You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.27 | বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাংলাদেশে ঈদ হয় নাই | সংগ্রামী বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাংলাদেশে ঈদ হয় নাই
[রিপোর্ট দুরমুজ আলী]

যে উৎসব যে আনন্দ, যে মহামিলনের বার্তা নিয়ে প্রতি বছর ঈদের আবির্ভাব মানুষের ঘরে সে বাৰ্ত্তা অশ্রুসজল নয়নে ফিরে চলে গেছে। বাংলার ঘরে ঘরে বিষাদের ছায়া, প্রতি ঘরে কান্নার রোল, প্রতিটি মানুষের চোখের জলে এবারের ঈদ বেদনাহত হয়ে ফিরে গেছে। ঈদ উৎসবের ভাষা স্তব্ধ। আনন্দের ভাষা কণ্ঠরুদ্ধ। মহামিলনের বদলে মহাবেদনা নিয়ে ফিরে গেছে সবাই নিজ নিজ আশ্রয়ে। এবার আবার কিসের ঈদ? সমগ্র বাংলা জুড়ে নর কঙ্কালের মিছিল। শকুনি গৃধিনীর রাজত্ব। এখানে পুত্রহারা মায়ের আকুল আর্তনাদ। মাতৃহারা শিশুর মর্মভেদী হাহাকার। গৃহহারা, সম্পদহারা, সর্ব্বহারাদের দীর্ঘশ্বাসে আকাশ বাতাস ব্যথিত। বাংলার প্রকৃতি বেদনায় ক্ষত বিক্ষত। মানুষ লড়াই করছে মৃতুর সঙ্গে দারিদ্রের সঙ্গে, নিষ্ঠুর পাক ফৌজ ও তাঁর অধঃস্তনদের সঙ্গে। শুধু ঈদ নয় বাংলার শরৎও এসেছিল কিন্তু শারদীয় উৎসব হয় নাই। আনন্দ হয় নাই। জগজ্জননী দূর্গা বাংলার মাটি থেকে বিতাড়িত লাঞ্ছিতা হয়েছেন। বাংলায় মন্দিরও নাই দেবতাও নেই। আজ বাংলার কুলবধূ সান্ধ্যদ্বীপ জ্বালে না, বিগ্রহ দেবতাকে প্রণাম জানাবার কেউ নাই আজ বাংলায়। বাংলায় উলুধ্বনি আর হয় না, কাসার ঘণ্টাও বাজে না। মন্দিরের ঘরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করার জন্য কোন ভক্ত পূজারী পাক অধিকৃত বাংলায় নাই। বাংলায় ফুল হয়ত আছে তার সৌন্দর্য্য উপভোগ করার কোন লোক নাই। বাঙালী বাড়ীঘর চাকরী ব্যবসা সব ছেড়ে সর্ব্বহারায় পরিণত হয়েছে, লাঞ্ছিত মানবতা কেঁদে ফিরে সর্বত্র। বাংলায় সুখ শান্তি নিৰ্ম্মমভাবে নিহত। বাংলায় আজকে আছে পাক ফৌজের পাশবিক অত্যাচার আর মুক্তি বাহিনীর আক্রমণের রাইফেল মেশিনগানের গোলাগুলি। আজ বাংলাদেশ এক বিশাল রণক্ষেত্র। ৭ মাস ধরে বাংলার মানুষ রাতে ঘুমুতে পারে নাই। আহারের কোন প্রেরণা পায় নাই। বাংলার চাষীরা মেঠো গান ভুলে গেছে। রাখালেরা আর মাঠে মাঠে বাঁশী বাজায় না। শিশুদের খেলাধুলা বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝিদের ভাটিয়ালী গানে নদী মাতৃক বাংলা আর মুখরিত হয়ে উঠে না। যাত্রা থিয়েটার বাংলা থেকে বিদায় নিয়েছে। পল্লীগীতি, লোকগীতি, বাউল, মুর্শেদী কীর্তনের জন্মভূমি বাংলা আজ প্রতিহিংসা পরায়ণ। অত্যাচারী জালেমশাহীর বিরুদ্ধে যুদ্ধরত সৈনিক। বাংলায় লুণ্ঠনকারী আর ডাকাতেরা বড়লোক হয়েছে, লক্ষপতি হয়েছে, আবার অনেক ধনী পথের কাঙ্গাল হয়েছে। নির্বিচারে নিরাপরাধ জনতাকে হত্যা করা হয়েছে, আর অপরাধীরা রাজাকার হয়েছে। এখনও বাংলায় গঙ্গা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, ধলেশ্বরী, তিস্তা প্রবাহিত হয় কিন্তু তার পানি লাল। বাংলার শ্রমিকেরা চাকরী হারিয়েছে কৃষকেরা জমি ছেড়ে চলে গেছে। ছাত্র সমাজ স্কুল কলেজ ছেড়ে দিয়েছে। বাঙালী দোকানদার দোকান ছেড়েছে। বাংলা আজ মুক্তি যোদ্ধা।
সংগ্রামী বাংলা ॥ ১: ২ ॥ ২৭ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন