You dont have javascript enabled! Please enable it!

‘মুক্তিবাহিনী তো যাদু জানতা হ্যায়’
পাত্তা নেহি…. কিধার সে আতা হ্যায় আওর কিধার জাতা হ্যায় হামলোগ কেয়া করেগা

মাত্র কয়েকদিন আগের কথা। বেলা একটার দিকে ঢাকার মতিঝিল এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন একজন পাঞ্জাবী মেজর। সাথে রয়েছে কেবলমাত্র তার জীপের ড্রাইভার। মেজরের জীপখানা যখন মতিঝিল টি এ্যাণ্ড টি কলেজের সামনে গেল তখন হঠাৎ কোথা থেকে খান দুই তিন গাড়ী এসে জীপের সামনে থেমে গেল। আর জীপের পেছনেও ছিল খান দু’য়েক মোটরগাড়ী। মেজর ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক রাস্তা ‘জ্যাম’ মনে করে নিজের জীপখানার গতি থামিয়ে দিলেন। সাথে সাথে চারিদিকে থেকে ৮/১০ জন যুবক এসে মেজর সাহেবকে ঠেসে ধরল। ঘটনার আকস্মিকতায় মেজর পকেট থেকে রিভালবার বের করারও সুযোগ পেলেন না। ড্রাইভারত দুই ঘুষিতেই কুপোকাত। তারপর তরুণরা মুখ বেঁধে গাড়ীতে তুলে মেজরকে যে কোথায় নিয়ে গেল তার হদিস আজো পায়নি।
কিন্তু ব্যাপারটা ওখানেই শেষ নয়। ক্যান্টনমেন্টে খবর পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই সেনা বাহিনীর ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেল চারিদিকে। তারা ঘিরে ফেলল সমগ্র এলাকা। কিন্তু কোথাও কোন খোঁজ হল না মেজরের। টি এ্যাণ্ড টি কলেজ থেকে শ’দুয়েক গজ দূরে মতিঝিল পীরজঙ্গী মাজারের পাশেই ছিল সেনাবাহিনীর একটা চেক পোষ্ট। তার তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিলেন একজন বেলুচ ক্যাপ্টেন। মেজরকে কোথাও না পেয়ে পাগলের মত ছুটে আসলেন সেখানে আরেক জন পাঞ্জাবী মেজর। ‘সামরিক ভাষায়’ করলেন বেলুচ ক্যাপ্টেনকে যত সব অশ্রাব্য গালি-গালাজ। ক্যাপ্টেন ধৈর্য ধরে সবই শুনলেন। তারপর সবিনয়ে বললেনঃ “মেজর সাব, মুক্তি বাহিনী তো যাদু জানতা হ্যায়। পাত্তা নেহী উয়োলোগ কিধার সে আতা হ্যায় আওর কিধার যাতা হ্যায়। মাগার স্রেফ গোলিয়া নজর আতা হ্যায়। হামলোগ্ কেয়া করেগা?
“অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় ২৪, ২৫ বছরের এক বাঙালী মহিলা ঢাকা থেকে একাকী যশোর যাচ্ছিলেন। গোয়ালন্দ ষ্টিমার ঘাটে তাকে দেখেই এক বেলুচ মেজর জিজ্ঞেস করলে তিনি একা যাচ্ছেন কি না। মহিলা বেশ কয়েক বছর ভায়ের সাথে করাচী ছিলেন। তাই তিনি ভাল উর্দু বলতে পারেন। ইংরেজীত তিনি ভাল বলেনই। কেননা তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম, এ। যাক, অনেক কথাবার্তার পর তাদের যখন বিদায় হবার পালা আসল তখন মেজর মহিলাকে বললেন: “আপ হামারা লিয়ে দোয়া কিজিয়ে কে হামলোগ জিন্দা রহে।” মহিলাও কম চালাক নন্। তিনি কথাবাত্তায় বুঝে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দমনের ব্যাপারে বেলুচ মেজর পিণ্ডির সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে একমত নন্। তাই মহিলা জবাবে রসিকতা করে বললেন: “আপ ভি হামারী লিয়ে দোয়া কিজিয়ে কে হামলোগ জিত জায়ে।”
মেজর মহিলার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন। কিন্তু মুখে কিছু না বলে একটু মুচকি হেসে চলে গেলেন।
গত রবিবার যশোর ক্যান্টনমেন্টের অদূরে অপারেশন করে ফিরে আসার সময় চারজন মুক্তি বাহিনী গেরিলা পাক সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। সৈন্যরা তাদের ধরে নিয়ে যায় ক্যান্টনমেন্টে। কিন্তু যার কাছে তাদের হাজির করা হয়েছিল তিনি ছিলেন একজন বেলুচ মেজর। তিনি মুক্তি বাহিনী গেরিলাদের নিরস্ত্র করে অন্য সবাইকে ঘর থেকে চলে যেতে বলেন। মুক্তি বাহিনী গেরিলারা অভুক্ত আছেন সন্দেহ করে তিনি তাদেরকে চা-নাস্তায় আপ্যায়িত করলেন। তারপর ফিস ফিস করে বল্লেন “জয় বাংলা মাত বোলিয়ে। উওতো হিন্দু লোককো জয় হিন্দকা মাফিক হ্যায়। মাগার আপলোগ স্বাধীন বাংলা বলিয়ে। আপলোগ স্বাধীন হো যাইয়ে উস্কা বান্দা হামলোগ্ ভি স্বাধীন হো জায়েগা।’ কথাগুলো শেষ হতে না হতেই মেজর হাত ইসারা করে মুক্তি বাহিনী গেরিলাদের কেটে পড়তে বল্লেন। মেজরের মন, মানস ও ইঙ্গিত বুঝতে বাঙালী তরুণদের এতটুকুও বিলম্ব হলো না। তারা মেজরকে সালাম জানিয়ে আস্তে কেটে পড়লো বদ্ধভূমি ক্যান্টনমেন্ট থেকে।
১৪ই অক্টোবর। দখলীকৃত ঢাকা থেকে মুক্ত এলাকায় পালিয়ে আসছিলেন এক বাঙালী লোক। কুমিল্লা জেলার কসবার কিছু দূরে এসে দেখলেন ফেরী ঘাটের কাছে দাড়িয়ে আছে জনা পাঁচেক সৈন্য। ভয়ে ভয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত। কারণ, তার কাছে ছিল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দলিলসহ কাগজপত্র। তাকে দেখেই সৈন্যদের একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় যাবেন? ঐ লোক আসল কথা না বলে একটি জায়গার নাম করলেন। সংশ্লিষ্ট সৈনিক জানালেন তারা ওর কাছেই যাবেন। তারা চান যে তিনি তাদের সাথেই যান, কেননা সাথে একজন বাঙালী থাকলে তাদের উপর হয়ত কোনো বিপদ আসবে না। ভদ্রলোকের ভিতরে ভিতরে অনিচ্ছা থাকলেও বাইরে তাদের প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। ইতিমধ্যে ঘটে গেল একটাI
ব্যাপার যার থেকে বাঙালী ভদ্রলোক বুঝতে পারলেন যে, তার সাথে যিনি কথাবার্তা বলেছিলেন তিনি একজন বেলুচ মেজর। সেই বেলুচ মেজরকে অন্য একজন পাঞ্জাবী মেজর বহন করতে দিয়ে ছিলেন তার টুপি ও হাতের ছড়িটি। কিছুদূর গিয়েই তিনি মনে করলেন তিনি কেন একজন পাঞ্জাবী অফিসারের টুপি ও ছড়ি বহন করবেন। তাই তিনি একটু ঘৃণা ভরেই সাথের একজন পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনকে তার ছাড়া ভাইএর টুপি ও ছড়ি বহন করার হুকুম করলেন। কিন্তু যেভাবে ও ভঙ্গিতে তাকে আদেশটি দেওয়া হয়েছিল তাতে তিনি রীতিমতো ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তারপর বেলুচ মেজর ও পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনের মধ্যে প্রকাশ্য রাস্তাতেই খণ্ডযুদ্ধ বাধার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত একজন পাঞ্জাবী হাবিলদার এগিয়ে এসে টুপি ছড়ি বহনের দায়িত্ব নিয়ে নেয় যার ফলে একটা রক্তাক্ত সংঘাত পরিহার করা সম্ভব হয়।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২৫ ॥ ২৯ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!