সমর নায়ক ইয়াহিয়া খানের স্বৈরাচারী নির্দেশ
পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকাল স্থগিত
প্রতিবাদে বুধবার পূর্ব বাঙলায় সাধারণ ধর্মঘট
(বিশেষ প্রতিনিধি)
নয়াদিল্লী, ১ মার্চ-পাকিস্তান রেডিও জানিয়েছে, জঙ্গী রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের নব-নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিয়েছেন।
এ সংবাদ পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গেই পাক রাষ্ট্রপতির এই অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান বুধবার গোটা পূর্ব পাকিকস্তান সাধারণ ধর্মঘট করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন যে, আগামী রবিবার তিনি আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের কথা ঘোষণা করবেন। এ সংবাদ ইউ-এন-আই ‘এর।
মনে করিয়ে দেওয়া যেতে পারে যে, বুধবার ৩ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানের নব- নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবার কথা ছিল।
করাচিতে আজ রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান যে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে তিনি বলেছেন যে, “দুঃখ ভরাক্রান্ত হৃদয়ে” তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের নেতাদের মতানৈক্য এবং “পাকিস্তানের প্রতি ভারতের মনোভাবকে” এ জন্য দায়ী করেছেন।
পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থের কাছে ইয়াহিয়া খানের নতি স্বীকার ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এভাবে বানরের পিঠা ভাগ নীতি অনুসরণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাধান্য পূর্ণ সামরিক নেতৃত্বের আধিপত্য গোটা দেশে বজায় রাখার একটি ষড়যন্ত্রও এ সিদ্ধান্তের পিছনে কাজ করছে।
উল্লেখ্য করা যেতে পারে, ১৩ বছর সামরিক শাসনের পর জনগণের চাপে বাধ্য হয়ে সামরিক চক্র জনগণের নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রতিশ্রুতি দিতে বাধ্য হয়। তদনুযায়ী দেশের জাতীয় পরিষদের এবং অঙ্গরাজ্যের যে-নির্বাচন হয় তাতে সম্পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাধিক্য ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬০ টি আসন জয় করেছে। পূর্ব-পাকিস্তান আইনসভাতেও আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাধিক্য আসন পেয়েছে। অন্যদিকে গোটা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারকে আরও শক্তিশালী করার দাবিতে পশ্চিম পাকিস্তানে শ্রী জেড এ ভুট্টো পরিচালিত পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি জাতীয় পরিষদের মাত্র ৮৩ টি আসন এবং পাঞ্জাব ও সিন্ধুর আইন সভাতে সংখ্যাধিক্য আসন লাভ করে।
ইতিপূর্বে দৃশ্যত ইয়াহিয়া খান নিজে এবং পরে ভুট্টো সাহেবও পাকিস্তানের দুই অংশের নেতাদের মধ্যে মতানৈক্য কমাবার জন্য “চেষ্টা” করেছিলেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ ও শাসন করার যে প্রায় একচেটিয়া অধিকার ভোগ করে আসছিল তার অবসান হবে। তাই ভুট্টো সাহেব প্রথমে হুমকি দেন যে, আওয়ামী লীগ যদি তাদের দাবি খর্ব না করে তাহলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে গোটা পশ্চিম পাকিস্তানের কোন সদস্যকেই যোগদান করতে দেওয়া হবে না। তিনি এই হুমকিও দেন যে, যদি “খাকির উদীপরা বা অসামরিক কোন সদস্য ঢাকা অধিবেশনে যোগ দিতে যান তাহলে তিনি তার ব্যক্তিগত দায়িত্বেই ঢাকা যাবেন।”
কিন্তু তাতেও পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব অটল এবং পশ্চিম পাকিস্তানেরও প্রগতিশীল সদস্যরা জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগ দেবেন বলে জানান।
তখন গতকাল ভূট্টো দাবি করেন যে, যদি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মহিলা সদস্যদের নির্বাচন স্থগিত রাখা হয় তাহলে তিনি পূর্বপাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে বিরোধ কমিয়ে আনার জন্য আবার চেষ্টা করবেন।
কিন্তু তা না করে যদি ৩ মার্চ তারিখের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন করা হয় তাহলে খাইবার গিরিসংকট থেকে করাচী পর্যন্ত সর্বাত্মক হরতাল হবে।
তার এই হুমকির অব্যবহিত পর মুহূর্তে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান তাঁর দাবি মেনে এই অগণতান্ত্রিক ঘোষণা করায় এমন মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে, আওয়ামী লীগতে স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে সরিয়ে আনার জন্য ভূট্টো যে চাপ সৃষ্টির নীতি অনুসরণ করছেন ইয়াহিয়া খান তাকেই সবল করতে চান।
দৈনিক কালান্তর, ২রা মার্চ ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন