You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.30 | বর্বরতম গণহত্যায় তিন লক্ষ নিহত! মুক্তিফৌজের হাতে দুটি সৈন্য ছাউনী : ঢাকায় প্রবল চাপ-বেতারকেন্দ্র অবরুদ্ধ | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

বর্বরতম গণহত্যায় তিন লক্ষ নিহত!
তুরস্ক- ইরানের সঙ্গে সঙ্গে শাহীর গোপন পরামর্শ
মুক্তিফৌজের হাতে দুটি সৈন্য ছাউনী : ঢাকায় প্রবল চাপ-বেতারকেন্দ্র অবরুদ্ধ

বাঙলা দেশে পাক-সৈন্যদের তিনটি ছাউনীর দুটি মুক্তি বাহিনীর দখলে-কুমিল্লা ও যশোর। বাকী একটি -ঢাকা। সোমবার সকাল থেকে এই শেষ ছাউনীটি দখলের জন্য মুক্তি বাহিনী তীব্র চাপ দিচ্ছে। ঢাকা বেতার কেন্দ্র সমেত সমস্ত ঢাকা শহর মুক্তি বাহিনীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। বাঙলাদেশে জঙ্গীশাহীর দখলে একমাত্র বেতার কেন্দ্র ঢাকা সোমবার সকাল থেকে নীরব। স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র দাবি করেছে ঢাকা বেতার মুক্তিবাহিনীর দখলে-তবে এখনও এ সংবাদের সমর্থন নেই।
মরিয়া জঙ্গীশাহী সোমবার ছত্রী বাহিনীকে যুদ্ধে নামিয়েছে। পদাতিক, বিমান, নৌ বাহিনী আগেই নেমেছিল। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট যেখানে থেকেই আবেদন আসছে জঙ্গীশাহীর কর্তারা হেলিকপ্টারে সেখানেই সৈন্য পাঠিয়েছেন।
বাঙলাদেশের স্বাধীনতার রক্তাক্ত সংগ্রামের চতুর্থ দিনে প্রায় তিন লক্ষ নিহত হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ সংবাদ ইউ এন আই এর।
এ পি জানিয়েছে পর্যুদস্ত পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ তার অন্যতম মিত্র সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ জোট সেন্টোর সদস্য তুরস্ক এবং ইরানের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ে যোগাযোগ স্থাপন করছে।
ইউ,এন, আই জানাচ্ছে স্বাধীন বাংলা দেশের সমর্থকদের সঙ্গে পশ্চিম- পাকিস্তানী সৈন্যদলের তীব্র লড়াই হচ্ছে। ঢাকা, রংপুর, পাবর্তীপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, যশোর এবং সৈয়দপুর সর্বত্রইক্তবাহিনীরমু িপ্রচণ্ড চাপে বে-সামাল জঙ্গীশাহী হেলিকপ্টার যোগে ক্রমাগত সৈন্য পাঠাচ্ছে।
পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদলের পক্ষ থেকে পাঠানো বার্তা মাঝখানে হস্তক্ষেপ করে জানা গেছে প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে পশ্চিমী সৈন্যরা দেওয়ালে পিঠ দিয়ে লড়ছে। মুক্তিযোদ্ধারা সৈন্যদের রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা বিপর্যস্থ করে দিয়ে অবস্থাকে পশ্চিমের সৈন্যদের পক্ষে চরমে তুলেছে।
শেষ সংবাদ এল দিনাজপুর কার্যত মুক্ত। রংপুরের কাছে লালমনিরহাট বিমান বন্দরটি ধ্বংস করা হয়েছে।
সোমবার দুপুরে স্বাধীন বাংলা বেতার জানিয়েছে সন্দীপ দ্বীপে হেলিকপ্টার যোগে শত্রু সৈন্য নামানো হয়েছে খুলনার কোন কোন অঞ্চলে নৌকায় সৈন্য পাঠানোর কথা ঘোষণা করা হয়।
সীমান্ত শহর কৃষ্ণনগরের এক সংবাদে জানা যায় ঢাকার কাছে গাজিপুরের অস্ত্র কারখানা মুক্তিবাহিনী দখল করেছে। এই সংঘর্ষে অস্ত্র কারখানার রেসিডেন্ট ডিরেক্টর বিগ্রেডিয়ার এম, করিমুল্লাহ এবং আরও অনেক পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার নিহত হন।
কলকাতায় পাওয়া অন্য এক সংবাদ হলো রাজসাহী বেতার কেন্দ্রটি পুনর্দখলের জন্য রবিবার রাত্রেই স্বাধীন বাংলার সমর্থকরা প্রচণ্ড চাপ দেন। এখানে মুক্তি বাহিনীকে পরিচালনা করছেন ই,পি, আর মেজর আবদুল মজিদ।
এখানে সোমবার সকালেও লড়াই চলছে। স্বাধীন বাঙলার সমর্থকরা শহরে প্রবেশের প্রত্যেকটি রাস্তা দখল করেছে এমনকি নদীপথও ওদের দখলে। এখানে হতাহতের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
খুলনার কাছে সৈন্যবাহিনীর একটি ইউনিটকে স্বাধীন বাঙলা দেশের সমর্থকরা মধুমতী নদীর দিকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে। খুলনায় সুন্দরবন অঞ্চলের সমস্ত নৌকা হয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে-না হয় সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ঐ সংবাদ সূত্র জানিয়েছে, সৈন্যদের অনেক ইউনিটের সরবরাহ কেন্দ্র ছিল জায়গাটি ঐ। জলপাইগুড়ির এক খবরে জানা যায়, কোচবিহার জেলা সংলগ্ন বুড়িমারি সৈন্যশিবির আবিদ আলির নেতৃত্বে দখল করা হয়।
মালদার খবর হলো, হুকুম না মানার জন্য রংপুর এবং রাজশাহীর ডেপুটি কমিশনারদের পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রেপ্তার করেছে।

ঢাকা বেতার কেন্দ্র দখলের সংগ্রাম
ঢাকা বেতার কেন্দ্রটি পাকিস্তানী দখলদার সৈন্যদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য স্বাধীন বাঙলার মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সৈন্যদলের তীব্র সংঘর্ষ হচ্ছে।
স্বাধীন বাঙলা বেতার কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে, বেতার কেন্দ্রটি বর্তমানে মুক্তিবাহিনীর দ্বারা সকাল থেকে অবরুদ্ধ হয়ে আছে। যন্ত্রসঙ্গীত হচ্ছিল। তার পর থেকে ঐ বেতার কেন্দ্রের কোন অনুষ্ঠান শোনা যায়নি।
স্বাধীন বাঙলা বেতার দুপুরের সংবাদে জানিয়েছিল, সামরিক কর্তৃপক্ষ করাচী থেকে এখন প্রচার করছে।

তিন লক্ষ নিহত
শিলং থেকে শ্রুত স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ উল্লেখ করে ইউ, এন, আই জানিয়েছে বিগত ৪৮ ঘন্টার মধ্যে পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনী সম্মিলিতভাবে বাংলা দেশের প্রায় ৩০০,০০০ নরনারীকে হত্যা করেছে। এই বেপরোয়া গণহত্যা বন্ধের জন্য বেতার কেন্দ্রটি স্বাধীন রাষ্ট্রগুলিকে অবিলম্বে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেছে। বেতার ঘোষক বলেন, “অবিচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে। মানবিক অধিকার এবং মুক্তির জন্য আমাদের সংগ্রাম।”
বর্বর হানাদারদের হাত থেকে মানবতা এবং গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ঐ বেতার কেন্দ্র থেকে ভারত ও সিংহলের কাছে সাহায্যের আবেদন জানানো হয়। পাকিস্তানী বিমান বাহিনী যেন সিংহল ও ভারতের আকাশ পথে যেতে না পারে সেজন্য বিশেষ আবেদন করা হয়।

গুজবে কান দেবেন না
প্রায় আধ ঘন্টা ধরে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যে সব সংবাদ, আবেদন ও নির্দেশ প্রচার করা হয় তার মধ্যে গুজবে কান না দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়।
স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে আজও বারে বারে ঘোষণা করা হয় বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের গ্রেফতারের সংবাদ শত্রুদের প্রচার। তিনি সুস্থ ও সবল আছেন এবং তাঁর গোপন সদর দপ্তর থেকে বিপ্লব পরিচালনা করছেন। দ্বিতীয় আর একটি প্রচার হলো ঢাকার কল কারখানা অফিস আদালত সবই বন্ধ আছে। খোলার সংবাদ মিথ্যা।
যুব ও ছাত্রদের বিশেষ করে মুক্তি আন্দোলনের সামিল হওয়ার আবেদন করা হয়েছে। বেতার থেকে ঘোষণা করা হয় যে কোন অস্ত্র নিয়ে হানাদারদের আক্রমণ কর, পানিতে মারো। প্রয়োজন হলে খাবারে বিষ মিশিয়ে দাও।

জিয়ার বাণী
মুক্তি বাহিনীর প্রধান মেজর জিয়া খান এক বেতার ঘোষণায় বলেন, “পাঞ্জাবী হানাদাররা নির্মমভাবে মাতৃভূমিকে ভালোবাসার অপরাধে নিরস্ত্র জনতাকে খুন করছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামী মেজাজ ভালই তাঁরা ঢাকা, কুমিল্লা, যশোহর এবং চট্টগ্রামে প্রচণ্ড সাহসিকতার সংগে সংগ্রাম করছেন।
বিলম্বে প্রাপ্ত এক সংবাদে জানা যায় ই পি আর-এর হাতে চট্টগ্রামের লালবাগ অঞ্চলে শনিবার ২ জন পাঠান আর্মি-অফিসার এবং ৪ জন অবাঙ্গালী অফিসার ধরা পড়েছেন। এঁরা আসামের মিজো পার্বত্যজেলার সীমান্তপ্রহরায় নিযুক্ত ছিলেন।

চার দিনের বেশি রসদ নেই
সোমবার শিলং সীমান্তে পাকিস্তানী সৈন্যদের এক বেতার বার্তায় জানা যায় বর্তমানে তাদের হাতে ৪ দিনের বেশি রসদ নেই।
আরও সৈন্য আসছে তাতে জানা গেছে ঢাকা ও চট্টগ্রাম আকাশ পথে আরও সৈন্য পাঠানো হচ্ছে।
রবিবার দিন ঢাকা সামরিক কর্তৃপক্ষ জরুরী বার্তায় করাচীকে জানিয়েছিল “সাহায্য পাঠাও না হলে ঢাকা রক্ষা অসম্ভব।” এই বার্তাটি বেতারে পাঠানোর সময় মাঝখানে থেকে ধরা পড়ে।
ইউ এন আই জানাচ্ছে চট্টগ্রামে পাকিস্তানী সৈন্যরা মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে প্রচণ্ড বাধা পাচ্ছে এজন্য গতকাল এদের বিরুদ্ধে কামান দাগা হয়।
প্রাপ্ত অন্য এক সংবাদে প্রকাশ যে মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে যে সব পাকিস্তানী সৈন্যরা পালিয়ে যাচ্ছে তারা পোড়া মাটি নীতি অনুসরণ করছে। যেখানে যা পাচ্ছে সব ধ্বংস করছে। কুমিল্লা দখল করতে ব্যর্থ হলে এরা হাতের কাছে যা পেয়েছে ধ্বংস করে দিয়েছে।
দৈনিক কালান্তর, ৩০ মার্চ ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন