You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাক-সৈন্যের সপ্তাহব্যাপী দৃষ্টান্তহীন নির্বিচার গণহত্যা ঢাকা প্রত্যাগত ছাত্র নেতার রোমহর্ষক বিবরণ
(স্টাফ রিপোর্টার)

কলকাতা, ১০ এপ্রিল-ঢাকায় ইয়াহিয়া ফৌজ ২৪ মার্চ থেকে সপ্তাহব্যাপী যে নির্বিচার হত্যা চালিয়েছে, হিটলারী গণহত্যা ছাড়া তার আর কোনও তুলনা মেলা ভার।
সীমান্তের ওপারে ঢাকা ছেড়ে আসা ছাত্রলীগের সম্পাদক শ্রী শাজাহান সিরাজের কাছ থেকে ইয়াহিয়া ফৌজের ওই গণহত্যার বিবরণ পাওয়া গেল। এই বিবরণ থেকে বোঝা যায়, ইয়াহিয়া -ফৌজ মানুষ মারার আনন্দেই মানুষ খুন করেছে। কারণ একটিই, তারা বাংলাদেশের মানুষ।
২৫ মার্চ সন্ধ্যার পরেই খবর আসছিল যে ইয়াহিয়া ফৌজ হামলা চালাতে পারে। শাজাহান সিরাজ জানান রাত পৌনে এগারোটা নাগাদ হাইকোর্টের কাছে তিনি প্রথম- ৫৪ টি সাঁজোয়া গাড়ী দেখতে পান। আধ ঘন্টার মধ্যেই ৪০-৫০ টি লরী ভর্তি সৈন্য পুরানো ঢাকা শহরে এসে জড়ো হয় এবং রাত ১২ টা নাগাদ রাজারবাগ পুলিস লাইনে তারা হামলা করে। পুলিস পাল্টা গুলি চালালে বেশ কিছু সৈন্য হতাহত হয়। তখন ট্যাঙ্ক এনে পুলিস লাইনের উপরে গোলাবর্ষণ করা হয়। প্রায় ২০০ পুলিশ সেখানে মারা যায়। এর পর একের পর এক থানায় গিয়ে পুলিসদের দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা হয়। একই সঙ্গে সব ক’টি দমকল কেন্দ্রে গিয়ে দমকল কর্মীদেরও গুলি করে মারা হয়। উদ্দেশ্য এর পর তারা যে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ করবে, তা নিভানোর জন্য যাতে দমকলকর্মী না থাকেন। রাত ২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত সদরঘাট টার্মিনালে সেনাবাহিনী নির্বিচারে একটানা গুলি বর্ষণ করে। এই রাতেই কতো মানুষ যে মারা গিয়েছে, তার কোনও হিসাব জানা নেই।
২৬ মার্চ ভোর হতেই সাধারণ মানুষ ট্রাক, বাস, ঠেলাগাড়ি, রিক্সাকরে রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলি মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে এনে জড়ো করতে থাকে। সকাল ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে এক হাজারেরও বেশি মৃতদেহ জড়ো হয়। তার মধ্যে প্রায় ২০০ দমকল কর্মীর মৃতদেহও ছিল। এই সময়ে হঠাৎ ইয়াহিয়া বাহিনীর কিছু সৈন্য এসে চারপাশ ঘিরে বাইরে থেকে কোনও মৃতদেহনিয়ে আসা বা সেখান থেকে কোনও মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া বদ্ধ করে দেয়।
সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ মিলিটারি আবার শহরের সমস্ত রাস্তায় নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। কোনও মৃত ব্যক্তির দেহ তুলে নেবার জন্য কেউ রাস্তায় এগিয়ে এলে তাকেও গুলি করে মারা হয়। পুরানো ঢাকার প্রতিটি রাস্তার মোড়ে মোড়ে এইভাবে ৫০-৬০ জনের মৃতদেহ জমে ওঠে।
ইতোমধ্যে ইয়াহিয়া ফৌজ সার্জেন্ট জহুরুল হক (ইকবাল হল)-এর প্রতিটি ঘরে ট্যাঙ্ক থেকে গোলা বর্ষণ করে। জগন্নাথ হলটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। ঐ হলে যে সব ছাত্র ছিলেন, তাদের একজনও বাঁচেন নি। সেখানকার প্রোভোস্ট, ডীন ড. সাহাবুদ্দীন প্রমুখ এবং তাঁদের পাশাপাশি সব বাড়ির সমস্ত মানুষকে সৈন্যরা হত্যা করে। ইকবাল হলের কাছে যে স্টাফ কোয়ার্টার আছে সেখানে প্রতিটি কোয়ার্টারে ঢুকে কোথাও বা শুধু অধ্যাপকদের কোথাও কোথাও বা বাড়ির সকলকে হত্যা করে। ড. ইউনুস আলি, ড. জি, সি, দেব, ড. শরিফ প্রমুখ এইভাবে নিহত হন।
,
ইকবাল হলের সংলগ্ন দুটি বস্তি এলাকা- যেখানে প্রায় ৫০ হাজার গরীব মানুষের বাস- সেখানে সৈন্যরা দু’দিন পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আতঙ্কিত মানুষ আগুনের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য বস্তির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেই মেশিনগান চালিয়ে স্ত্রী পুরুষ শিশু বৃদ্ধ নির্বিশেষে তাদের মেরে ফেলা হয়। তেজগাঁস্ত বস্তি এলাকা ও শ্রমিক এলাকাগুলি এই ভাবেই নিঃশেষ করা হয়। সারা রাত ধরে এই ভাবে অগ্নিসংযোগ আর নরহত্যা চলতে থাকে। পরদিন, ২৭ মার্চ সকালে অবস্থা মোটামুটি শান্ত। এই সময়ে হাজার হাজার আতঙ্কিত মানুষ বুড়ীগঙ্গা নদী পার হয়ে জিঞ্জিরায় চলে যেতে থাকে। বেলা ১২ টা নাগাদ হঠাৎ মিলিটারি সদরঘাট টার্মিনালে এসে সেই ত্রস্ত মানুষগুলির উপর আধঘন্টা ধরে গুলি চালিয়ে বহু মানুষকে হতাহত করে।
এরই পাশাপাশি, ‘ওল্ড টাউনের’ বড়ো বড়ো দোকানগুলির তালা ভেঙে রাস্তা দিয়ে যাওয়া লোকদের বন্দুক দেখিয়ে বাধ্য করে দোকান লুঠ করতে এবং সেই “লুঠ” এর ছবি তুলে রাখা হয়।
এদিন রাতে শাখারিপট্টিতেও মিলিটারি আগুন লাগিয়ে দেয়া ঘর থেকে বার হয়ে আসা মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলে। এদিন শেষরাতে মিটফোর্ড হাসপাতালে খালি করে দেবার জন্য নির্দেশ দেয়-ইয়াহিয়া সৈন্যদের আস্তানা গড়ার জন্য।
২৮ তারিখ নদীর পাড় থেকে হঠাৎ মিলিটারি সরে যায়। এই সময় আক্ষরিক ভাবেই ঢাকা শহর থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ নদী পার হয়ে জিঞ্জিরা থেকে গ্রামের দিকে চলে যান। গ্রামবাসীরাও অকৃপণ সহৃদয়তার খাদ্য দুধ প্রভৃতি নিয়ে এগিয়ে আসেন সেই সব ত্রস্তমানুষের সাহায্যের জন্য।
২৯ মার্চ মিলিটারি তালিকা করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির খোঁজ করতে শুরু করে এবং রাতে বিভিন্ন বাড়ি থেকে মহিলাদের তারা জোর করে ধরে নিয়ে যায়৷
৩১ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় এই অবস্থা চলে। ১ এপ্রিল সন্ধ্যার পর মিলিটারী হঠাৎ নদী পার হয়ে ওপারে গিয়ে হানা দেয়। ভোরবেলা শুরু হয় গুলি-গোলা-বর্ষণ। নদীর ধারের বহু বাড়ি বিধ্বস্ত হয়। হাজার হাজার মানুষ দৌড়ে যতদূর যাওয়া সম্ভব ততদূর গিয়ে গ্রামে আশ্রয় নেন। এই পলায়মান মানুষের উপরে মিলিটারী গুলি চালায়। সিরাজ বললেন, এখানে কতো হাজার মানুষ যে মরেছে বলতে পারবো না। মাঠের যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি মানুষ পড়ে রয়েছে।
দৈনিক কালান্তর, ১১ এপ্রিল ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!