You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.08 | বিদেশীর চোখ: আজকের ঢাকা অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে এক নিষ্প্রাণ নগরী | আনন্দবাজার - সংগ্রামের নোটবুক

বিদেশীর চোখ আজকের ঢাকা অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন
বুকে নিয়ে এক নিষ্প্রাণ নগরী

‘আমার চোখের সামনে এক নিষ্প্রাণ নগরী, তার সারা দেহে গভীর ক্ষতচিহ্ন, রক্তের দাগ নিতান্তই খুড়িয়ে খুড়িয়ে সে স্বাভাবিক জীবনের দিকে ফিরে যাবার চেষ্টা করছে।’
ঢাকা থেকে শুক্রবার এ কথাই লিখে পাঠিয়েছেন অ্যাসোসিয়েটড প্রেস-এর সংবাদদাতা শ্রী রোজেনরুম। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হবার পর এই প্রথম একদল বিদেশী সাংবাদিককে ঢাকা শহর দেখার সুযোগ দেওয়া হল।
সরকারী আতিথ্যে ও সরকারী উদ্যোগে বিদেশী সাংবাদিকরা ঢাকা শহর দেখানো হয়। সামরিক প্রশাসক টিক্কা খান তাঁদের এক ভোজসভায় আপ্যায়িত করেন।
এদের মধ্যে ছিলেন সংবাদসংস্থা ‘রয়টার’ ও ‘এ পি-র’ প্রতিনিধি, লন্ডন ‘ফিনানসিয়াল টাইমস’,‘নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিন’ এবং ‘নিউ চায়না নিউজ এজেন্সীর’ প্রতিনিধিরা, সংখ্যায় মোট ছয়জন।
পাকিস্তান-বিরোধী প্রচার কার্যে বিভ্রান্ত না হয়ে ‘ঘটনাস্থলে এসে সরেজমিনে তদন্ত করতে’ সাংবাদিকদের অনুরোধ জানানো হয়েছিল।
প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, ‘আপনাদের পাঠানো কোন সংবাদের ওপরই সেনসরে ধরা পড়বে না, যা দেখবেন, তাই রিপোর্ট করবেন।’
ঢাকা থেকে ‘রয়টারের প্রতিনিধি রিপোর্ট’ করেছেন। বাংলাদেশের বিদ্রোহ বা বিপ্লব উচ্ছেদ করার জন্য পাক সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঠিক ছয় সপ্তাহ আগে। কিন্তু, আজও ঢাকার বিমানবন্দরে সৈন্যরা বিমান-বিধ্বংসী কামান আকাশের দিকে তাক করে পরিখায় অবস্থান করছে। করাচি থেকে জেট বিমানে করে ঢাকা বিমানবন্দরে নামবার কালে সৈন্যদের সদ্যসতর্ক প্রহরা চোখে পড়ল। নিকটেই একটি রেডার ঘাঁটিও দেখলাম।
বিমানবন্দরের আশেপাশে জনশূন্য কতকগুলি ভাঙা বাড়ি। বিমানে বসেই আমাদের পথপ্রদর্শক পাকিস্তানি সরকারি কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, লোকগুলি গেল কোথায়?
জবাব: সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা পুন:প্রতিষ্ঠাকল্পে রাস্তায় নেমে আসার আগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
রোজেনব্লুম তাঁর বার্তায় বলেছেন: যে দিকেই তাকাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি, অর্থনৈতিক বিপর্যয় সারা শহরটিকে দীর্ঘকালের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছে।
সামরিক প্রশাসক লেঃ জেনারেল টিক্কা খানকে সে কথা বলতেই তিনি স্বীকার করলেন, সব দিকে অবস্থা অনুকূল থাকলেও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে অন্তত এক বছর লেগে যাবে।
রোজেনরুম আরও জানাচ্ছেন: ঢাকায় সেনাবাহিনীর পূর্ণ কর্তৃত্ব রয়েছে কিন্তু কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ-পাট দোকান ও ঘরবাড়ি আজও বন্ধ রয়েছে। কিন্তু সেগুলির ওপরে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে, একটি দুটি নয়, হাজার হাজার পাকিস্তানি পতাকা। কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কোনো উৎসুক মন আগ্রহ বশে সেগুলি তুলি দেয়নি, সংকোচের সঙ্গে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেগুলি ওড়ানো হয়েছে।
ঢাকার গণহত্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে টিক্কা খান বললেন: এ কথা আপনাদের জানাতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু, সত্যই এক ব্যাপক হত্যালীলা ঘটে গিয়েছে— এই হত্যায় বলি হয়েছেন যাঁরা পাকিস্তানের সমর্থক, যাঁরা সরকারের সমর্থক- সোজা কথায়, বাঙালীরা অবাঙালীদের হত্যা করে নৃশংস উল্লাসে মেতে উঠেছিল।
টিক্কা খান বলেন: বহু ছাত্রও নিহত হয়েছেন। কিন্তু, ব্যাপারটি বুঝে নিন। ছাত্রদের হাতের অস্ত্র ফেলে দেবার জন্য অনুরোধ-উপরোধ জানানো হলে ছাত্ররা তাতে কর্ণপাত করল না। পালটা গুলি চালালো সৈন্যদের ওপর। নিতান্ত বিপন্ন হয়েই সৈন্যরা ছাত্রদের ওপর আঘাত হানতে বাধ্য হলো। প্রথম রাত্রেই একমাত্র ঢাকা শহরে প্রায় দেড় শত বিদ্রোহী বাঙালী নিহত হলো।
নির্দোষ নর-নারীকে হত্যা করা হচ্ছে শুনেই সৈন্যরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল, কিন্তু বিশ্বাস করুন, তার আগে পূর্ব পাকিস্তানের কারও গায়ে একটুও আঁচড় লাগতে দেওয়া হয়নি।
একটি ঘটনার কথা শুনুন। পাঁচ শত অবাঙালীকে একটি ঘরের মধ্যে পুরে তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। একজনও রক্ষা পাননি।
রোজেনব্লুম বলেছেন: ঢাকার দশ লক্ষ অধিবাসীর- যাদের সর্বদাই রাস্তায় ভিড় করে থাকতে আমি আগে দেখেছি- একটি নগণ্য অংশই আজ শহরে রয়েছে। ঢাকা রেস কোর্সের সবুজ ঘাসের আস্তরণের মধ্যে রমনা কালীবাড়ি ঘিরে যে হিন্দু পাড়াটি ছিল, আজ সেখানে কতগুলি দগ্ধ ও বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। সেই শ্মশানভূমির আকাশে কতগুলি কাক, নিচে পোড়াবাড়ির গা ঘেঁষে কয়েকটি শিশু দাঁড়িয়ে আছে, মনে হলো, তারা নতুন ভিখারী। ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের পাশেই সৈন্যদের বিবর-ঘাঁটি দেখতে পেলাম। আজ বাহিরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান কেন্দ্র এই বিমানবন্দর। বিদ্রোহীরা চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ঢাকার রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।
রোজেনব্লুম বলছেন: আমরা দুজন সাংবাদিক সরকারী ব্যবস্থার সুযোগ না নিয়ে নিজেরাই একখানা ট্যাকসি ডেকে বেরিয়ে পড়লাম শহরের পুরোনো মহল্লা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্য যে সকল স্থানে লড়াই চলেছিল, সে দিকেই। নবাবপুর রোড ধরে ট্যাকসি ছুটে চলছে, পথের দু’পাশে দগ্ধ, অর্ধদগ্ধ ও বিধ্বস্ত গৃহের দীর্ঘ সারি।
একজন বাঙালীকে এ নিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন: গভরমেন্ট যে কী করেছে, তাই দেখে যান। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আপনার দেশের গর্ভমেন্ট এমন নীরব কেন? এখনও বুড়িগঙ্গায় মৃতদেহ ভাসছে। বুড়িগঙ্গার সে জায়গাটিতে আমাদের দুজনকে নিয়ে যাবার অনুরোধ তিনি মানলেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভবনটি বহুলোংশেই অক্ষত রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ছাত্রাবাসের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণের স্বাক্ষর আজও রয়েছে।
জগন্নাথ হলের প্রাচীরে এখনও কামানের গোলায় চিহ্ন রয়েছে। ভস্মীভূত কক্ষগুলি উন্মুক্ত আকাশের দিকে হা করে আছে।
‘ইকবাল হল’–এর সব কয়টি ক্ষতচিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু মোছা যায়নি। তার সারা দেহ জুড়েই কেবল বুলেট ও কামানের গোলার দাগ।
যেদিকে তাকাই, পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। ব্যাপারটি প্রথমে বুঝতে পারিনি। একজন বাঙালীকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন: পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে জান মান-ধনসম্পদ বাঁচাবার ওই একটি মাত্র পথই রয়েছে এবং সেটি হল, পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে দেওয়া।
জেনারেল টিক্কা খান বললেন: সারা পূর্ব পাকিস্তান আজ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যদিও ভারতীয়দের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা সর্বদাই থেকে যাচ্ছে।
দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা লড়াইয়ের সম্ভাবনাও রয়েছে, যদিও সেটা ঠিক এ মুহূর্তেই আরম্ভ হবে বলে মনে হয় না। টিক্কা খান আরও বলেন: ঢাকার ৫ শত অ-বাঙালীকে একটি বাড়িতে পুরে আগুনে পুড়িয়ে মারছিল, কিন্তু বদলা নেওয়া হতে পারে আশঙ্কায় সে সংবাদ পশ্চিম পাকিস্তানিদের কানে পৌঁছানো হয়নি কামান দাগিয়ে ছিলাম বলেই না বিদ্রোহীদের আস্তানা থেকে বের করে আনা সম্ভবপর হল।
ঢাকার প্রত্যহ রাত্রি সাড়ে দশটা থেকে ভোর ৪-৩০ মি: পর্যন্ত কারফিউ রয়েছে। টিক্কা খান এই ‘সুসংবাদ’ ঘোষণা করেন যে, পয়গম্বরের জন্মদিন উপলক্ষে দু’দিনের জন্য কারফিউ বেমালুম তুলে নেওয়া হচ্ছে। এ উপলক্ষে জনসভা ও শোভাযাত্রার অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে।
দৈনিক আনন্দবাজার, রয়টার, এ পি ৮ মে ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন