You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.11 |  বিদেশী সাংবাদিকের দৃষ্টিতে ঢাকা নগরী | জয় বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

 বিদেশী সাংবাদিকের দৃষ্টিতে ঢাকা নগরী

২৫শে মার্চ, সেই ভয়াল রাত্রিতে ঢাকা নগরী থেকে যে সব বিদেশী সাংবাদিককে বের করে দেওয়া হয় তাদের মধ্যে আমেরিকার বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা টাইম-এর সংবাদদাতা ডান কগিনও ছিলেন। ঢাকার নারকীয় হত্যাকান্ডের কোন খবর যাতে বাইরে বিশ্বের মানুষ না জানতে পারে, একথা ভেবেই জঙ্গীশাহী ঢাকায় থাকতে দেননি কোন বিদেশী সাংবাদিককে। সর্বপ্রকার খবরের উপর পাকিস্তান সরকার চেয়েছিলেন নিষেধাজ্ঞার কালো পরদা টাঙ্গিয়ে দিতে। সারা পৃথিবীর মানুষকে বোকা বানাতে। তাদের নাদীরশাহী অত্যাচারের কুকীর্তি ঢেকে রাখতে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। একাধিক সাংবাদিক মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে পরে সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়েন বাঙলাদেশের মধ্যে; সংগ্রহ করে আনেন এবং এখনও আনছেন নানা খবর। আর এই সব খবর সৃষ্টি করছে বিশ্ব জনমত। ধিক্কার উচ্চারিত হচ্ছে ইয়াহিয়া সরকার ও তার জঙ্গী চক্রের বিরুদ্ধে। টাইম পত্রিকার সাংবাদিক ডান কাগিন পশ্চিম বাঙলা থেকে হুন্ডায় চড়ে প্রবেশ করেন বাঙলাদেশে। তারপর বাসে, ট্রাকে, সাইকেলে চেপে পৌছান ঢাকা সহরে। সেখান থেকে আবার খবর সংগ্রহ করে ফিরে আসেন ভারতে। তিনিই প্রথম মার্কিন সাংবাদিক যিনি ঢাকায় গিয়ে নিজে চোখে দেখে বাইরের বিশ্বে ইয়াহিয়া শাহীর কুকীর্তির কথা বিশ্ব সমক্ষে তুলে ধরেছেন।

কগিন লিখেছেন
ঢাকা এখনও মৃত নগরী। সামরিক আক্রমণের এক মাস পরেও সরকারি দপ্তরে, অফিস আদালত কিছুই চালু করা সম্ভব হয়নি। কত লোক মারা গিয়েছে তার হিসাব এখনও দেওয়া চলে না। হাজার হাজার লোক নিহত হয়েছে সামরিক আক্রমণে। ঢাকা সহরের অর্ধেক কি তার বেশী লোক পালিয়ে গিয়েছে সহর ছেড়ে। সহরে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে দারুণ ভাবে। সহরের ১৮টি বাজারের মধ্যে ১৪টি পুড়িয়ে দিয়েছে পাক সামরিক বাহিনী। যে সব পথে একসময় মানুষের ভিড়ে পথ চলা দায় হত, সে সব পথ আজ প্রায় জনশূন্য। বিজন পথে, পথ চলতে ভয় করে। সহরের বাড়ীগুলির মাথায় মাথায় উড়ছে পাকিস্তানের পতাকা। অনেক স্থানেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে জিন্না এমনকি ইয়াহিয়া সাহেবের বড় বড় ছবি। কিন্তু এসবই বাহ্যিক। প্রত্যেকটি বাঙালীর মনে জ্বলছে আগুন। তারা মনে করছেন, যুদ্ধে তাদের হার হয়নি। তারা আপাতত পিছিয়ে গিয়েছেন মাত্র। একজন বাঙালী আমার কথার উত্তরে বলল, “আমরা ভুলে যাব না কখনও এই স্মৃতি। আমরা কখনও ক্ষমা করবো না ওদের।”
আমি সাংবাদিক একথা জানতে পেরে সহরের অনেকে আমাকে নিয়ে চলল দেখাতে সেই সমস্ত স্থানগুলি, যেখানে মাটিতে খাদ খুড়ে দেওয়া হয়েছে বহু লোককে কবর। আমি জানতে পারলাম, ধর্ম প্রাণ মানুষও রেহাই পাইনি হত্যাযজ্ঞ থেকে। মসজিদ থেকে জুম্মার নামাজ পড়ে বের হবার সময় গুলি করে মারা হয়েছে বৃদ্ধকে। সেনা বাহিনীকে বোঝান হয়েছে বাঙালী মুসলমানকে গুলি করে হত্যা করবার মধ্যে কোন অপরাধ নেই, বরং সওয়াব হবে। কারণ বাঙালী মুসলমানরা আসলে ছদ্মবেশী হিন্দু। শুধু এই নয়, ঢাকায় একাধিক নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ৫০০ ছাত্রকে মেরে ফেলা হয়েছে।
সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে পুরান ঢাকার। সেখানেই ঘটেছে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ ও জঘন্য হত্যাকাণ্ড।। পুরান ঢাকার একাধিক অংশ বাড়ীতে পেট্রল ঢেলে তার উপর গোলা ছুড়ে ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন। মানুষ যখন বাইরে পালাতে যায়, তখনই তাদের উপর মেশিন গান থেকে গুলি ছোঁড়া হয়।
কিন্তু তথাপি মানুষের মনোবল ভেঙ্গে যায়নি। যেখানেই আমি গিয়েছি সর্বত্র লক্ষ্য করেছি মানুষের অবাক করা মনোবল। তাদের সকলেরই এক প্রতিজ্ঞা কি ভাবে পাক বাহিনীকে উৎখাদ করে দেশকে চিরতরে মুক্ত করা যাবে;
কগিন মন্তব্য করেছেন, বর্ষাকাল আসছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে দেখা দিয়েছে ভয়ঙ্কর সংকট। ইসলামাবাদকে হয়ত বুঝতে হবে, কেবল গায়ের জোরে একতা রক্ষা করা যায় না এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ ঠিক এমনি পাকিস্তানের কথা কখনও চিন্তা করেননি। (টাইম, ৩রা মে,
১৯৭১)
জয় বাংলা ॥ ১: ১ ॥ ১১ মে ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন