You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় কি দেখিলাম-

অতি সম্প্রতি ‘বাংলার বাণী’র একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা সফর করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন। সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের প্রতিনিধি যে বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তাহারই শেষ অংশ এখানে ছাপা হইল।
অধিকৃত এলাকায় পাক সেনারা যথেচ্ছভাবে স্থানীয় অবাঙালী কুলি- কামিন এবং চোর-ডাকাত গুণ্ডা- বদমায়েশদের লইয়া বদর, রাজাকার ও মুজাহিদ বাহিনী গঠন করিয়া চলিয়াছে। তাহাদের সহিত কিছু মুসলিম লীগ ও জামাতের গুণ্ডা-পাণ্ডাও জুটিয়াছে। তাহারা পাক বাহিনীর ছত্রছায়ায় থাকিয়া যে ঘৃণ্য কেলেঙ্কারীর ইতিহাস সৃষ্টি করিয়া চলিয়াছে তাহা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না। পাক বাহিনী নিজেরা যে কোন সম্মুখ সময়ে গা বাঁচাইয়া চলিয়া প্রায়শঃই ইহাদিগকে মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলিয়া দেয়। রাত্রিকালে পাক বাহিনী যেখানে শিবিরের বাহিরে আসিবার কল্পনাও করিতে পারে না সেখানে রাজাকার বা মুজাহিদ বাহিনীর লোকদের দিয়া শিবির সমূহে নৈশকালীন পাহারা দিবার ব্যবস্থা করা হইয়াছে। সামান্য কয়েকদিন অনুশীলনীয় পরই তাহাদিগকে ফ্রন্টে পাঠাইয়া দিয়া খান সেনারা নিজেরা নিরাপদ দূরত্বে গা বাঁচাইয়া অবস্থান করে। সে জন্য প্রতি ক্ষেত্রেই স্বল্প ট্রেনিংপ্রাপ্ত এইসব বালিখিলারা হয় পালাইয়া প্রাণ বাঁচায় না হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিত নিশানায় পরিণত হয়।

হাট-বাজার
অধিকৃত এলাকার হাট-বাজার প্রায় সবই কোনমতে চলিতেছে। এবং জিনিস পত্রের দাম আগুন হইয়া উঠিয়াছে। অতি সম্প্রতি সেখানে লবন প্রতি সের দুই টাকা হিসেবে এবং কিছুদিন আগে কেরোসিন তেল প্রতি টিন ৪৫ টাকা হইতে ৫২ টাকা পর্যন্ত বিক্রী হইয়াছে, ইদানিং তাহা কমিয়া ২৮ টাকা হইতে ৩২ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হইতেছে। চাউল আটা প্রায়ই হঠাৎ করিয়া বাজার হইতে উধাও হইয়া যায়। সাধারণ চাউলের দর এসময় সাধারণতঃ মণপ্রতি ৪২ টাকা হইতে ৪৮ টাকা পর্যন্ত হইয়া থাকে, বর্তমানে উহা ৬০ টাকার উপরে। গ্রামাঞ্চলে তাহাও পাওয়া দুষ্কর। এই সব নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং খাদ্য শস্যের এরূপ উর্ধ্বগতির কারণ কি এই সম্পর্কে জনৈক বাঙ্গালী ব্যবসায়ীকে প্রশ্ন করা হইলে তিনি জানান যে, প্রতিটি নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য শহর হইতে খরিদ করিয়া অবাঙ্গালী অধ্যুষিত এলাকায় মজুত করা হইতেছে। সামরিক বাহিনীর খাদ্যশস্য যথেষ্ট জমা হইয়া যাওয়ায় তাহারা লুটপাট করিয়া নিজেরা না লইয়া অবাঙ্গালী ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রয় করিয়া দিতেছে। এবং সেইগুলি সৈয়দপুর, পার্বতীপুর, শান্তাহার, ঈশ্বরদি, খালিশপুর ইত্যাদি বিশেষ এলাকায় জমা করা হইতেছে। তাহাদের উদ্দেশ্য কি জানা ভার। ব্যবসায়ীটি আরো জানান স্থানীয় হাট বাজারগুলির আড়তগুলিতে প্রথমদিকে যে লুটের তাণ্ডব চলিয়াছিল সে তাণ্ডবে কোন বাঙ্গালী আড়তই রক্ষা পায় নাই।
বর্বররা হয় লুটপাট করিয়া মালামাল লইয়া গিয়াছে না হয় আড়ত অগ্নিদগ্ধ করিয়াছে। কাজেই ব্যবসায়ীরা রাতারাতি পথের ভিখারী হইয়া ব্যবসা গুটাইতে বাধ্য হইয়াছেন।
জনৈক গ্রামবাসীকে স্থানীয় হাটের ভয়াবহ অবস্থার কথা প্রশ্ন করিলে তিনি জোরপূর্বক প্রায়ই জানান কিছু না কিছু রাজাকার ও পাকবাহিনী আসিয়া দোকানদারের নিকট হইতে সাধ্যাতিরিক্ত অর্থ চাহিয়া বসে এবং অর্থদানে বিলম্ব ঘটিলে মারধোর, খুন-জখম করিতেও দ্বিধাবোধ করে না। তাহারা সবকিছু লুটপাট করিয়া লইয়া যায়। ইহার ফলে কোন ব্যবসায়ীই আর নতুন জিনিষ না কিনিয়া দোকান আপাততঃ বন্ধ করিয়া দিতে বাধ্য হইয়াছেন।

স্কুল-কলেজ
অধিকৃত এলাকায় স্কুল-কলেজগুলির অবস্থা চরম নৈরাশ্যজনক। স্কুল গুলিতে ৫০০- ৬০০ ছাত্রের মধ্যে ২/১ জন ছাত্র মাঝে মধ্যে বেড়াইতে আসে। পড়াশোনার প্রশ্ন উঠে না। বোর্ডের ফাইনাল পরীক্ষা হলগুলিতে ছাত্রদের অনেক ভয় ভীতি প্রদর্শন করাইয়া মুষ্টিমেয় ও কিছু সংখ্যক ছাড়া কাহাকেও উপস্থিত করাইতে পাক বাহিনী ব্যর্থ হইয়াছে। যাহারা পরীক্ষায় উপস্থিত হয় নাই তাহাদের পিতামাতার নিকট কারণ দর্শাইবার নোটিশ যাইতেছে বলিয়া প্রকাশ। কলেকগুলিতে কিছু কিছু অবাঙ্গালী ছাত্র হাজিরা দেয় এবং এইসব অবাঙ্গালী ছাত্ররা প্রায়ই ক্লাসের দিকে না যাইয়া ক্যান্টিন ও কমন রুমের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করিয়া কালক্ষেপ করে।

শহরের পথ-ঘাট
শহরের পথচারী প্রতিটি মানুষের চোখে মুখে আতঙ্কের ভাব পরিস্ফুট। পথচারী সকলেই প্রায় নিরাপত্তার ভয়ে সর্বদা সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কিত। শহরবাসীরা একান্ত বাধ্য না হইলে ঘর হইতে বাহির হইবার চেষ্টা করেন না।
শহরের প্রায় বড় বড় দোকানগুলি তালাবন্ধ হইয়াছে। দোকানগুলির সাইনবোর্ড ও বিজ্ঞাপনে নতুন উর্দু অক্ষর বসিয়াছে। বাঙালী পথচারীকে ব্যঙ্গ করিতেছে। রাতারাতি শহরের সকল সাইনবোর্ড ও মোটর গাড়ী, রিকশার নম্বরপেন্টট বাংলা হইতে উর্দুতে লিখিতে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ীঘর, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাটগুলি ইতোমধ্যে অবাঙ্গালী ও জামাত মুসলিম লীগ সমর্থকদের মধ্যে নামমাত্র মূল্যে বিক্রী করা হইয়াছে।
বাংলার বাণী ॥ ৩ সংখ্যা ॥ ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!