ঢাকা এখন কবরখানা
(বিশেষ প্রতিনিধি)
আমেরিকান এবং চীনা মেশিনগানের সেই নির্বিচার এবং অফুরন্ত গুলি বৃষ্টি সহসা একটু যেন ক্ষান্ত হলো রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সামনে। সেখানে পুলিশবাহিনী আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। বন্দুকের লড়াই প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় পাঁচশ সৈন্য সেখানে খতম হয়। ওরা ছিল রাস্তায়, আর পুলিশরা লাইনের মধ্যে। কাজেই সামান্য রাইফেলের কাছে বিদেশি মেশিনগানকে হার মানতে হয়েছিল।
কিন্তু তা সাময়িক। পাকিস্তানি বাহিনী অতঃপর ট্যাঙ্ক নিয়ে রাজারবাগ আক্রমণ করে। সেও আমেরিকান আর চীনা ট্যাঙ্ক। পুলিশ লাইন এবং পুলিশ সেই হামলার সামনে দাঁড়াতে পারেনি। বাড়িটা গেছে গুঁড়িয়ে; এবং পুলিশদের অনেকেই মরেছে, সামান্য কয়েকজন পালাতে পেরেছিল।
এখন মনে হয় রাজারবাগে ওরকম প্রতিরোধ গড়ে তোলা ভুল হয়েছিল। ওখানে প্রতিকূল অভিজ্ঞতার সম্মুখীন না হলে ইয়াহিয়ার সৈন্যরা বোধহয় ঢাকার থানাগুলোকে একের পর এক শেষ করে দিত না।
রাজারবাগের ঘটনার পর সৈন্য বাহিনী শহরের থানাগুলোতে আক্রমণ চালায়। একমাত্র লালবাগ থানাটি এই হামলা থেকে রক্ষা পায়, কারণ সেখানে ইয়াহিয়ার দালালরা ঘাঁটি করেছিল। ঢাকা শহরে অতঃপর আর একটি থানাও অক্ষত ছিল না। ইউনিফর্ম পরা পুলিশ কত যে নিহত হয়েছে তার কোনো হিসেব নেই।
সাজাহান সিরাজের ভাষায়: “কোনরকম বিশেষণ দিয়া তাগো পরিচয় দেওন যায় না। তারা কী করছে জানেন?”
শহরের প্রত্যেকটি দমকল-কেন্দ্রে হানা দিয়ে ইয়াহিয়া বাহিনী সেগুলোকে ধ্বংস করে দিল। যত দমকলের কর্মী ছিলেন তাঁদের একজনও বাদ যাননি। প্রত্যেককে গুলি-করে মেরে ফেলা হয়েছে। সিরাজ নিজে ২৬ মার্চ সকালে ইউনিফর্ম-পরা ১০০ পুলিশ এবং তার দ্বিগুণ দমকল-কর্মীর মৃতদেহ এক জায়গায় পড়ে থাকতে দেখেছেন।
রাত্রি প্রায় দুটোর সময় আক্রমণ চলল সদরঘাট স্টেশনে। পুরো চার ঘণ্টারগুলো বৃষ্টির পর স্টেশনে উপস্থিত যাত্রী, পোর্টার এবং অন্যান্য নানা শ্রেণীর লোকের অবস্থাটা কী দাঁড়াতে পারে সেকথা কাউকে বলে দিতে হয় না। আশ্চর্য হবার নয় যে, পরদিন বুড়িগঙ্গা নদীতে শত শত মৃতদেহ ভাসতে দেখা গেছে।
শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবী
২৬ মার্চ ভোরবেলা গুলো বৃষ্টি হঠাৎ থেমে গেল। ভয়ে সন্তর্পণে কিছু কিছু লোক বেরিয়েছে রাস্তায়। চারিদিকে মৃতদেহ। পরিচিত এবং অপরিচিত মুখগুলো। সবাই হাত লাগাল। এক মর্মান্তিক কর্তব্য। অল্পক্ষণের মধ্যে দেখা গেল, মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে হাজার খানেক লাশ জমা হয়েছে।
ততক্ষণে সৈন্যরা এসে গেছে। তাদের কড়া হুকুম: কেউ যেন লাশ সরাবার চেষ্টা না করে। যেখানে যেমন আছে সেখানেই লাশ পড়ে থাকবে। তবু কেউ কেউ মৃতদেহ সরাবার চেষ্টা করেছিল কোথাও কোথাও। যারা তা করতে গেছে মিলিটারির গুলি তাদেরও লাশ বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
এ দিনকার ঘটনাবলী থেকে বোঝা গেল, ইয়াহিয়া বাহিনী আক্রমণের ছক বহু পূর্ব হতেই তৈরি করে রেখেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রদের হস্টেলগুলো এবং তার চারদিকের বাড়ি-ঘরে পাকিস্তানি ফৌজ যে তাণ্ডব চালিয়েছে তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। নামজাদা অধ্যাপক, মেধাবী ছাত্র, সাধারণ কর্মচারী- সবাইকে পরিকল্পনা অনুযায়ী খতম করা হয়েছে। ঢাকার বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রায় কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। এইসব পরিবারবর্গকেও- মায় শিশুদের পর্যন্ত— একেবারে নির্মূল করে দেওয়া হয়েছে।
ইয়াহিয়ার ঔপনিবেশিক যুদ্ধ সুস্পষ্টভাবে শ্রেণীযুদ্ধও। ২৬ মার্চ ঢাকা শহরে এই কথাটির নির্ভুল প্রমাণ পাওয়া গেল।
ঢাকা নগরীকে প্রায় দ্বিখণ্ডিত করে চলে গেছে রেল লাইন। এই রেল লাইনের পাশে বিরাট দুটি শ্রমিক বস্তি। তাতে বাস করতেন চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার লোক।
তখন দ্বিপ্রহর। সহসা দেখা গেল সৈন্যরা এসে বস্তিগুলো ঘিরে ফেলেছে। চারদিক থেকে বস্তিবাড়ি গুলোর ওপর পেট্রল ছিটিয়ে দেওয়া হলো। তারপর তাতে আগুন। আকাশছোঁয়া সেই আগুনের শিখা চোখে না দেখলে তার বীভৎসতা কল্পনা করা যায় না।
আগুন নেভাবার কেউ নেই। দমকলবাহিনীকে আগেই শেষ করে দেওয়া হয়েছে।
বস্তির হাজার হাজার লোক তখন বাইরে। তবু কেউ বাঁচেনি। চারদিকে মেশিনগান। তার গুলির শেষ নেই। উঃ, আর কত যে রক্ত! আল্লাহ!
সাজাহান সিরাজ জানতে চেয়েছিল, এই পৈশাচিকতার কোনো তুলনা আছে কিনা।
এর পর সারা দিন সারা রাত ধরে সমগ্র ওল্ড ঢাকা শহরে নির্বিচারে আগুন লাগানো হতে লাগল। আর অবিশ্রান্ত গুলিবর্ষণ বিরামহীন একঘয়ে। সমস্ত চেতনাশক্তিকে থেঁৎলে থেঁৎলে ভোঁতা করে দেবার মতো।
পালাবারও পথ নেই
২৬ মার্চ সকালে গুলিবর্ষণ থেমেছিল। ঢাকার জীবনন্যূত অধিবাসীরা ভাবলেন, এবার বোধহয় পালিয়ে বাঁচা যাবে। শুরু হলো দলে দলে পালানো। বুড়িগঙ্গার ওপারে জিনজিরা। সবার লক্ষ সেই দিকে। ওখানে গিয়ে যদি বাঁচা যায়।
সকলের ভাগ্যে তাও জুটল না। সকাল এগারোটার সময় নদীতীরে ফৌজ এল। এবং সঙ্গে সঙ্গে গুলি। যারা পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল তাদের অনেককেই ফিরে আসতে হলো ঢাকা, যা তখন নরক ছাড়া আর কিছু নয়। অন্যদের লাশ বুড়িগঙ্গার পারে ছড়াছড়ি। বহু জলেও ভেসে গেল।
নদী পার হবার সব পথ বন্ধ। মেশিনগান হাতে সৈন্যরা পথ আটকে রেখেছে। বন্দি মানুষগুলো ঢাকায় বসে অবধারিত মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতে লাগল।
খুব বেশি দেরি করতে হয়নি। সারা রাত জুড়ে আবার সেই পৈশাচিক তাণ্ডব। সেই আগুন। আর নির্বিচার গুলি বৃষ্টি।
আক্রোশটা বেশি সেইসব অঞ্চলের ওপর যেখানে লোকেরা শেখ মুজিবকে ও তাঁর দলকে খুব বেশি ভোট দিয়েছিল। যেমন শাঁখারি পট্টি। সেখানে মুজিব চার হাজার ভোট পেয়েছিলেন, আর তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছিলেন তিনটি ভোট। ইয়াহিয়া বাহিনী এমন ব্যবস্থা করল যাতে এই শাঁখারিপট্টিতে আর একটিও ভোট না পড়ে কোনোদিন।
একটা অসম্ভব নারকীয় বীভৎসতা। এক-একটি এলাকা ধরে তা পরিকল্পিতভাবে শেষ করে দেওয়া। একটি জীবনও যাতে সেখানে অবশিষ্ট না থাকে। এই ভয়ঙ্কর ব্যাপারই ঘটেছে ঢাকা জুড়ে।
২৮ মার্চ সৈন্যরা আবার গুলি বন্ধ করল। সহসা মনে হলো ঢাকা প্রায় স্বাভাবিক।
দোকান লুটের নাটক
সেনাবাহিনী যেন সহসা সন্ন্যাসী ফকির হয়ে গেছে। এমন ভাবখানা। রাস্তায় বাজারে অল্প কিছু লোকজনও এসেছে। সৈন্যরা খুব-যেন সদাশয়। কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
অদ্ভুত একটা কৌশলে সৈন্যরা লোকদের ভিড় তৈরি করে ফেলল শহরের বড় বড় দোকানের সামনে। সহসা দেখা গেল, সেই লোকেরা আসলে বন্দি। তাদের ঘিরে চারদিকে মেশিনগান আর রাইফেল। একদল সৈন্য দোকানগুলো ভেঙে ফেলল। তারপর সেই বন্দিদের হুকুম দেওয়া হলো: এবার দোকানের সব জিনিস লুট করো।
প্রাণের ভয়ে নিরুপায় সেই লোকেরা তখন দোকান “লুট” করতে লাগল। ফৌজের ক্যামেরাম্যানরা তৈরি ছিল। তোলা হলো ছবি। এখন ইয়াহিয়া সরকার এইসব ছবি হয়তো দেখাবে, বিদেশে, বাঙলাদেশের গণআন্দোলনকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য। এবং হয়তো বা নির্বিচার গুলি চালানোর অজুহাত হিসাবে।
শুধু একদিন নয়, এই কাণ্ড ঢাকা শহরে চলেছে ৩১ মার্চ পর্যন্ত। সৈন্যবাহিনী এইসব লুটের মাল নিয়ে লোকদের নৌকো বোঝাই করে পাঠিয়ে দিয়েছে ওপারে, জিনজিরায়। সেখানে অবশ্য এসব পৌঁছতে পারেনি। দেশপ্রেমিক যুবকরা মালভর্তি নৌকো বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে দিয়েছে। মুক্তি আন্দোলনে কলঙ্ক স্পর্শ করতে দিতে তারা কোনো প্রকারেই প্রস্তুত নয়।
ঢাকা তখন “স্বাভাবিক”। আর সৈন্যরা ব্যভিচারে মেতে উঠেছে। সম্পন্ন যেসব পরিবার তখনো নগরীর নানা অঞ্চলে রয়েছেন, তাঁদের বাড়িতে বাড়িতে হামলা চলল নিয়ম করে। সে এক বর্ণনাতীত বীভৎস নারীমেধের নির্মম কদর্য ইতিহাস।
গুলিও চলছে। তবে নির্বিচারে নয়। রাজনীতির সঙ্গে দূরতম সম্পর্কও যাদের আছে তাদের বাঁচতে দেওয়া হয়নি।
এপ্রিল মাসের দুই তারিখ নাগাদ জিনজিরায় আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা বিপুল হয়ে উঠেছিল। ১০ মাইল দূরের গ্রামেও বহু লোক আশ্রয় নিয়েছেন। এই আশ্রয় প্রার্থীদের সাহায্য গ্রামের সর্বশ্রেণীর লোক যেভাবে এগিয়ে এসেছিল তার বর্ণনা দেবার সময় সাজাহান সিরাজের দুই চোখ জলে ভরে উঠল। সর্বস্ব হারানোর পর এই বিপুল প্রাপ্তি –এ জিনিস সারা জীবনে ভুলবার নয়।
কিন্তু পাকিস্তান বাহিনী এই নতুন তাৎপর্যপূর্ণ মৈত্রী সংহত হতে দেয়নি। আগেই খবর পাওয়া গিয়েছিল স্পিড বোটে করে সৈন্যরা নদীতে টহল দিচ্ছে। ৩ এপ্রিল সকালবেলা থেকে জিনজিরার সর্বত্র মেশিনগান চালিয়ে ধ্বংসের অভিযান চলতে লাগল। পরিণতির কথা বলা নিষ্প্রয়োজন। কত হাজার পরিবার যি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তার হিসেব দেওয়া সম্ভব নয়।
এর পরবর্তী ঘটনাবলী সিরাজের জানা নেই। ঢাকার নিকটবর্তী কোনো স্থানে থাকা আর সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। কিন্তু এদিকে আসবার পথে ফরিদপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া প্রভৃতি স্থানে মুক্তিক্তফৌজের অধিকার ও শাসন চালু দেখে তার এবং এরকম আরো অনেকের বুক আশায় ভরে উঠেছে।
সাজাহান সিরাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আপনার নাম প্রকাশ করতে আপত্তি নেই তো!”
একটু ইতস্তত করে জবাব দিলেন: “নাম দিতে পারেন। তাগো কাছে কিছুই গোপন নাই। আমরা যে এইখানে আইছি তারা জানে।” তারা মানে ইয়াহিয়ার লোকজন। তাদের সম্পর্কে এই ছাত্রনেতার কোনো মোহ নেই। তারা মানে মৃত্যু। শুধু সিরাজের নয়। সারা বাঙলাদেশের। সাত কোটি মানুষের।
এই মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যই সাজাহান সিরাজ এবং আরো অনেকে আপাতত এখানে। তাদের এই জীবব্রত সাৰ্থক হোক।
সাপ্তাহিক সপ্তাহ, ১৬ এপ্রিল ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন