You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভুরুঙ্গামারির পাকি বন্দি শিবিরে
(নিজস্ব প্রতিনিধি)

নভেম্বরের ১৪ এবং ১৫ তারিখে রংপুর জেলায় মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকি ফৌজের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে তীব্র সংঘাত ঘটে গেছে। রংপুরের বহু অঞ্চল এখন মুক্তিবাহিনী পুনরুদ্ধার করেছেন। ভুরুঙ্গামারি হচ্ছে সেরকম একটি শহর। ছোট্ট এই শহরে শান্তি এবং সমৃদ্ধি ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি অত্যাচারের পর তার চেহারাই এখন পালটে গেছে। একে যেন হতচেতন অবস্থা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এখানকার তরুণ-তরুণী, অসহায় গৃহবধূ এবং বৃদ্ধ ও শিশুদের ওপর যে অত্যাচার পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২৪তম ব্যাটেলিয়ন চালিয়েছিল তার বিস্তৃত বিবরণ এখন মুক্তিবাহিনী জানতে পারছেন।
ভুরুঙ্গামারিতে স্বাধীনতা যোদ্ধাদের প্রতিটি ইঞ্চির জন্যে লড়াই চালাতে হয়েছে। প্রতিটি পাকিস্তানি ঘাঁটিকে স্তব্ধ করে জনমানবশূন্য রাস্তা ধরে এগোতে লাগলেন তাঁরা। মনে হয় শ্মশানপুরী হয়ে গিয়েছে এই ছোট শহর। মাঝে মাঝে রাজাকার আর পাকিস্তানি দালালদের মুখোমুখি হলেন তাঁরা। শেষে একটি ছোট দুর্গসদৃশ পাকিফৌজী নিবাসে এসে তাঁদের বাঁধা পেতে হলো। পাকিস্তানিরা হালকা ও অন্যান্য ধরনের মেশিনগান থেকে গুলি চালাতে লাগলো। কিন্তু স্বাধীনতা যোদ্ধারা মর্টার ও মেশিনগান থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছোলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাপ্টেন সাহেব পালাতে গিয়ে স্বাধীনতা যোদ্ধাদের হাতে নিহত হলো এবং লেফটেন্যান্টকে বন্দি করা হলো। পঁচিশ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হলো।
মুক্তিফৌজ অতঃপর সেই দুর্গসদৃশ্য বাড়িতে ঢুকে হতবাক হয়ে গেলেন। একটি ঘরের তালা খুলে তাঁরা প্রায় পঁচিশজনের মতন অর্ধোলঙ্গ নারীকে দেখলেন, তাঁদের মধ্যে দশ, এগারো থেকে চল্লিশ, পঁয়তাল্লিশ বছরের সকলেই আছেন। নানা অত্যাচারে তাঁদের মধ্যে অনেকেই স্থৈর্য হারিয়ে ফেলেছেন। সেই বাড়িটির প্রায় একশ গজ দুরের একটি স্কুলঘরে তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া গেল বদ্ধ, রুগ্ন এবং শিশুদের। বন্দি নারীদের কাছে মুক্তিবাহিনীর তরুণেরা যে অত্যাচারের বর্ণনা শুনেছেন। তা পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছালে তাঁরা ভয়ে শিউরে উঠবেন।
স্থানীয় মাদ্রাসা শিক্ষক আবদুল লতিফের অল্প বয়স্কা স্ত্রী তাঁর স্বামীর কাছ থেকে প্রায় ন’মাস বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছেন। লতিফ সাহেব গ্রামে এক জন পবিত্রচেতা ব্যক্তি বলে পরিচিত এবং কোরানের শিক্ষাই তাঁর কাছে একমাত্র ধ্যানজ্ঞান- অথচ তিনি পাঞ্জাবী অফিসারের হাতে স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে রাজি হননি বলে শিশুপুত্রকে ও তাঁকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় এবং স্ত্রীকে ক্যাপ্টেন আতাউল্লার ঘরে জোর করে নিয়ে আসা হয়। স্বাধীনতা যোদ্ধারা তাঁকে মুক্ত করার পর তিনি কনিষ্ঠ পুত্রটির সঙ্গে মিলিত হয়েছেন।
এগারো বছরের বালিকা জমিলা খাতুনের ওপর যে অত্যাচার পাকফৌজ চালিয়েছে তার কোন তুলনা নেই। সে তার মায়ের সঙ্গে থাকতো। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সেনানিবাসে। কিন্তু মুক্তিফোজের ভুরুঙ্গামারি দখলের পর তার দুঃস্বপ্নের রাত্রিগুলো দূর হলো।
আর একজন অন্তঃস্বত্ত্বা নারী আমিনা খাতুনেরও ওপর পাঞ্জাবী দুষমনেরা … রেহাই দেয়নি। তাঁর পেটে লাথি মারা হয়: তিনি মৃত সন্তান প্রসব করেন। সেনাবাহিনী প্রতিদিন রাত্রে তাঁর ওপর পাশবিক অত্যাচার করে।
পুরুষ বন্দিদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় এবারুদ্দিন মণ্ডলের কথা। তিনি তাঁর স্ত্রীকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতে না চাওয়ায় এবারুদ্দিনের দুটি পা ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হয়। সৌভাগ্যবশত, তাঁর স্ত্রী জঙ্গলের মধ্যে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন। ভুরুঙ্গামারি পুনর্দখলের পর খবর পেয়ে তিনি স্বামীর কাছে ফিরে আসেন। এই অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে প্রায় পাঁচ হাজার অধিবাসী সীমান্ত পেরিয়ে চলে যেতে বাধ্য হন। হানাদারেরা বন্দিদের খাবার বন্ধ করে দিয়েছিল, দিলেও অল্পই দিত। শিশু এবং বৃদ্ধদের বাঙ্কার খোঁড়া, জায়গা পরিষ্কার করা বা জ্বালানী কাঠ কাটার কাজে বাধ্য করা হত। তাদের কৃষির কাজ করতে দেওয়া হতো না। ফলে ধান না কাটার জন্যে কয়েক’শ একরের শষ্য সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।
আজ মুক্তাঞ্চলগুলোতে শুধু ফাঁকা ক্ষেতগুলো পড়ে আছে। পাট বা ধান নেই। হানাদারেরা একদা সবুজ এই ভূখণ্ড ধর্ষণ করে যেন চলে …।
দৈনিক কালান্তর, ২৬ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!