বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের পদধ্বনি
॥ বার্নার্ড ব্রেইনী॥
দিনের পর যেমন অবধারিত জীবন নিয়মে রাত্রি আসে স্বাধীন অক্টোবর মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ ইতিহাসের ভয়াবহতম দুর্ভিক্ষ শুরু হইলে ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক সাহায্য ও খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা না হইলে এই দূর্ভিক্ষ নড়াইবার সাধ্য কাহারো নাই।
সম্প্রতি কানাডার টরোন্টোতে দক্ষিণ পূর্ব এশীয় বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হইয়াছে। এই সম্মেলনের উদ্দেশ্য ছিল কানাডায় আক্সকাম নামক ত্রাণসংস্থা। অকটোবরে বাংলাদেশে ভয়াবহতম দূর্ভিক্ষের আশংকার কথা ঐ বিশেষজ্ঞরাই বলিয়াছেন।
কিছুকাল আগে বিশ্বব্যাঙ্ক প্রতিনিধিদের বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকা সফর করিয়া গিয়াছেন। তাঁহারা একবাক্যে বলিয়াছেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দখলীকৃত এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থার চিহ্ন রাখে নাই। পাকিস্তানি দস্যু বাহিনীর নৃশংস নির্যাতনের সময়ে সেখানে জনসাধারণ ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় দিন যাপন করিতেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অথবা হানাদার বাহিনীর পদলেহী দালালদের প্রতি জনগণের অন্তহীন ঘৃণা আর বিক্ষোভ। মিল-কারখানা সমূহে শ্রমিকেরা কাজে যোগদান করে নাই। সরকারী বেসরকারী অফিসসমূহে যাহারা কাজে যোগদান করিয়াছে তাহাদের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য।
পরিস্থিতির অবনতি হইতেছে
ইতিমধ্যে আরো সময় অতিক্রান্ত হইয়াছে। বিশ্বব্যাঙ্ক প্রতিনিধি দল যখন অধিকৃত এলাকা সফর করিয়াছেন তাহার পর পরিস্থিতি সামান্য উন্নতিও হয় নাই। বর্তমানে ভারতে প্রায় ৮৫ লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় নিয়াছে। আরো অনেকে প্রাণ বাঁচাইবার জন্য ভারত সীমান্তের দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে। শরণার্থীদের সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাইতেছে। মৰ্মাহত কংকালসার ভগ্নস্বাস্থ্য এইসব দুর্ভাগা মানুষদের দেখিলেই বুঝা যায় অধিকৃত এলাকায় যাহারা বাস করিতেছে তাহারা কি অসহনীয় ভয়ঙ্কর অবস্থায় কাল কাটাইতেছে।
ঔপনিবেশিক জঙ্গীশাহী অবশ্য ইতিমধ্যে তাহাদের পদলেহী একজন দালালকে বাংলাদেশের অধিকৃত দখলকার গভর্ণররূপে নিয়োগ করিয়াছে। কিন্তু সেখানে জনজীবনের কোথাও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসিবার লক্ষণ নাই। সবচেয়ে বড় কথা, সাড়ে সাত কোটি বাংঙ্গালীর অবিসংবাদিত প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে আটক করিয়া ইয়াহিয়া তাঁহার বিচার প্রহসন শুরু করিয়াছে। এই ধরণের ঘটনার পর বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসে নাই, আসিতে পারে না।
দূর্ভিক্ষের আশঙ্কা কেন ?
সূজলা সূফলা শস্যশ্যমলা বাংলাদেশ। উর্বর ভূমি এবং প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে বাংলার মাটি স্বর্ণ প্রসবিনা।
কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও বাংলাদেশে পুষ্টিহীনতা একটি মারাত্বক সমস্যা। অনাহার ও অর্ধাহারতো প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার মাত্র।
বাংলাদেশের মানুষের সাধারণ খাদ্য মাছ ভাত। সঙ্গে সব্জী এবং কখনো কখনো মাংস।
গত বৎসর বিশ্বব্যাঙ্কের এক রিপোর্টে বলা হইয়াছিল গড়ে একজন বাঙ্গালীর খাদ্যের পরিমাণ হইতেছে ১৬.১ আউন্স এই খাদ্যে ক্যালোরির পরিমাণ ১৭০০। তুলনামূলকভাবে উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহে দৈনিক গড়পড়তা ক্যালোরীর পরিমাণ হইতেছে ২৭০০।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের এক সরকারী রিপোর্টে স্বীকার করা হইয়াছিল উল্লিখিত ক্যালোরীর পরিমাণও শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের জোটে না। গ্রামাঞ্চলে অনাহার ও পুষ্টিহীণতা এক মারাত্মক সমস্যা। শিশু মৃত্যুর হার শতকরা ২৬। ইউরোপের এই হার হইতেছে মাত্র ২.৪।
টরোন্টো সম্মেলনে এই বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করিয়াছেন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল এর ডাঃ জন রোড। ডাঃ জন রোড সম্প্রতি বাংলাদেশের দখলীকৃত অঞ্চল পরিভ্রমণ করিয়াছেন।
তাঁহার অভিমত যে দেশে স্বাভাবিক সময়ে খাদ্যের পরিমাণ এত কম, সেখানে এই দুঃসময়ে প্রকৃত অবস্থার আরো অনেক বেশি অবনতি হইবে তাহাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নাই।
দূর্ভিক্ষের কারণ
১৯৬৬ সাল হইতে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে খাদ্যশস্য উৎপাদনের গড় পরিমাণ ছিল বার্ষিক ১০৮ লক্ষ টন। এই উৎপাদিত পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় কম ছিল বলিয়া বার্ষিক ১২ লক্ষ টন খাদ্য শস্য আমদানী করিতে হইত।
১৯৭০-৭৫ সালের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পায় খাদ্য উৎপাদন বাড়াইবার জন্য পরিকল্পনা নেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু বাস্তবে এই উৎপাদন আরো কমিয়াছে।
ডাঃ রোড এই সম্পর্কে মার্কিন সরকারী তথ্যের উদ্ধৃতি প্রদান করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সাহায্য বিভাগের সংগৃহীত তথ্য উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন এই বৎসর প্রায় ২৩ লক্ষ টন খাদ্য শস্য আমদানীর প্রয়োজন। সংক্ষেপে বলা যায় ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পর বর্তমানে সে ধরণের খাদ্যাভাবের আশঙ্কা দেখা দিয়াছে এইরূপ সাংঘাতিক অবস্থা আর কখনো দেখা যায় নাই। ডাঃ রোড বলিয়াছেন, কম করিয়া ধরিলেও প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ আসন্ন দূর্ভিক্ষের সময় অনাহারে মৃত্যুবরণ করিতে বাধ্য হইবে।
কৃষকদের পলায়ন
বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার এই নাজুক পরিস্থিতির কারণ খুঁজিতে খুব বেশি দূর যাওয়ার প্রয়োজন নাই। হাজার হাজার কৃষক পাকিস্তানী সৈন্যদের অত্যাচারে, নির্যাতনে অতিষ্ঠ হইয়া ঘর, বাড়ি ভিটা- মাটি ছাড়িয়া পলায়ন করিয়াছে— আশ্রয় লইয়াছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। অন্যদিকে অধিকৃত এলাকায় কোথাও কোনরকম স্বাভাবিক কর্মতৎপরতার বিন্দুমাত্র আভাষ নাই। ব্যবসা-বাণিজ্য, কাজকর্ম অফিস আদালত সব কিছুই কার্যত বন্ধ রহিয়াছে। সমগ্র এলাকায় নিদারুণ অর্থনৈতিক সঙ্কট প্রতিদিন স্পষ্টতর হইয়া উঠিয়াছে। চাউলের মূল্য প্রতিদিন তীব্র গতিতে বৃদ্ধি পাইয়া চলিয়াছে।
ডাঃ রোড জাতিসংঘের সাহায্য সংস্থার বিবরণ উদ্ধৃত করিয়াছেন। এই বিবরণে বলা হয় বাংলাদেশে দূর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য জরুরী ভিত্তিতে ২৯ লক্ষ টন খাদ্য শস্য আমদানীর প্রয়োজন। কিন্তু খাদ্য আমদানী সম্বব হইলেও খাদ্য শষ্যের বিতরণ ব্যবস্থা সম্ভব হইবে না। যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত হওয়ার ফলে অধিকৃত এলাকায় খাদ্যশস্য বিতরণ সম্পূর্ণ অসম্ভব। চট্টগ্রামসহ অন্যান্য সব কয়টি-বন্দরে নৌ কাজ প্রায় বন্ধ রহিয়াছে। বন্দরে যে সব শ্রমিক কাজ করিত তাহাদের বেশির ভাগ কাজ ছাড়িয়া পলায়ন করিয়াছে এবং অদূর ভবিষ্যতে কোন বন্দরের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসী গেরিলা ইউনিটগুলির ক্রমবর্ধমান তৎপরতার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যতঃ স্তব্ধ হইয়া পড়িয়াছে।
বাংলাদেশের শতকরা ৯০ জন লোক গ্রামাঞ্চলে বাস করে। ইতিমধ্যে এই সংখ্যা আরো বাড়িয়াছে। শহরসমূহের অর্ধেকেরও বেশী লোক গ্রামাঞ্চলে চলিয়া যাওয়ায় অধিকৃত এলাকার শহরসমূহ জনশূন্য হইয়া পড়িয়াছে।
এতদ্সত্ত্বেও ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী যদি খাদ্য বিতরণের ভার নেয় তাহা হইলে গেরিলাদের আক্রমণাত্বক দুঃসাহসিক তৎপরতায় তাহা ব্যর্থ হইতে বাধ্য।
ডাঃ রোড বাংলাদেশের এই দূর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানাইয়াছেন। তিনি বলেন, জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে যদি খাদ্য বন্টন করা যায় তাহা হইলে হয়তো এই বৃহৎ বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। ডাঃ রোড সাবধান বাণী উচ্চারণ করিয়া বলেন, সময় অত্যন্ত কম। জরুরী বিষয়রূপে বিবেচনা করিয়া অগ্রসর না হইলে বিশ্ববাসী অচিরেই ইতিহাসের বৃহত্তম বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করিবেন।
টরোন্টোর এই সম্মেলনে বাংলাদেশের দখলকৃত এলাকার যে ভয়াবহ চিত্র বিশ্ববাসীর সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়াছে তাহার প্রতি যথোপযুক্ত মনোযোগ দেওয়া না হইলৈ বাংলাদেশে ইতিহাসের বৃহত্তম গণহত্যার পর, ইহা হইবে আরো এক বিরাট গণহত্যা। ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী অবিলম্বে বাংলাদেশ হইতে চলিয়া না গেলে এই অবস্থার বাস্তব কোন পরিবর্তন ঘটিবে বলিয়া আশা করা যায় না।
নীরব দর্শক?
প্রশ্ন করা যায় বাংলাদেশের এই অবস্থায় বিশ্ববাসী কি নীরব দর্শকেরা গ্রহণভূমি করিবে?
জল্লাদ ইয়াহিয়ার দস্যু সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে ধরণের গণহত্যা ও নির্যাতন চালাইয়া যাইতেছে একমাত্র মধ্যযুগের বর্বরতা ছাড়া বিংশ শতাব্দীতে ইহার দ্বিতীয় নজীর নাই।
বিশ্ব বিবেক অন্ধ ও হৃদয়হীন না হইলে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের উচিত বাংলাদেশের মাটি হইতে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করিতে ইয়াহিয়াকে বাধ্য করা এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে আপন অধিকারের শান্তিতে বাঁচিয়া থাকিবার সুযোগ দেওয়া।-লন্ডন টাইমস
বাংলার বাণী ॥ ৩ সংখ্যা ॥ ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন