ঢাকা এখন ফ্যাসিষ্টদের কবলে
দিল্লীর নিউ এজ এভ কাগজ থেকে সংগৃহীত/ভারতীয় প্রতিনিধি প্রেরিত ২৮শে গত সেপ্টেম্বর কলিকাতাস্থ গ্র্যাণ্ড হোটেলে আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর [স্থপতি] ষ্ট্যানলি টাইগারম্যানের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। ইনি বিশ্ব ব্যাঙ্ক সংস্থার পক্ষ থেকে “আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছে “তাহলেও মানুষ পাক সৈন্যের জন্য কাজ করছে কেন?” আমি ঢাকায় আমার নিজ চোখে দেখা এক দৃশ্য বলি। একটা রাস্তা মেরামত চলছিল বাঙালী মজুর দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে। সত্তর আশিজন পাকসৈন্য রিভলবার হাতে এবং বেয়োনেট লাগানো রাইফেল হাতে তাদের তদারক করছিল। কোন সামান্যতম গোলমাল হলেই দুচারজন লোককে সরিয়ে ফেলা হয় এবং তারা উধাও হয়ে যায়। অন্যান্য বিদেশী বন্ধু ও আমার বাঙালী বন্ধুরা একই কথা বললে: ঢাকায় সরানো মানেই ঐসব লোককে গুলী করে শেষ করা হয়েছে অথবা তাদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে ঢাকার সর্বত্র বিশেষতঃ ইউনিভার্সিটি পাড়ায় (যেখানে জগন্নাথ হলের ধ্বংস স্তূপ দেখলাম) পাকসৈন্য গাড়ী করে মানুষের দিকে অটোমেটিক বন্দুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ায়, শহরের সর্বত্র হাওয়ায় হাওয়ায় সকাল থেকে সন্ত্রাস ভেসে বেড়ায় অদ্ভুত ভাবে। যেকোন স্বাভাবিক পুরুষ বা মেয়ে ঢাকায় কাজ করতে ঘৃণা বোধ করবে। এই যদি ফ্যাসিজম্, এই যদি পুলিশ রাষ্ট্র না হয়, তবে এটা কী?
আমাদের প্রকল্পের অনেক কর্মীকে শেষ করে নেওয়া হয়েছে এবং আমি স্থির নিশ্চিত কোন স্বাভাবিক মানুষ, কোন গণতন্ত্র বিশ্বাসী, পাক জঙ্গীর জন্য কাজ করতে পারে না। আমি আমেরিকা ফিরে যাচ্ছি এবং আমার স্বাক্ষরিত রিপোর্টে আমি বিশ্বব্যাঙ্ককে এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ করতে অনুরোধ করেছি—কারণ এখন এই কাজ চালানো অন্যায় এবং অসম্ভবতো বটেই, আর আমি নিজে তো আমেরিকায় সিভিল রাইট্স এর পক্ষে ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপক্ষে। তাহলে আমি কি করে পাকিস্তানের পুলিশ রাষ্ট্রের জঙ্গী একনায়কত্বের হয়ে কাজ করি? আমি আর কখনো পাকিস্তানে ফিরে যাবো না, যদিও স্বাধীন বাংলা দেশের জন্য কাজ করতে পেলে তাকে আমি সম্মানজনক ও আকর্ষণীয় কাজ বলে বরণ করে নেব।”
আমার সময় হয়ে গিয়েছিল। যাবার আগে প্রশ্ন করলুম “বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তোমার কি মনে হয়?” স্থির শান্ত গলায় টাইগারম্যান বললেন “আমি স্বাভাবিক ভদ্র লোক, হিংসা আমি ভালোবাসি না, আমি খুশী হতাম যদি ওখানে রাজনৈতিক সমাধান হত। কিন্তু বিশ্বাস কর, পদ্মায় লালরক্ত অনেক বয়েছে; তাকে এড়িয়ে বাংলার মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছু মেনে নিতে পারে না। আবার ইয়াহিয়া গোষ্ঠীর শিকারী বাজেরা বাংলাদেশকে ইচ্ছামত স্বাধীন হতেও দেবে না। তাই বাংলাদেশকে স্বাধীনতার জন্য লড়তে হবে, লড়তেই হবে। যদিও তা দশ বছরের দীর্ঘ যুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে এবং জঙ্গীশাহী সেখানে চলবে না আমি ঢাকা ও আশেপাশে এক মাসে অনেক বাড়ীতে গেছি। সর্বত্র মানুষ ছেলেবুড়ো মিলে স্বাধীন বাংলা রেডিও শোনে এবং মুক্তিবাহিনীর জয়কে অভিনন্দন জানায়। মৃত্যুহীন এই মুক্তিস্বপ্ন কে নিরস্ত করতে পারে?”
বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১: ১০ ॥ ২৪ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন