাই, জিন্দাবাদ।
তিন মাস থেকে লড়াই চলছে এবং চলবে; সামান্য মাইনের সেপাইরা শহীদ হয়েছেন। সমস্ত পুলিশ লাইনগুলিতে যুদ্ধ হয়েছে, বিধ্বস্ত হয়ে গেছে সবকিছু। ব্যারাকের সোই ব্যারাকে ফেরেনি। আমার সেপাই ভাইদের সন্তানেরা কোথায়, তাদের বাপ-মা কোথায়? না, কেউ তাদের খোঁজ জানেন না। কেউ সন্ধান করেননি তাদের তারাও কি জানেন, তাদের প্রিয় সন্তান জীবন দিচ্ছেন প্রতি দিনে, প্রতি মুহূর্তে। তাদের প্রিয় স্বামীরা কোথায় আছেন, জানেন না তারা। আর সেই সব শিশুরা, যারা বাবার ফেরার জন্য বসে ভাবছে। হয়তো ভাবছে, বাবা এলে ভারি মজা হবে। বাবা কত সুন্দর সুন্দর খেলনা আনবে। বাবা কত গল্প বলবে, সেই সব শিশুরা দিন গুণবে, তবু বাবা ফিরবেন না। লজ্জানত বধু শ্বশুর শ্বাশুড়ীর সামনে কথা বলে না। শুধু কাঁখে খলসী করে জল আনতে গিয়ে দিগন্তরে নিরুদ্দেশ পথের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, কত লোকতো আসে, কিন্তু তার সেতো আসে না। এমনি কতদিন তাকাবে। একদিন আর তাকাবে না, শুধু কাঁদবে। সমস্ত অন্তর জুড়ে হাহাকার পরিণত হবে এক-সমুদ্র কান্নায়। মা খেতে বসবেন, ভাত মুখে নিতে গিয়ে মনে পড়বে ছেলের কথা। ভাত আর নামবে না গলা দিয়ে। গড়িয়ে গড়িয়ে গাল বেয়ে পড়বে মায়ের চোখের জল। ভাত খাওয়া আর হয়ে উঠবে না। কে কবে আপন রক্তের ফুলকে মৃত জেনে খেতে পারে। শিশুর কান্না, বঁধুর কান্না আর মায়ের কান্না সব মিলিয়ে হবে এক কান্নাময় মহা সমুদ্র।
“মা মাগো, মা”– ছেলেটি বার বার চেঁচিয়ে ডাকছে। পাশে দাঁড়িয়ে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক। জ্ঞান ফেরেনি তখনও। ঘাড়ে আর গলায় গুলির আঘাত। কেউ বলছে বাঁচবে, কেউ বলছে বাঁচবে না। পরের দিন আবার গেলাম। দেখি তাকাচ্ছে। মুখটা বিশীর্ণ, ফ্যাকাশে। মাথার চুলগুলি কামিয়ে দিয়েছে। বললাম একটু ভালবোধ করছ কি? চোখের ইশরায় কী যেন বলতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই ওর অশ্রুর আভাস দেখা দিয়েছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। হাত দিয়ে আমার একটা হাত চেপে ধরলো। না-বলা সমস্ত কথা আমার জানা হয়ে গেল। বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে ফরিদ। পুলিশে নাম লিখিয়েছিল, মাকে দুটো অন্ন যোগাতে পারবে বলে। গোঁফের রেখা, টোপা টোপা গাল, ছেলে মানুষী দুটি ভীরু চোখ। বলছিলাম, তুমি কিছু খাবে ভাই? ফলমূল বা অন্যকিছু? বলছিলো, না। বলেছিল এমাসে তো কোনও মাইনে পেলাম না। জানেন, মায়ের কাছে একটি পয়সাও হয়তো নেই। মার্চের সাতাশ তারিখে রাজশাহীর পুলিশ লাইনে ফরিদ লড়াই করেছিল। ফরিদ আমাকে বলেছিলো, শেখ সাহেব আটাশ তারিখে মাইনে দেবেন বলেছিলেন। মাইনে কি আমরা পাবো? ফরিদ মাইনে পায়নি, মাকে টাকা পাঠাতে পারেনি। হাসপাতালে ওর একটু করে উন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু তেসরা এপ্রিল শুরু হল পাক-সেনার বিমান আক্রমণ। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ড-বয়, মেথর- সবাই পালাতে শুরু করলো। পরে শুনেছিলাম, আহত সেপাই ও অন্যান্য রুগীদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এমন নির্মমকাহিনী ইতিহাসে নেই। মানুষ হয়ে মানুষকে কি করে কেউ মারতে পারে? হ্যাঁ পারে, ইয়াহিয়া এবং তাঁর জল্লাদ সেনারা সব পারে। পারিনি শুধু আমরা, পারেনি বাঙলাদেশের শান্তনিরীহ মানুষরা তাদের টাকায় এবং সম্পদে গড়ে ওঠা পাক-সেনাবাহিনী নির্মম ভাবে তাদেরই হত্যা করেছে। ভ্রাতৃত্ববোধ এবং ইসলাম ধর্মের নামে বাঙলাকে শ্মশান করে, বাঙালীকে ভিখিরী করে বাঙলার সংস্কৃতির টুটি চেপে ধরে, বাঙালী জাতিকে ধ্বংস করতে উদ্যত তারা।
রাজশাহী শহর থেকে আশ্রয় নিয়েছি গাঁয়ে। এক বাড়িতে গিয়ে দেখি একজন আহত সেপাই সেখানে শুয়ে আছেন বিছানায়। কথায় কথায় সেই সেপাই ভাইটি বলেছিলেন, “কি জানেন, যদি আমাদের হাতে গোলা থাকত, তাহলে ওরা কিছুতেই আমাদের সঙ্গে পেরে উঠতো না। আমাদের হাতে শুধু রাইফেল, তাও পুরনো ব্রিটিশ আমলের। ওদের হাতে সব আধুনিক গোলাগুলি।” বলতে বলতে তার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ভুলে গেলেন তার -ব্যথা বেদনা। বললেন, লড়াইতে আমরা জিতব স্যার, দেখবেন, আমরা জিতব। আমি জানতাম ওরা জিতেছে। নৈতিক দিক থেকেই শুধু নয়,ওরা জিতেছে প্রকৃত যুদ্ধেও। একদিকে ভাড়াটে-পাক সেনা, অন্যদিকে দেশপ্রেমিক সেপাই ভাইরা। কে জিতেছে? ইতিহাসের রায় সেপাই ভাইদের দিকে। এ রায়কে কেউ রুখতে পারবে না। জয় বাংলা।
জয় বাংলা ॥ ১ : ৮ ॥ ২ জুলাই ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!