বাংলার বাণী
ঢাকা: ১২ই সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার, ২৬শে ভাদ্র, ১৩৮১
খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন
এমনিতেই খাদ্য ঘাটতির তার ওপর আবার সর্বনাশা বন্যায় শস্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। দুয়ে মিলে অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে তাকে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার সঙ্গে তুলনা করা চলে।
এটাতো আজ সর্বজনবিদিত সত্য যে প্রতিবছর সোনার চেয়ে দামি বৈদেশিক মূদ্রার বিনিময় খাদ্যশস্য আমদানি করতে হলে ভিক্ষের ঝুলি কাঁধে নিতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোন বিকল্প পথ নেই। এমনিতেই আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যশস্যের দাম হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া টাকা থাকলেও সময়মতো খাদ্যশস্য পাওয়া যায় না। এমতাবস্থায় একটিমাত্র পথই খোলা আছে আর তা হলো যে কোনো মূল্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত মঙ্গলবার কোটালীপাড়া, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা সফরকালে জাতীয় সঙ্কট নিরসনের জন্য বন্যার পানি সরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আবার পুর্নোদ্দমে চাষাবাদ শুরু করতে দেশের সমগ্র জনশক্তিকে নিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়িয়ে তুলতেই হবে। খাদ্যশস্যের উৎপাদন না বাড়িয়ে দেশকে স্বনির্ভর করে তোলার সংক্ষিপ্ত কোন পথ নেই। সরকারি অথবা বেসরকারি যেকোনো মালিকানার জমি হোক না কেন, দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি আবাদের আওতায় আনতে হবে।
তিনি আরো বলেন, বীজ ও চারা কেনার জন্য এবং নতুন করে চাষাবাদ শুরু করার জন্য সরকার সন্তাব্য সব রকমের সাহায্য দিয়ে যাবেন। বন্যার্তদের ত্রান-সাহায্য দানে এবং নতুন করে চাষাবাদ শুরু করতে বীজ, চারা ও মঞ্জুরি প্রদানের সরকারি প্রচেষ্টা কোন ত্রুটি হবেনা। কিন্তু সেই সাহায্য যারা লাভ করবেন তাদের কাছ থেকেও সমান সাড়া পেতে হবে।
বঙ্গবন্ধু যে একথা প্রথমবারই উচ্চারণ করলেন তা নয়। ইতিপূর্বেও তিনি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
বন্যা পরবর্তী অবস্থায় ব্যাপক চাষাবাদের কাজ চালু করার জন্য সরকারও এ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ রয়েছেন। গত মাসের শেষ ভাগে কৃষি, পল্লী ও সমবায় মন্ত্রণালয় বন্যা দুর্গত এলাকায় কৃষি পুনর্বাসন ও দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি গ্রহণের জন্য এক বৈঠকে মিলিত হন। বন্যা দুর্গত এলাকায় পুনর্বাসন কর্মসূচি ও সীমিত সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর ব্যাপারে পরীক্ষা করে দেখার জন্য পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। শুধু তাই নয় সারা দেশে কৃষি পুনর্বাসন এর জন্য ২৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন সরকার।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ১৯৭৪-৭৫ সালের খাদ্য ঘাটতি অনুমান করা হয়েছিল ১৭ লক্ষ টন এবং এবারকার বন্যায় ক্ষতি হয়েছে ১৩ লক্ষ টন। দুটো মিলিয়ে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৩০ লক্ষ টন। সুতরাং অবস্থাটা যে আদৌ সুবিধাজনক নয় এটা সহজেই অনুমেয়। সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলতে হয় যে আমরা বর্তমানে দাঁড়িয়ে আছি ডেমোক্লিসের তরবারির নিচে। যেকোনো সময়ে তরবারি গর্দানে নেমে আসতে পারে। কাজেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে বাস্তবায়িত করতে হলে সরকার ও জনসাধারণকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে। কথা নয়, কাজের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য।
এ প্রসঙ্গে আমরা বলতে চাই যে, সরকার অবশ্যই বীজ, সার, সেচ ও প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করবেন ঠিকই তবে মাঝে মাঝে দেখা যায় লালফিতা এবং দুর্নীতি নামক দুটো ভূতের জ্বালায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। সরকারকে অবশ্যই এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে কৃষকদের হাতে প্রয়োজনীয় অর্থ, সার, বিজ সময়মতো পৌছাছে কিনা। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, আমাদের কৃষকরা সৎ ও পরিশ্রমী। তারা সামান্য সাহায্য পেলেই অসামান্য কাজ যে করতে পারে এমন দৃষ্টান্ত অভাব নেই বাংলাদেশে।
জয়তুঃ গিনি বিসাউ
গত মঙ্গলবার লিসবনে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে পর্তুগালের প্রেসিডেন্ট স্পিনোলা গিনি-বিসাউ এর স্বাধীনতা সনদে স্বাক্ষর দান করেন। বেলেম প্রাসাদে মাত্র দশ মিনিট স্থায়ী স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গিনি-বিসাউ ৩শ’ ৪৩ বছরের সুদীর্ঘ পর্তুগিজ উপনিবেশিক শাসন মুক্ত হল। ছয় লাখ মুক্তি পাগল মানুষের প্রতীক্ষার সংগ্রামের অবসান ঘটল মঙ্গলবার থেকে। গিনি-বিসাউ এর মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। উনিশ’শ আট সাল থেকে। কিন্তু গোটা জাতির ঐক্যবদ্ধতা এবং সমন্বয়ের অভাব সেই মুক্তিসংগ্রামকে বিলম্বিত করে। তারপর উনিশ’শ ছাপ্পান্ন সালের আফ্রিকান পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এমিলকার কারো মুক্তিসংগ্রামকে বাস্তব সুসমন্বয় অসংহত রূপ দান করেন। তাঁর নেতৃত্বে গিনি-বিসাউ এর স্বাধীনতা সংগ্রামীরা পর্তুগিজ শাসকদের উপর মরণআঘাত হানতে থাকে এবং ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে গিনি বিসাউ এর অধিকাংশ অঞ্চল মুক্তিসংগ্রামের দখলে চলে যায়। গত চব্বিশে আগস্ট গিনি বিসাউকে মুক্তি সংগ্রামীদেএ তরফ থেকে একতরফাভাবে স্বাধীন-সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ঘোষণার অব্যবহিত পরেই বাংলাদেশসহ এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশ স্বীকৃতি জানায়।
গিনি-বিসাউকে স্বাধীনতা প্রদান ছাড়া পর্তুগাল সরকারের সম্মুখে দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা ছিলো না। কারণ গোটা দেশটির সামান্য গুটিকয়েক অঞ্চল ছাড়া বাস্তব ক্ষেত্রে সমগ্র গিনি-বিসাউ এর অধিকাংশ এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে যায়। এরপর পৃথিবীর স্বাধীনতা সমর্থনকারী দেশগুলোর গিনি বিসাউ এর প্রতি অব্যাহত সমর্থন এবং স্বীকৃতি প্রদান পর্তুগিজ সরকারের বাস্তব বুদ্ধির উন্মেষ ঘটাতে সহায়তা করে। সুতরাং সব দিক বিবেচনা করে স্পিনোলা সরকার এ দেশটিকে স্বাধীনতা প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তাদের এই বাস্তব সিদ্ধান্তকে আমরা অভিনন্দন করছি। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একটা জিনিস দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের সংগ্রামকে নানাভাবে পর্যদুস্ত করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আবহমানকাল ধরে বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। তারই ফলশ্রুতিতে এশিয়া ও আফ্রিকার জনপদগুলোর আজ স্বাধীনতা সূর্যের রক্তিমাতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে এবং সাম্রাজ্যবাদী চক্র ধীরে ধীরে তাদের থাবা গুটিয়ে ফেলেছে।
কিন্তু তবুও সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলো নিরবিচ্ছিন্ন শান্তিতে থাকতে পারে না। পারে না কারণ প্রাক্তন উপনিবেশগুলোতে তারা দাবার গুটি বসিয়ে রেখেছে এবং তারই সর্বশেষ নিদর্শন হল সাম্প্রতিককালের মোজাম্বিক পরিস্থিতি। আগামী বছর মোজাম্বিক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করবে। এই মর্মে ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরিত হওয়ার পরই দেখা গেল সে দেশে অবস্থানরত শ্বেতাঙ্গ আর বিদ্রোহীরা নতুনভাবে হাঙ্গামা শুরু করেছে। মুখে শান্তির ললিত বাণী যতই শোনা যাক না কেন মোজাম্বিকের ঘটনাবলী এ কথাই প্রমাণ করে যে আভ্যন্তরীণ গোলযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতাকে বিলম্বিত করার অপকৌশল উপনিবেশিক শাসন অবলম্বন করছে। সদ্য স্বাধীন গিনি-বিসাউ এর জনগণ আততায়ীর হাতে নিহত তাদের মহান নেতা এমিলোকের মহান আদর্শকে সমুন্নত রেখে সম্ভাব্য সকল পরিস্থিতির মোকাবেলা ও ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যাবেন, তাদের এই নতুন যাত্রাপথে এই আমাদের ঐকান্তিক কামনা।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক