You dont have javascript enabled! Please enable it!

চিত্র ও নাট্যজগৎ
পূর্ব পাকিস্তানের চলচ্চিত্র

কেউই জানেন না। ফিল্ম সোসাইটিগুলিরও এ সম্পর্কে উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত ছিল।
আজ পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর একটি জন- প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার কায়েম হতে যাচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে, এই সরকার দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী-সম্পর্ক স্থাপনের জন্য সচেষ্ট হবেন। আবার দুই দেশের মধ্যে সংস্কৃতিক ভাব বিনিময় হবে।
সেই ভাবী সম্প্রীতির আশা নিয়ে ভারতীয় চিত্র রসিকদের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের ‘সংবাদ’ পত্রিকা থেকে নিম্নোক্ত লেখাটি ‘৬৯ সালে চিত্রবীক্ষণ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কাজেই সময়কাল একটু পাল্টাতে হয়েছে।
পাকিস্তান চলচ্চিত্র জগতে জহির রায়হান নিঃসন্দেহে একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। তাঁকে নিয়ে এ দেশের চিত্রমোদীদের মনে যত জল্পনা-কল্পনা, আমাদের অন্য কোন চিত্র নির্মাতাকে নিয়ে তা হয় না। এর কারণ একাধিক।
জহির রায়হান আজ পর্যন্ত যতগুলি ছবি করেছেন, তার কোনটার সঙ্গে কোনটার সম্পর্ক আমরা খুঁজে পাইনি। প্রতিটি ছবিতেই তাকে কিছু না কিছু পরীক্ষা- নিরীক্ষা চালাতে দেখা গেছে। জহির রায়হানের প্রথম সৃষ্টি ‘কখনো আসেনি’র কথাই ধরা যাক। এ ছবিটির বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার যুগের জীবন-যন্ত্রণাকে যতখানি গভীর ও মর্মস্পর্শী করে চিত্রিত করা হয়েছে, জহির রায়হানের তো নয়ই, এদেশের অন্য কারো ছবিতেই তা আমরা দেখতে পাইনি। জহির রায়হানের ‘কাঁচের দেয়াল’- এর বক্তব্য, উপস্থাপনাও ছিল পরিচ্ছন্ন-স্বচ্ছ, বলতে পারি কাচের মতই। এ দু’টি ছবিতেই আমরা তাঁকে পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্রের শৈশবকালীন অবস্থান শিল্পমানের ছবি নির্মাণের জন্য পরীক্ষা চালাতে দেখেছি।
জহির রায়হানের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়-এর পরবর্তী সময়ে আমরা পেয়েছি পাকিস্তানের প্রথম রঙীন ছবি ‘সংগম’। এ ছবিটি ছিল পাকিস্তান চলচ্চিত্র জগতে তার একটি দুঃসাহসী প্রচেষ্টা। তখনকার দিনে প্রথম রঙিন ছবি সংগমের যা মান ছিল, তার সমকক্ষ রঙীন ছবি আজ পর্যন্ত এ দেশে তৈরি হয়নি-একথা থেকে এই প্রমাণ হয় যে, তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র দারুণভাবে মার খেয়েছে। ফ্যান্টাসিতেও তার স্বকীয়তা পরিচয় আমরা পেয়েছি ‘বেহুলা’-তে। এরপর জহির রায়হান আনোয়ারা-র মত একটি তৃতীয় শ্রেণীর উপন্যাস নিয়ে একটি প্রথম শ্রেণীর ছবি তৈরি করেছিলেন। চলচ্চিত্রকারের নিজস্ব ভাষা এখানে প্রধান বলেই তা সম্ভব হয়েছে।
এ দেশে স্বল্প সময়ে স্বল্প ব্যয়ে ছবি নির্মাণের যে পরীক্ষা, তাতেও আমরা জহির রায়হানকে সর্বাগ্রে পেয়েছি। তিনি সিনে ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে মাত্র ২০ দিনে ‘দুই ভাই’ ছবিটি নির্মাণ করেন। অবশ্য এ ছবিতে তিনি ছিলেন প্রযোজক। চারজন পরিচালক ছবিটি পরিচালনা করেন। বলাবাহুল্য, এরা চারজন ইতোমধ্যে পৃথক পৃথকভাবে ছবি তৈরী করেছেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে, পরিচালক সৃষ্টিতেও জহির রায়হান সর্বাগ্রে। এসব হচ্ছে জহির রায়হানের অতীত কথা। তা হলে নতুন কথা কি-এই তো? নতুন কথা হচ্ছে, নতুন দুটি ছবি ‘মা’ এবং ‘জ্বলতে সুরজকে নীচে’র মাধ্যমে জহির রায়হান আবার নতুন পরীক্ষায় আত্মনিয়োগ করেছেন। ছবি দু’টি তিনি নিজেই পরিচালনা করেছেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, আনোয়ারার পর এই হচ্ছে তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি। এই সময়ের মধ্যে তিনি মোট ছয়টি ছবি প্রযোজনা করেছেন।
জহির রায়হানের নতুন ছবি দু’টি সম্পর্কে নতুন কথা হচ্ছে, ‘মা’ হচ্ছে বাংলাতে পাকিস্তানের প্রথম রঙীন ছবি। পাকিস্তানের প্রথম রঙীন ছবি ‘সংগম’- এর তিন কৃতী কর্মী এ ছবিতে একত্রে কাজ করেছেন। এঁরা হচ্ছেন-সঙ্গীত পরিচালনায় খান আতাউর রহমান, চিত্র গ্রহণে আফজাল চৌধুরী এবং প্রযোজনা-পরিচালনায় জহির রায়হান। ‘মা’র চরিত্র চিত্রণে রয়েছেন সুচন্দা, রাজ্জাক, ববিতা, বেবী জামান, মুস্তফা এবং রওশন জামিল।
‘জ্বলতে সুরজকে নীচে’ সম্পর্কে নতুন কথা হচ্ছে, এ ছবির বক্তব্যে তিনি নতুন ধরনের পরীক্ষা চালাবেন। সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীতে বৈপ্লবিক চিন্তাধারা নিয়ে ছবিটি তৈরি হয়েছে। আফজাল চৌধুরীর প্রযোজনায় এ ছবির চরিত্র চিত্রণে রয়েছেন-নাদিম, ববিতা, রোজিনা, সাবিহা ও সন্তোষ। নাদিম এ ছবিতে একই সাথে তিনটি চরিত্র রূপায়িত করেন। সুবল দাস সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। সংলাপ ও গীত যথাক্রমে ইমাম ও মসরুর আনোয়ার। কাহিনী, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন জহির রায়হান। অতএব, দীর্ঘদিন পর পরিচালনায় জহির রায়হান বাংলায় প্রথম রঙীন ছবি ‘মা’ এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ছবি ‘জ্বলতে সুরুজকে নীচে’ নির্মাণের যে পরীক্ষায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন, পরবর্তীকালে তা আলোচনা করার ইচ্ছা রইল।
যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা হয়, সেখানে কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির চলচ্চিত্র নিয়ে আমরা বড় একটা মাথা ঘামাই না। এর অন্যতম কারণ হল, দু’দেশের মধ্যের তিক্ততা। কিন্তু যখন ভারতীয় ছবি পাকিস্তানে রপ্তানি হত, তখনও কিন্তু কোন পাকিস্তানি ছবি ভারতে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয় নি। সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক প্রমুখ নাম পাকিস্তানে পরিচিত হলেও ওখানকার কোন চিত্র পরিচালকের নাম এখানকার মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি বাদে প্রায় ..
দৈনিক কালান্তর, ১২ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!