ভয়বিহ্বল ঢাকা নগরী
এ-পি সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা
কলকাতা, ১৪ এপ্রিল (এ-পি) সাম্প্রতিক রক্তপাতের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা এখন আতঙ্কের নগরী।
পশ্চিম পাকিস্তানের একশ্রেণীর নাগরিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে নির্বিবাদে লুটতরাজ, হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, সৈন্যরা নীরব দর্শকের মত দাঁড়িয়ে সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ দেখে যাচ্ছে। একটি সরকারী দপ্তরের প্রধান সপরিবারে একটি ঠেলাগাড়ি চেপে তার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন। তারা বলেছেন, প্রধানত একটি অবাঙালী প্রধান এলাকায় মৃত্যুভয়কে প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী করে সেখানকার মানুষ কাল কাটাচ্ছেন।
শহরের একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল ধানমণ্ডির একটি বড় আবাসিক স্কুলে আরো কয়েক হাজারের সঙ্গে তারা আশ্রয় লাভ করেছেন। তারা বলেছেন, অন্যরা তাদের চেয়ে একটু কম ভাগ্যবান। কারণ, অনেককেই ক্রমে ক্রমে মেরে ফেলা হচ্ছে। কাউকে কাউকে জীবন্ত কবর দেওয়া হচ্ছে।
হিন্দুদের জবাই করার জন্য বেছে রাখা হয়েছে। শত শত হিন্দুকে মেরে ফেলা হয়েছে। হত্যালীলা চলছে।
সরকারী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের তিন অফিস কর্মচারীর মৃতদেহ গত শুক্রবার নদীর ধারে পড়েছিল। তাদের গুলি করে মারা হয়েছে। ঢাকার এক ইউরোপীয় নাগরিক বলেছেন, ছ’ জনের একটি পরিবার তাদের বাড়ির রাস্তাতেই খুন হয়েছেন। একজন কূটনৈতিক: প্রতি রাতেই গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতাদের খুঁজে ফিরছে সৈন্যের দল।
মুক্ত অঞ্চলের প্রশাসন কর্তৃপক্ষ ঢাকায় পৌঁছে দেবার জন্য এপি’র সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারকে একটি ছোট নৌকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আর পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য একজন গাইড দিয়েছিলেন। সুন্দর জ্যোৎস্নার রাত। ঢাকায় যাবার জন্য সেই নৌকায় চেপে তাঁরা যাত্রা করলেন।
মাঝ দরিয়ায় জলের ওপর আলো পড়ল, শোনা গেল চলমান নৌ-ইঞ্জিনের শব্দ। কিন্ত এ আসল সঙ্কেত ধ্বনি নয়। গানবোট এল না।
পদ্মার পূর্বতীরের গ্রামগুলিতে বাঙলাদেশের প্রতি সুস্পষ্ট সমর্থনের আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু গ্রামবাসীরা ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। তাদের ভয় বিদেশী সাংবাদিকদের সাহায্যে করলে যদি কিছু বিপত্তি ঘটে।
তারা বললেন, “পাকিস্তানি পতাকা ওড়াচ্ছি বটে। কিন্তু অন্তরে আমাদের বাঙলাদেশ বিরাজ করছে। সৈন্যের ট্যাঙ্ক আর বিমানের বিরুদ্ধে আমরা আর কিই বা করতে পারি।”
অনেক পথ ঘুরে, গোলকধাঁধা পেরিয়ে গাধায় টানা গাড়িতে, কখনও বাসে চেপে, কখনও পায়ে হেঁটে সাংবাদিকদ্বয় ঢাকায় পৌঁছলেন।
শত শত লোক এক অজানা আশঙ্কায় প্রতিদিন শহর ছেড়ে যাচ্ছেন। তারা কেউ সাইকেলে, কেউ বা পায়ে হেঁটে, অনেকে বাসে চেপে চলে যাচ্ছেন। প্রত্যেকটি বাস উদ্বাস্ত আর তাদের আত্মীয়স্বজনে ভর্তি।
ঢাকার সবচেয়ে বড় হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল এখন সামরিক কর্তৃত্বে। গোপন ভ্রমণকারীদের পক্ষে আসন জোগাড় করা কঠিন ব্যাপার।
ঢাকায় ইনফমারের ভয় রয়েছে আর বিশ্বাসঘাতকতা একটা স্থায়ী বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্যাক্সি চালকরাও পারতপক্ষে সৈন্যদের এড়িয়ে যাচ্ছে।
সামরিক নিয়ন্ত্রণাধীন ঢাকা শহর থেকে এসোসিয়েটেড প্রেসের সংবাদদাতা ডেনিস নাল্ড দ্বিতীয় কিস্তির সংবাদ পাঠিয়েছেন। সেই সংবাদে উপরোক্ত ঘটনাগুলি ব্যাহত হয়েছে। মৃত্যুপুরী ঢাকা থেকে দু’সপ্তাহ আগে সমস্ত বিদেশী সাংবাদিককে জোর করে বের করে দেবার পর শ্রীনাল্ডেই সর্বপ্রথম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সংগ্রহের জন্য এ শহরে আসেন। শ্রী নাল্ডের সঙ্গে একই সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের ফটোগ্রাফার মাইকেল লরেন্টও ছিলেন। গতকাল তিনি প্রথম কিস্তির সংবাদ পাঠিয়ে ছিলেন।
কালান্তর, ১৫ই এপ্রিল ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন