You dont have javascript enabled! Please enable it!

“Hasina: A Daughter’s Tale” এই গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টারিতে গবেষকদের জন্য অনেক দরকারি তথ্য রয়েছে বিধায় টাইপ করে এখানে সংরক্ষণ করা হল। 

pdf version পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

 
Hasina: A Daughter’s Tale (বাংলা ইউনিকোড)

শেখ হাসিনা: (এখানে এসো।) (পাশে দাঁড়ানো নাতনীকে বলেছেন।) এলাচি দিচ্ছি। আজকে রান্না করছি তোমরাও খেয়ে যাবে। সেজন্য আমি বলছি বেশি করে করতে। ঠিক আছে? কে দেখবে তুমি?

Piplu: আপনার মায়ের কোন রান্না আপনার সবচেয়ে বেশি পছন্দ ছিলো?

শেখ হাসিনা: আমার মা খুব মজার মোরগ পোলাও রানতেন। মাছ রানতেন। তারপর ইলিশ মাছ উনি একটু লবণ মাখিয়ে রেখে তারপর রান্না করতেন। টক দইও খুব মজা হত। আব্বা সব সময় মাছ ভাতটা পছন্দ করতেন বেশি, আবার মুরগির মাংস- টাংস। প্রথম দিকে গরুর মাংস খুব কম ছিল পরে গরুর মাংস খেতেন। মাঝে মাঝে খাসির মাংসর রেজালা। আমার মা খুব
সুন্দর রেজালা করতেন। মার সব রান্নাই একটু আলাদা ছিলো।
(সরাও। না তুমি দেখবা।) (নাতনীকে বলছেন)
মা পোলাও কোরমা যা যা রান্না করার রান্না করে হাঁড়ি ভরে লোক দিয়ে পাঠাতেন। বাস আমরা মেহমানদারি করতাম। আমার জীবনটা ওইভাবেই ছিলো। সব সময় ঐ বাসা থেকে মা-ই সব কিছু পাঠাতেন। কাজেই আমার নিজের খুব বেশি একটা অভিজ্ঞতা ছিলো না।
আমি তো আমার মার বন্ধুর মত ছিলাম। আর মার সাথে আমার বয়সের ডিফারেন্স কিন্তু খুব বেশি না। ফলে মার সমস্ত কথা সব সময় আমার সাথে শেয়ার করতেন।

শেখ রেহানা: এই আমার মা। (মায়ের ছবি দেখাচ্ছেন)। কামাল ভাই পেটে। কত অল্প বয়স। কত আঠারো হবে তখন।

শেখ হাসিনা: রেহানার সাথে আমার মায়ের খুব মিল। সে খুব গোছানো। সব কিছু তার খুব নিয়ম মাফিক। আমি না। আমি হচ্ছি সব থেকে আলসে। আমার একটা হবি ছিলো গান শোনা আর বই পড়া। সারাদিন গান শোনা আর বই পড়া নিয়েই আমি বেশি থাকতাম।

শেখ রেহানা: ওনার ঘরের নামই ছিলো ‘আলসে খানা’। ইউনিভার্সিটিতে যাবেন কোন শাড়িটা পড়বেন ওটা মা রেডি করে রাখতেন। এসে সন্ধ্যাবেলা খাওয়ার ফাঁকে ওইসময় একটা ঘুম।

শেখ হাসিনা: আন্দোলন সংগ্রামেই ছিলাম। কলেজ ইউনিয়নে ইলেকশন করলাম। ভিপি নির্বাচিত হলাম। এটা ঠিক। কিন্তু ঐযে এত বড় একটা দলের সাথে বা নেতৃত্ব দিতে হবে বা কবে মিনিস্টার হবো এসব চিন্তা কোনোদিনই মাথায় ছিলোনা।
আব্বা কিন্তু নিজের কথাগুলো বলতেন যে উনি এদেশটাকে নিয়ে কিভাবে চিন্তা করেন। কী করবেন? কারণ খুব স্বাভাবিকভাবে একটা দেশকে স্বাধীন করতে হলে তার যে পদক্ষেপগুলি হিসেব করে করে নেওয়া এবং সেটাকে সম্ভব করা এটা খুব কঠিন কাজ। কেউ যদি মনে করে খুব সহজে বাংলাদেশটা স্বাধীন হয়ে গেছে এটা কিন্তু না।

শেখ রেহানা: সকাল বেলায় আব্বা বাইরে থাকলে আব্বা মর্নিং ওয়াক করে আসতেন। আমাদের ৩২ নাম্বারের যে বারান্দাটা আমরা ওইখানে আব্বা একটা চেয়ারে – ইজি চেয়ারে – আর আমরা সব মোড়ায় – টোস্ট বিস্কিট – চা – আমরা সবাই খবরের কাগজ পড়ে – যার যার স্কুল কলেজে যাওয়া। এই জিনিসটা আমরা ঐ যে একটা পরিবেশের মধ্যে বড় হওয়া ওইখান থেকে কিন্তু বের হইনাই।

শেখ হাসিনা: আমার আব্বা এতবড় নেতা হলে কী হবে যতোটুকু সময় পেতেন তিনি আদর দিয়ে ভরে রাখতেন। আমি কিন্তু আমার জীবনে ছেলে মেয়ের মা তখনো, কিন্তু আব্বা ভাত মাখিয়ে দিতেন আমি বসে বসে খেতাম।
আসলে জ্ঞ্যান হবার পর তাকে আমরা দেখেছি আব্বা কোথায়? আব্বা জেলখানায়। অথবা যখন মুক্তি পেতেন তখন হয়ত দেখা হত। এভাবেই আমাদের জীবন কেটেছে। বেশিরভাগই দাদা-দাদীর কাছে। তারপর যখন আমরা ঢাকায় আসলাম এটা হচ্ছে ১৯৫৪ সালে। আমি আর কামাল – জামাল ছিলো খুব ছোট। আর প্রথম ঢাকা এসছিলাম আমরা ১৯৫২ সালে তখন যে ভাষা আন্দোলন
হয় – আব্বা জেলখানায় – তখন খবর পেলাম আব্বার শরীর খুব – খারাপ। আমরা চিন্তিত। আমার মনে নাই অতো স্মৃতি। কী কী তখন দাদা সিদ্ধান্ত নিলেন আমাদেরকে নিয়ে ঢাকায় আসবেন। এবং আমরা কিন্তু নৌকায় করে এসছিলাম ঢাকায়। আমার দাদার বড় নৌকা ছিলো। তাতে দুটো কামরা ছিলো। তিন মাল্লা নৌকা। আমি আর কামাল, আমরা ছোটবেলায় নৌকার মধ্যে দৌড়াতে পারতাম। হাঁটতে পারতাম। নৌকার ভিতরে রান্না-বান্না হত। নৌকাতেই খাওয়া দাওয়া হত। ঝড় আসলে বা স্টিমার গেলে নৌকায় যে দুলতো – দাদী আমাদেরকে ধরে-টরে রাখতো। সেগুলো মনে আছে। আমরা পরে শুনেছি চারদিন লেগেছিলো ঢাকায় আসতে৷
৪৯ সালে আব্বা যখন এরেস্ট হয়ে গেলেন তারপর তো আর ছাড়া পান নাই। একটানা বায়ান্ন সাল পর্যন্ত জেল খানায়। আব্বা যখন জেলে যায়, আমার ছোট ভাইটা তখন খুবই ছোট। কেবল কয়েক মাসের। ও তো আর আব্বাকে ওভাবে দেখার সুযোগ পায় নাই। কাজেই আমি যখন আব্বা আব্বা বলে কাছে যেতাম – স্বাভাবিক ও খুব অবাক হয়ে দেখত। তো ও আমাকে জিজ্ঞেস করতেছে, “তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলতে পারি?” এইভাবেই আমাদের জীবনটা ছিলো সব সময়। আবার আটান্ন সালে যখন মার্শাল ল হল তখন আমার মনে আছে আমাদের বাসা সার্চ করতে আসলো। এসে আমাদের সমস্ত কিছু উলট-পালট করে দেয়। এমনকি তখন তো ছোটবেলায় পুতুল খেলতাম, হাড়ি- পাতিল ছোট খেলার ঘর ছিলো, সব ভেঙ্গেটেঙে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সব নিয়ে গেল। ঐ বয়সে ঐটা খুব দুঃখের বিষয় যে আমার খেলার জিনিসগুলো এভাবে ছুড়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে – নষ্ট হবে – তারপরে আব্বাকে ধরে নিয়ে চলে গেল আমার চোখের সামনে দিয়ে। তিন দিনের মধ্যে নোটিশ দিয়ে বাড়ী ছেড়ে দিতে হল। আমার মা খুবই অসহায়ভাবে আমার দাদী তখন বয়স্ক – একদম রাস্তার উপরে সব মালপত্র নিয়ে।

শেখ রেহানা: মায়ের একটা খুব আতংক ছিলো সব সময়। মা ধরত যে “ওরা” ছাড়বে না। কারা হয়ত উল্লেখ করেনি, “ছাড়বে না”।

শেখ হাসিনা: মুশতাক ষড়যন্ত্র করতে পারে এটা আব্বা সব সময় জানতেন। বরং যখন তাজউদ্দীন কাকা চলে গেলেন আব্বার জন্য এটা খুব দুঃখজনক ছিলো। এই সময় আমি হঠাৎ কথায় কথায় বলে ফেলেছিলাম যে, “ঠিক আছে তাজউদ্দীন কাকা চলে গেছে তাতে কী আছে, মুশতাক চাচা তো আছে।” এই কথা শুনে আব্বা যে কমেন্টটা করলেন, যে কথাগুলি বললেন সেটা হচ্ছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাকে খালি বললেন, “মুশতাককে তুই চিনিস? ও তো সুযোগ পেলে আমার বুকে ছুরি মারবে।” অর্থাৎ আব্বা কিন্তু জানতেন কে কী করতে পারে – যে আমার মনে হয় তিনি জানতেন।

(বঙ্গবন্ধুর অডিও) “আমার মৃত্যু আইসে (এসে) থাকে যদি আমি হাসতে হাসতে যাবো – আমার বাঙ্গালী জাতকে অপমান করে যাবোনা – তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবোনা। যাবার সময় বলে যাবো, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙ্গালী আমার জাতী, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার মা।” (জনতার ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে চিৎকার)

শেখ হাসিনা: দিন রাত সারাক্ষণ এই রাস্তা ভর্তি সারাক্ষণ শুধু মিছিল আর মিছিল। সারাক্ষণ মানুষে ভরপুর। আব্বা এই গাড়ির বারান্দাটার উপরে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতেন, ঐ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতেন। কোন ক্লান্তি ছিল না।
কোণায় যে রুমটা আছে ওখানে টেলিফোনটা – ওখান থেকেই তিনি কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণাটা মুখে বলে দিয়েছিলেন।

(বঙ্গবন্ধুর অডিও) “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।”

শেখ হাসিনা: এই প্রচারটা যখন অলরেডি ওয়্যারলেসে চলে যায় তখন এটা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে। এবং দ্রুতগতিতে তারা চলে আসে এই বাসায় এবং আব্বাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।

THE FROST PROGRAMME 1972 (সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের সাথে বঙ্গবন্ধুর ভিডিও দেখানো হয়।)

David Frost: When did the Pakistani troops came in?

Bangabandhu: All side. They started shooting from the window.

David Frost: From that window there?

Bangabandhu: This side. They are shooting. They are shooting from that side. Then I told my wife to sit here with my two childs. I went out.

David Frost: Went out this way?

Bangabandhu: This way. I came here.

David Frost: Take leave from wife? Leaving them here?

Bangabandhu: She didn’t utter a single word. I only kissed her. A farewell kiss.

David Frost: Just a farewell kiss.

Bangabandhu: Farewell kiss. And I came out.

David Frost: Here?

Bangabandhu: They are shooting from that window. The door was open. I opened it.

David Frost: You opened it?

Bangabandhu: I came out. And why you people… stop shooting. I said stop shooting. I’m here. Why you are shooting? What for? Then they start rushing from all sides. There’s a … out of these military persons with their bayonet to charge me. Then one accidentally, one officer was here. he caught hold of me like this. “Don’t kill him”, he said.
David Frost: Just one officer stopped them.

Bangabandhu: Ay.. Stopped them. This time. Then they took me… dragged me from here. And started blowing me from the back of my heads. And from there gun’s back you know they started pushing me from here and there. Though officers was caught me, but they still start pushing and drag me down. “Don’t drag me”, I said, “come on”. I said, “Wait! Going down”, I said, “Wait.” “Allow me to bring my pipe and tobacco or you bring my pipe and tobacco from my wife. I require my pipe.” Then came again up. I saw my wife standing here with my two children, nobody is there. And they brought the pipe for me. And small cloths and some- thing in a small suitcase. I went away. This is my last. But I was seeing the fire from all side … burning every- where. Shooting of the machine gun and the mortars… all over Dhaka. They took me from here. My boys were fighting also in every time.

David Frost: And as you left 32 Dhanmandi, did you think you would ever see it again?

Bangabandhu: I never thought it. I thought this is the
last.

শেখ হাসিনা: এরপর তো অপেক্ষার পালা। তারপরে আমরা হঠাৎ খবর পেলাম ৮ তারিখ – ৮ ই জানুয়ারি, যে তিনি মুক্তি পেয়েছেন এবং ওখান থেকে তিনি সরাসরি লন্ডন চলে গেছেন। তারপর উনি ১০ ই জানুয়ারি ফিরে আসলেন। আমরা অপেক্ষা করে আছি। কামাল, জামাল, আমার দাদা, রাসেল সবাই এয়ারপোর্টে যায়, লাখো মানুষ, সমস্ত রাস্তা মানুষে মানুষে ভরাট। আমার মা একটা রেডিও নিয়ে মোড়া পেতে ঐ রেডিওর সামনে বসে ছিলেন সারাক্ষণ। কারোই খাওয়া নেই নাওয়া নেই সবাই শুধু অপেক্ষা আব্বার জন্য। উনি ফিরে আসার পর, প্রথমেই কিন্তু চলে যান ওনার জনগণের কাছে।

(বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভিডিও)
“আমার বাংলাদেশ আইজ স্বাধীন হয়েছে। আমার জীবনের স্বাদ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমার বাংলা আজ স্বাধীন বাংলা।”

শেখ হাসিনা: এরপরে তিনি আসেন আমাদের কাছে। এবং তিনি যখন আসেন সত্যিকথা বলতে কি, তখন এটা একটা একতালা বাসা, মা – দুটো কামরা ছিলো মা মা’র কামরায় বসে ছিলেন। আমরা সবাই অধীর আগ্রহে – আব্বা আসলেন – হ্যাঁ – আমাদের সবাইকে – আদর করলেন। আমরা কারো কোন – মানে আমরা সবাই বাকরুদ্ধ ছিলাম। আমাদের চোখে পানি, মনে আনন্দ। মানে সেটা একটা মানে কী যে অনুভূতি, মানে ফিরে পাওয়াটা – এই ফিরে পাওয়াটা যে আমাদের জন্য কত মূল্যবান ছিলো। নানা কথা শুনতাম, ওনাকে মেরে ফেলেছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তারপরে উনি যে ফিরে এলেন এবং সবাইকে আদর করলেন – তারপর যখন মা’র কাছে গেলেন – মা বাবাকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন মনে হল যেন যে তিনি সারা জীবনের সব পাওয়া পেয়ে গেছেন।

শেখ রেহানা: আমার আব্বা যে আমার মাকে এত শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং এত ভালোবাসতেন, আমার বাবার লেখা না পড়লে এটা বোঝা যায়না।

শেখ হাসিনা: আব্বা করাচী থেকে ঢাকা ফিরে এলেন। তখন এই গানটা পান্না লালের গাওয়া, “মা, আমার স্বাদ না মিটিল আশা না ফুরিল, সকলি ফুরিয়ে যায় মা।” ঐ সময় দেখতাম যে আব্বা বারবার এই গানটা শুনে যাচ্ছেন – বারবার এই গানটা শুনে যাচ্ছেন৷ মানে প্রতিদিন কতবার যে এই গানটা বাজাতাম তার ঠিক নাই।
মানে একটা নারী হত্যা হলে সবাই চিৎকার করে, শিশু হত্যা হলে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, আর এই ৩২ নাম্বার বাসায় ১৫ ই আগস্ট শিশু, নারী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হত্যা হল, আর সেই খুনিরা ঘুরে বেড়াবে, রাজনৈতিকভাবে তাদেরকে সব সময় একটা নিরাপত্তা দেওয়া হবে, তাদেরকে বিচারের আওতায় আনা হবেনা – এটা কী ধরণের আইন? সভ্য জগতে তো এরকম আইন হতে পারেনা।

শেখ রেহানা: মনডা খুব খারাপ থাকতো। পারলাম না। হেরে গেলাম। আব্বা- মা’র কাছে উপরে যেয়ে কী জবাব দেবো? আব্বা যদি জিজ্ঞাসা করে, মা জিজ্ঞাসা করে, দুইটা বোনকে রেখে আসলাম, কিছুই তো করতে পারলা না খুনিদের ব্যাপারে। খুব মন খারাপ তখন।

শেখ হাসিনা: আমি যখন একাশি সালে ফিরে আসলাম সে সময় এই দেশে কী অবস্থা ছিলো? খুনিরা তখন বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরী করে, ফরেন মিনিস্ট্রিতে চাকরী করে, অবাধে বিচরণ করে, সরকার তাদের মদদ দিচ্ছে। “জয় বাংলা” স্লোগান নিষিদ্ধ। বলতে গেলে – মানে বিএনপির গুণ্ডা-পাণ্ডারা ছুটে আসতো। রীতিমত মারতো। ছুরি দিয়ে – খুর দিয়ে পেট কেটে দেওয়া – “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছবি? এই ছবি নিষিদ্ধ।”
৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর। নূর হোসেন ঐ যে বুকে পিঠে লিখে নিয়ে আসলো – মানে “স্বৈরতন্ত্র নিপাত যাক”, পিঠে লেখা “গণতন্ত্র মুক্তি পাক”। গাড়ির পাশে পাশে যাচ্ছিলো, তারপর ওকে ডাকলাম যে, “এই ছেলে তুমি শার্ট গায়ে দাও। তুমি বুকে পিঠে যা লিখছো, তোমাকে তো মেরে ফেলে দেবে।” ও আমার গাড়ির কাছে মাথা এনে বলে, “আপা, আমার মাথায় একটু হাত রেখে দেন। গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়ে দেবো।” তখন বললাম যে, “না তোমার জীবন দিতে হবেনা। তোমাদের বেঁচে থাকতে হবে।” তখন ওর মাথায় শুধু হাত দিলাম। ও কিছুক্ষণ আমার হাতটা ধরল। গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছিলো। এর মধ্যে হঠাৎ বোমা পড়ল। অমনি সব ছুটে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল। বোমার সাথে সাথে গুলি। তখনো কিন্তু ও যে গুলি খেয়ে পড়ে গেছে তখন আমরা দেখতে পারিনাই। আমার গাড়িটাই আক্রমণ করছিলো। যখন গোলাপ শাহ মাজারের কাছে আমরা পৌছালাম তখন পুলিশ গাড়িটা আটকায় দিলো। আর ঠিক সেই সময় দেখলাম রক্তাক্ত অবস্থায়, গুলি খাওয়া অবস্থায় নূর হোসেনকে নিয়ে যাচ্ছে। কষ্টটা ওইখানেই যে আমি যে কথাটা বললাম, আর ঠিক সেই কথাটাই সত্যি হয়ে গেল। ঠিকই ওকে … ওর গায়েই গুলিটা লাগলো।
আমি সারা দেশে জনসভা করেছি, জনগণের কাছে যখনই গেছি – কেননা আমি দেখলাম যে আমার তো আর কোন যাবার জায়গা নাই, জায়গা হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ – সাধারণ মানুষ। প্রত্যেক মিটিং এ বক্তৃতা দিতাম এবং বিচার চাইতাম।
আর বাংলাদেশের মানুষের যে ভালোবাসা এটা তো অতুলনীয়। এর সাথে তুলনা হয়না। আমরা একবার চর ক্লার্কে বন্যার সময় রিলিফ ওয়ার্ক করতে গেলাম, যেতে আমরা – ওখানে যাওয়ার কিছু নাই – মানে কিছুদূর ভ্যানে তারপর হেঁটে হেঁটে – সেই ধানক্ষেতের আল দিয়ে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। দেখলাম যে একটা গ্রামের একজন বয়স্ক মহিলা বলছে যে, “মা, একটু আসো। মা, একটু বসো।” সেই খেজুর পাতার একটা পাটি বিছিয়ে দিলো, বসলাম। একটা ডাব কেটে এনে বলছে “একটু খাও, কত কষ্ট করো আমাদের জন্য। তোমার বাপ কষ্ট করে গেছে। তোমরাও কষ্ট কর।” এই যে কথাটা, এটুকুই তো আমার জীবনের সব পাওয়া। এর থেকে আর বড় পাওয়া তো আর কিছু হতে পারেনা।
যখন আমি সরকার গঠন করলাম তখন আমার এটা ইচ্ছে ছিলো যে ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স বাতিল করতে হবে। কাজেই আসার পরে পার্লামেন্টে সেই ইনডেমনিটি অর্ডিনেন্স আমরা বাতিল করলাম। বাতিল করার পরে আমরা মামলা করলাম।

শেখ রেহানা: সাক্ষী পাইনা, সুবোধ পাইনা। খুব কঠিন। মানে দুই বোনের যে কী অবস্থা। তারপরে তো আবার ক্ষমতা পরিবর্তন হলো। তখন আমি আপারে বললাম, “দেখলে তো কেমন – কেমন মজা? এখন বুঝো আবার ঐগুলারে ছাড়বে।”
ডিকেন্সের একটা বই ছিলো, ঐ “A Tale of Two Cities”. দুই বোন রিপাবলিকান আর ই দুই বোন মিলে ঐ উলের কাঁটা দিয়ে বুনছে, ওদের যারা অত্যাচার করত – তো যখন শেষটাকে মারলো তখন বলল, “থার্টি টু”। মানে কয়জনকে ওরা গুনছিলো দুই বোন মিলে। তো আমি ঐটা দিল্লিতে থাকতে আপাকে বলতাম, “আপা আমরা এরকম করবো। তুমি কিন্তু তখন আবার কিছু বলতে পারবা না। আমাকে কিছু একটু সুযোগ দিয়ো।” তা আপা বলত, “মাথা ঠাণ্ডা কর। মাথা ঠাণ্ডা কর।”

শেখ হাসিনা: এখানে অনেকে বলছেন যে, স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল করে করা – বা অন্য – একটা আইন করে করা। আমি বললাম যে, না৷ বাংলাদেশের আট/দশটা মানুষ যেভাবে বিচার পায়, আমি বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক। আমি সেই নাগরিক হিসেবে সেইভাবেই আমি বিচার চাই।

শেখ রেহানা: গণভবনটাও আমাদের অনেক মানে স্মৃতির৷ থাকিনি আমরা এখানে। আমরা কোন ভাই-বোনই থাকতে চাইনি। জানিনা থাকলে হয়ত অন্য দিকে ভালো হত কি খারাপ হত জানিনা৷ মা থাকতে চাননি ৩২ নাম্বারের বাড়ী রেখে, কামাল ভাই থাকবেনা, আপা থাকবেনা, জামাল ভাই না, আমি না, রাসেল না। তো আব্বা বলতেন, “তোমরা থাকবেনা শুধু শুধু আমি এখানে
থাকবো কেমন করে।”
(নাতী-নাতনিদের সাথে কিছু খুনসুটি)।

শেখ হাসিনা: রাসেল হবার পরে, মানে আমাদের জন্য – আমরা সবাই – আমরা ভাই বোন এতো খুশী – আমরা যেন হাতে খেলার পুতুল পেলাম এরকম ছিলো। এত আদরের ছিলো আমাদের। একটা ব্যাক্তিত্ব নিয়ে চলত। অতোটুকু মানুষ স্ট্রং পার্সোনালিটি।

শেখ রেহানা: কামাল ভাইয়ের সবচেয়ে প্রিয় ছিলাম আমি। কামাল ভাইয়ের রিপোর্টারও আমি ছিলাম। মা’রও রিপোর্টার ছিলাম- মানে এই টিকটিকি আরকি। কোন খালাতো বোনের চিঠি আসলো, কোন খালাতো ভাইয়ের চিঠি আসলো – মানে “বিশেষ চিঠি” আরকি! তো “মা ঐ চিঠিটা কিন্তু আজকে…” – মা তো দুপুর বেলা ঐ চিঠি – চিঠি কালেক্ট করে বসা, শাসন, কার ফোন এসে কেটে দিলো ঐ রিপোর্ট – এই ছিলো আমাদের বাড়ীর পরিবেশ। শেকড়টা আমরা ভুলবো না। আমার বাড়ী যে টুঙ্গিপাড়া, আমি যে একটা গ্রামের মেয়ে, ঐটা কিন্তু আমি খুব গর্ব বোধ করি বলতে।

শেখ হাসিনা: যখন টুঙ্গিপাড়া আসি ভীষণ ভালো লাগে। খুবই ভালো লাগে। মনে হয় যেন আমি একেবারে আমার মাটির কাছে ফিরে এসছি। আমার মানুষের কাছে চলে আসছি। আর আমার তো মনে হয় পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর জায়গা হল টুঙ্গিপাড়া। খালের পাড়ে একটা হিজল গাছ ছিলো, আর হিজল গাছে তো অনেক শিকড় হয়। তো আমরা ছোটবেলায় হিজল গাছের শিকড়ের উপর থেকে লাফ দিয়ে লাফ দিয়ে খালে ঝাঁপাতাম।

শেখ রেহানা: আমার দাদার খুব শখ ছিলো নাতীর বউ দেখবেন। কামাল ভাই তখন যুদ্ধ থেকে আসলেন। আর্মিতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে, আমরা খুকি আপার খুব ভক্ত ছিলাম, আমার মেঝ ভাইয়ের রুমে বিরাট একটা ছবি স্পোর্টস এর। ওরা প্র্যাকটিস করত একসাথে। আমার জামাল ভাই আর খুকি আপা – এনরা। মা’কে বললাম। তো অনেকে এসে বলল যে, “এ? ঘরের বউ খেলবে! এইডা একটা কথা নাকি? দৌড়াবে।” মা চুপচাপ – মা বেশি কিছু বলেনা। তো আমরা কয় ভাই-বোন মিলে মাকে বললাম, “মা, এত ভালো একটা মেয়ে, যার কাছ থেকে ন্যাও, তুমি এই মেয়ে কিন্তু পাবেনা।” মা বলে, “কামাল কী বলে? কামাল যদি বলে, তাইলে আমি রাজি।” তারপর আমরা বললাম, “মা, বিয়ের পরে কিন্তু খেলতে দিতে হবে। তুমি কিন্তু তখন বলতে পারবা না ঘরের বউ খেলতে পারবেনা।” বলছে, “না, বলবো না।”

শেখ হাসিনা: জামালের বিয়েটা হলো তার ঠিক পরপরই। কামাল তখন বউ নিয়ে শ্বশুর বাড়ী গেছে। আচ্ছা কামালরে খবর দ্যাও যে জামালের বিয়ে। এই – মানে একদিনের মধ্যে মানে বিয়ের কথা – একদিনের মধ্যে বিয়ে। সেটা আমাদের জন্য বোধ হয় আমাদের জীবনের মানে এরকম উৎসব কখনো হয় নাই। আর ওটাই শেষ উৎসব।
আমাদের বাসা সবার জন্য একেবারে উন্মুক্ত দ্বার। যে কারণে ষড়যন্ত্রকারীরাও সুযোগ পেয়ে গেল। তারাও এই সারা দিনরাত আসা-যাওয়া করত। তো জানতো। যেমন ডালিমের শাশুড়ি, ডালিমের বউ, সকালবেলা আসতো আর সন্ধ্যার পরে যেতো। ডালিম অনবরত আসতো। নূর – কামালের সাথে একসাথে এডিসি ছিলো। যেকোন সময় চলে আসতো। ইভেন, জিয়াউর রহমান আর তার স্ত্রী তো অহরহ আমাদের বাসায় এসে বসতো। এমনকি একুশে আগস্ট যে গ্রেনেড হামলা – ঐ গ্রেনেড হামলার সময় ডালিম-রশিদ দুজনেই বাংলাদেশে এসেছিলো। এবং তাদেরকে কারা টাকাপয়সা দিয়ে এনেছে সেটাও একেবারে জানিনা আমরা তা নয়।

শেখ রেহানা: আমি তো আপার সাথে ছিলাম বাসায়। আমি খুব অনুরোধ করলাম আপাকে – “আপা আমি যাই তোমার সাথে আজকে।” তো উনি, “না, তুমি বাসায় থাকো। তোমার যেতে হবেনা।” “না, আমি যাই তোমার সাথে, আজকে যাবো আমি।” “না, তুমি যাবানা।” খুব অভিমান, রাগ। ছোটবেলার মত ধাম-ধুম করে ঘরের মধ্যে চলে গেলাম। এরমধ্যে আপার কিছু মেহমান আসলেন। ঐযে আমাদের “আজকের পত্রিকা”র কাজী শাহেদ সাহেব ওনার ওয়াইফ নিয়ে আসলেন। আপা বললেন, “ওনাদের তুমি চা-নাস্তা খাওয়াও, গল্প করো, আমি এক্ষুনি আসবো।” তো জাস্ট কাজী শাহেদ সাহেব আসছেন, উনি কিছু কথা-টথা বলছিলেন, ওনার সাথে কথা বলতে বলতেই, টেলিভিশনটা কিন্তু অন। ওর মধ্যে ঐ ঘটনা দেখে আমি ওনাদেরকে ফেলে-টেলে আমি নীচে চলে আসছি। ওর মধ্যে খবর আসছে যে “নাই” (নেত্রী)। এরমধ্যে আপার গাড়ি। বারান্দার ওখানে দাঁড়ালো। দেখি আপার সমস্ত শরীরে, শাড়িতে, মুখে রক্ত ভরা। আমি আস্তে আপার আঁচলটা দিয়ে, আমার আঁচলটা দিয়ে আপার এগুলা মুছে আপাকে ধরে ভেতরে আনলাম। তখন জিজ্ঞাসা করিনাই কী হচ্ছে কী হল, না কী হল, আপাকে পেয়ে আমি – ব্যাস, আর কিছুনা।
মা হিসেবে আমি সবসময় চাইতাম যে সম্পূর্ণটা সময় আমার ছেলেমেয়েকে দেব। তাদেরকে মানুষ করব। যতোটুক সময় দেওয়ার কথা ততটুক দিতে পারিনাই তা তো ঠিক। কষ্টটা মাঝে মাঝে মনে হয়। খুব বেশি মনে হয়।
আমার হাজবেন্ড তখন চলে গেছেন জার্মানীতে। Karlsruhe University তে। আসলে বাচ্চাদের খুব মিস করছিলেন। বলছিলেন যে তুমি ওদেরকে নিয়ে আসো কিছুদিনের জন্য। আব্বার যাওয়ার কথা ছিলো পরের মাসে রুমানিয়াতে। বললেন যে, “আমি আসার সময় তোমাদেরকে নিয়ে আসবো।”

শেখ রেহানা: মাকে বললাম, “মা, আপা যাবে জয়-পুতুলকে নিয়ে, কষ্ট হবে, আমি গেলে একটু সাহায্য পাবে।” মা আব্বাকে বলল, “ঠিক আছে ও যাক হাসুর সাথে, কয়দিন পরে চলে আসবে।” এই আমাদের যাওয়া।
১৪ তারিখ রাত্রে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার। তো আমাদের কাছে ঐ বয়সে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার, ব্রাসেলসে, মেয়েরা সব আমার বয়সী। আমরা খুব হাসাহাসি, গল্প। তো দুলাভাই এসে আমাদের খুব বকলেন। যে “কান্না আছে সারাজীবন।” এতো হাসছি। উনি ঘুমাতে পারছেন না। যতোই সে বকে, আমরা ততো হাসি।

শেখ হাসিনা: সকালে একটা ফোন বাজলো। আমার মনে হয় যে – হ্যাঁ ঐ সকাল বেলা- তো ফোনের আওয়াজটা মানে আমার মনে হয় আমার জীবনে এত কর্কশ ফোনের আওয়াজ আমি জীবনে শুনি নাই। কেন আমার কাছে খুব মনে হল। তো আমরা যে রুমটায় ছিলাম ওখান থেকে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে। ঠিক সিঁড়ির গোঁড়ায় ফোন। ওখান থেকে ফোনটা ধরলেন (Host)। তারপর আমাকে বললেন, “তোমার হাজবেন্ডকে ডাকো।” তো আমি বললাম যে, “কেন? কী হইছে আমাকে বলেন।” উনি বললেন যে, “না, ওনাকে ডাকো।” তখন ওঠালাম, আসলো। তখন বলল যে বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে। ক্যু হয়েছে শুনেই বললাম, তাহলে তো আর আমার কেউ বেঁচে নেই। এইটুকু আমার মুখ থেকে আসলো।

(আযানের শব্দ। বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর সামনে মেশিনগানের আওয়াজ। এরপর বেতারের অডিও শোনা যেতে লাগলো।)
“বাংলাদেশ বেতার, খবর পড়ছি, ফারুক হোসেন। খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে আজ ভোরে সামরিক বাহিনী দেশের সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে। সকল দেশপ্রেমিক নাগরিককে নতুন সরকারকে সহযোগিতা করতে বলা হয়েছে। রক্ষীবাহিনী, বিডিআর এবং পুলিশ বাহিনীকে বিশেষ করে নিকটস্থ সামরিক কমান্ডদের সঙ্গে সহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হয়েছে।”

(এরপর সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টেকে দেয়া বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারের কিছু অংশের অডিও শোনানো হয়।)
Bangabandhu: We believe in the philosophy of Bengali life ‘Love, Love and Love’.

David Frost: At this moment in time as you look back, what was the moment of greatest happiness for you?

Bangabandhu: The Day I have heard that my people have been liberated. My people are independent. And I have got Bangladesh is an independent sovereign country. That’s the happiest day of my life.

(এরপর বঙ্গবন্ধুকে যে সিঁড়ির গোঁড়ায় গুলি করা হয়েছে সেই স্থানটি দেখানো হয় এবং কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা যায়।)

(পরের দৃশ্যে শেখ হাসিনা সকলের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। একে একে নামফলকগুলো দেখানো হয় বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গানটি ব্যাকগ্রাউন্ডে শোনা যেতে থাকে – ‘আশা না ফুরিল সকলি ফুরায়ে যায় মা’।)

শেখ হাসিনা: তারপর থেকে ঐ যেকোন ফোন ওভাবে বাজলে খুব – হঠাৎ ভেতরে – মানে বুকের ভেতরে – মানে ই করে উঠতো। অভাবনীয় একটা অন্যরকম কষ্ট। ফোনের আওয়াজটাই সহ্য করতে পারতাম না৷
হুমায়ুন রশিদ সাহেবকে এম্বাসেডর সানাউল হক সাহেব বললেন যে, “আপনি যে বিপদটা আমার ঘাড়ে দিয়েছেন এটা আপনি এখন নিয়ে যান।”

শেখ রেহানা: কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে মানুষের যে পরিবর্তন, ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের থেকে ঘরের থেকে বের করে দেয় এই অবস্থা।

শেখ হাসিনা: আমাদেরকে ওনার বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার কথা। উনি নিজের গাড়িটা দিলেন না। সোজা বলে দিলেন যে গাড়িটা নষ্ট। তো ওখানে আরেকজন অফিসার ছিলেন, তার স্ত্রী আবার আমার ক্লাশের – আমরা ক্লাশ সেভেন থেকে একসাথে পড়তাম। সেই ভদ্রলোক একটু খাতির করলেন। তখন বেলজিয়াম ভাষায় নিউজ হচ্ছে। বারবার টিভিতে আব্বার ছবি দেখাচ্ছে। কিন্তু আমরা কোন ভাষা বুঝতে পারছিনা। বেলজিয়ামের বর্ডারে আমরা এপাশে নামলাম। তারপরে নো ম্যান্স ল্যান্ড হেঁটে আমাদের মালপত্র সব হাতে করে নিয়ে – ইমিগ্রেশন করে- ওপারে যেয়ে – হুমায়ুন রশিদ সাহেব ওনার সেক্রেটারি পাঠিয়েছিলেন গাড়ি দিয়ে কারণ চার-পাঁচ ঘণ্টা যেতে হবে। আমাকে রাত্রে বেলা হুমায়ুন সাহেব আলাদা ডেকে নিলেন। যে, তুমি একটু আসো। ওনার রুমে। উনি আর উনার স্ত্রী বসা। তখন উনি বললেন, যে “আমরা অনেক চেষ্টা করছি খোঁজ করতে যতদূর খবর পাচ্ছি কেউ বেঁচে নাই।” এই কথাটা যখন শুনলাম, সত্যিকার বলতে কি, তখন তো বিশ্বাস করতে পারছিনা, কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যে আমার শরীরের সমস্ত রক্ত যেন একেবারে হিম শীতল হয়ে গেছে – আমি বোধহয় তক্ষনি মনে হচ্ছিলো যে আমি পড়ে যাবো। আমি অনেক কষ্ট করে চেয়ারটা ধরে আমি নিজেকে সামলালাম। উনি আমাকে অনেক স্বান্তনা দিলেন। উনি ওনারা সবাই মিলে। তখনো রেহানাকে আমি আর কিছু বলতে পারি নাই। আমি এসে দেখি রেহানা শুয়ে আছে। আমি ওর পাশে আস্তে চুপচাপ শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকি কতক্ষণ।

শেখ রেহানা: আপা ভাবছে আমি জানিনা, আমি ভাবছি আপা জানেনা। জানি তো আমরা দুইজনই। বাংলাদেশে, বাঙ্গালিরা আমার বাবাকে মারবে এটা তো ধারণারও বাইরে ছিলো।

শেখ হাসিনা: তবে হুমায়ুন রশিদ সাবের ওয়াইফ, উনি যথেষ্ট করছেন। আমাদের কাভার উনি গাড়িতে করে কালয়ে (Karlsruhe) পৌঁছে দিলেন। আমাদের হাতে এক হাজার ডাস মার্ক (Deutsche Mark) দিয়ে দিলেন যে তোমাদের হাতে তো টাকা পয়সা…। তারপর একটা স্যুটকেইস বের করে গরম কাপড় ভরে দিলেন – যে যেখানেই থাকো – এখানে না থাকলেও তো লাগবে – কোথায় পাবা কীভাবে কিনবা। বোধ হয় ঐ সময় ওনার ঐ স্নেহটা ভালোবাসাটা বা একটা আস্থা এটা আমাদের জন্য খুব দরকার ছিলো। জার্মান গভমেন্ট বলল যে আমরা যদি চাই ওখানে পলিটিকাল এসাইলাম নিয়ে থাকতে পারবো। আর মিসেস গান্ধী সাথে সাথে ওনার এম্বাসেডরকে বললেন আমাদের এম্বাসেডর হুমায়ুন রশিদ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে। মার্শাল টিটো, তিনি তার এম্বাসেডর দিয়ে যোগাযোগ করলেন। তখন একটাই চিন্তা ছিলো আমরা দেশে যাবো দেশে যাবো। মিসেস গান্ধী যেহেতু উনি মেসেজ পাঠালেন আপনারা …..ঠিক ব্যবস্থা হল যে আমরা ইন্ডিয়াতে চলে আসবো।
মিসেস গান্ধী আমাদের দেখাশোনা করার জন্য একজন অফিসার ঠিক করে দিয়েছিলেন। একটা বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা, সিকিউরিটির ব্যবস্থা করে দিলেন, আর ওয়াজেদ সাহেবকে একটা চাকরীও দিলো। এটমিক এনার্জি মিনারেলস ডিভিশনে চাকরী দিয়ে দিলো। মিসেস গান্ধীর সবচেয়ে বড় জিনিস ছিলো উনি খুব মানবিক চরিত্রের, আর আমাদেরকে খুবই স্নেহের চোখে দেখতেন।
একবার আমরা আজমির শরিফে গিয়েছিলাম, আমি রেহানা বাচ্চাদের নিয়ে। তো আমরা ওখানে থাকতে উনি একটা এপয়েন্টমেন্ট দিল ওনার সঙ্গে দেখা করার। আবার আমরা আসার সময় গাড়িটা নষ্ট হল। তাতে সময় নষ্ট হয়ে গেল। তখন রেহানা বলল যে এই বাচ্চাকাচ্চা আবার তৈরি-টৈরি করে নিয়ে যাওয়া তো সম্ভব না। তো, তুমি একটা কাজ কর, তুমি একাই চলে যাও। তো কোনমতে গাড়ি থেকে নেমে শুধু কাপড়-টাপড় চেঞ্জ করে একটু গোসল-কাপড়টা চেঞ্জ করেই আমি দৌড়ালাম ওনার সঙ্গে দেখা করতে। তো উনি আমার মুখটা দেখে তো কথা বলার পরে বলে কি, “তুমি …তুমি কিছু খেয়েছ? তুমি অমলেট খাবে? টোস্ট খাবে? চা খাবে?” উনি উঠে যেয়ে বলল, এবং সেই অমলেট
এবং টোস্ট আর চা – নিজে কাপে চা ঢেলে দিলেন। আমাকে বলল, “তুমি খাও। মুখটা একদম শুকনা, তুমি কিচ্ছু খাওনি”। আসলে এই যে স্নেহটা – ওনার ভালোবাসাটা – মানে এতো মানে ঘরোয়াভাবে উনি ব্যবহার করলেন যে এটা ভোলা যায়না। এটা খুব মনে লাগে।
সত্যি কথা বলতে কি ঐ সময়, সব হারাবার পর ওনার সামনে যেয়ে ঐটুকুই অনুভূতি হচ্ছিলো যে, “না, আমাদের জন্য কেউ আছে”। কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ওনার যে অবদান।

শেখ রেহানা: ৩২ নাম্বারে ঐ হৈ চৈ – ছোটবেলা থেকে একটা পলিটিকাল বাড়ি, গ্রামে টুঙ্গিপাড়ায় ঐ আমাদের দাদাবাড়ি – আর সেখানে ছোট্ট একটা বাসার মধ্যে দুইটা রুম। ওইখানে যেয়ে তো দুই বোন মানে যে একটা কীসের মধ্যে পড়লাম। কিচ্ছু বুঝিনা, কিছু করিনা, কী খাবো কী যাবো।

শেখ হাসিনা: প্রথম কয়েকটা বছর গেছে বসে বসে চিন্তা করে করেই। কারণ ওটা আমি এখনো বলতে পারবোনা – ঐ যে একভাবে হয়ত বসে আছি – বসেই আছি। হয়ত অনেক সময় এমনও গেছে যে ছেলেমেয়েদের খাবারই দেইনি। ভুলেই গেছি যে ওদেরকে খাবার দিতে হবে। বা রান্না করতে হবে। সব ভুলেই গেছি। এই আরকি।

শেখ রেহানা: আল্লার একটা রহম যে আমাদের দুই বোনকে পাগল বানায়া রাস্তায় ফেলে নাই। আপা কান্নাকাটি করে – এই পাশে আমি কান্নাকাটি করি। ঐ দুইটা বাচ্চা ঐ দুইটাই আমাদের। ঐ জয়- পুতুল।

শেখ হাসিনা: রান্না করে সংসার করা এটা তো ঐ দিল্লিতে এসেই বলতে গেলে শিক্ষা। দশ প্রকারের ডাল দেখাচ্ছে এখন বলতে পারছিনা আমরা তো দুইটা চিনি – মসুরের ডাল, মুগের ডাল আর ছোলার ডাল। এর বেশি তো চিনিনা। ওদের অনেক রকমের ডাল। অনেক ভাবে – আবার বলে “ধূলি নেবা? নাকি …” অতো বুঝিনা। কী বলে ধূলি-ঢালা আবার কি?
একবার মনে আছে? সেই শিং মাছ ধরা নিয়ে কয়জনে দৌড়াদৌড়ি। বহু অভিজ্ঞতা আমাদের আছে।

শেখ রেহানা: মানে আমরা অবাক হয়ে তাকায় থাকতাম যে, একটা সাইকেলের উপরে চারটা গ্যাস সিলিন্ডার। একটা মোটর সাইকেলের উপরে সামনে একটা বাচ্চা, হাজবেন্ড-ওয়াইফ, আরেকটা বাচ্চা, তারপরে ব্রিফকেইস একটা – ঐ জানলা দিয়ে বসে সব বসে বসে বসে বসে দেখতাম।
আর একটা কখনো বলিনি, এখন চল্লিশ বছর হয়ে গেছে – এখন বলা যায়। আমাদের দিল্লী থাকাকালীন আমাদের নামও পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। মিস্টার তালুকদার, মিসেস তালুকদার, মিস তালুকদার – আশেপাশের কেউ জানি না জানে। আরে এইটা কী ব্যাপার! দেশ ছাড়া, ঘর ছাড়া, বাপ-মা ছাড়া, নামও বদলাবো!? দরকার নাই। আমি থাকবোনা এখানে। কিন্তু তখন উপায় নাই তো, সব সময় তো রাগ অভিমান আর ফট করে তো কোন কিছু করা যায়না। মানে দিন কাটেনা, রাত কাটেনা। আমার চাচা, খোকা চাচা, উনি লন্ডন থেকে চিঠি লিখতেন, তো সপ্তাহে চিঠি যেতে দিল্লিতে লাগতো এক সপ্তাহ। খোকা চাচা প্রতিদিনই একটা করে চিঠি দিতেন আর আমরা দুইটা বোন জানলা দিয়ে তাকায় থাকতাম পোস্ট ম্যান কখন আসবে চাচার চিঠিগুলা পড়ব।

শেখ হাসিনা: আর সারাক্ষণ উদ্বেগ ছিলো যে দেশে কী হচ্ছে? কী হবে? কারণ এই দেশ স্বাধীন করেছিলেন আমার বাবা, দেশে গণতন্ত্র থাকবে, মানুষের কল্যাণ হবে। কিন্তু সেটা তো হলই না উলটো একটা খুনিদের রাজত্ব কায়েম হয়ে গেল।

শেখ রেহানা: আপা লিখতেন বসে বসে। আজকে চিনি এতটুকু, বিস্কিট এতোটুকু, সুজি এতটুকু, এই – আর ওর পাশেই আমার লেখা যে, “আল্লাহ তুমি কেন আমাদেরকে বাঁচায় রেখেছ জানিনা, কিন্তু এই খুনিদের ধরব বিচার করব ইনশাল্লাহ।” তারিখ দিয়ে লেখা। তো আপা সেদিন আমাকে দেখালেন, “এই দেখ”।
তারপর নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় আমি আর আপা গেলাম। তো আমরা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ওইখানের যে থাকে খাদেম – আমাদেরকে এসে – আমাদের নাম পরিচয় কিচ্ছু দেই নাই – দুইজন বড় ঘোমটা দিয়ে আমরা চলে গেছি। ওনারা এসে একটা খাতা আমাদেরকে দুই বোনের সামনে দিলেন।

শেখ হাসিনা: দেখলাম তারিখটা ৯ ই এপ্রিল ১৯৪৬ সালে আব্বা ওখানে গিয়েছিলেন। আর আমি গেলাম ৮১ সালের ৯ ই এপ্রিল। ৪৬ সাল – আমার জন্মের আগে। তিনি গিয়েছিলেন। আর আমি পাচ্ছি ৮১ সালে। একই তারিখে যাওয়া। সত্যি কথা বলতে কি, তখন একটা সাহস আমার মনে আসলো। যে, না, আমাকে যেতে হবে এবং বাংলাদেশের জন্য কিছু করতে হবে। বোধ হয় এই বার্তাটাই আমি পাচ্ছি।

শেখ রেহানা: আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, এইখানে এই এক ঘরের মধ্যে আমি পাগল হতে চাইনা। আমার কিছু করতে হবে। আমার বেরুতে হবে। এই খুনিদের ধরতে হবে। এইখানে বসে থেকে তো কিছুই করতে পারবোনা। তারপরে ঐ সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি লন্ডন যাওয়ার চিন্তা করি। ঐটাও আমি একটু স্বার্থপরের মতন আপাকে একদম একা বাচ্চা দুইটাকে দিয়ে চলে আসলাম।

শেখ হাসিনা: ওর তো বিয়ে হয়ে গেল ওখানে। আর আমি তো দিল্লীতেই থেকে গেলাম। আমার অবর্তমানে আওয়ামী লীগ আমাকে যখন সভানেত্রী নির্বাচিত করল তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আসবো।
আমরা আমাদের বাচ্চাদের কাছে ঐ খুব বেশি দুঃখের কথা কষ্টের কথা – এসব বলে ওদের ভারাক্রান্ত করিনা। জীবনে চলার পথে দুঃখ কষ্ট নানা ধরণের বাঁধা, প্রতিবন্ধকতা আসবে। আর সেই দুঃসময়ের দিনগুলি আমরা পার করেছি – আবার ভবিষ্যতেও যে আসবেনা তা তো না। আমাদের দেশের পরিস্থিতিতে এটা তো আমরা বারবার দেখেছি।
আমরা কিন্তু ওতে ভীতও না, ভয়ও না – যে কোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার মত মানসিক শক্তি আমাদের আছে।

শেখ রেহানা: আমি ৮৩ সালে যখন আসি – এসে আমি দেখলাম যে আপা সারাদিন তখন পার্টির কাজে। বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছেন, বাচ্চাদুটো- মানে ওদের খাওয়ার ঠিক নাই, পড়াশোনার ঠিক নাই, কী করছে না করছে, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম যে “না” – তার আগেই ওরা আমার কাছে ছিলো, কিন্তু হোস্টেলে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা আমার। বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যৎ তো নষ্ট করতে পারিনা। ওদের তো লেখাপড়া শিখতে হবে। আমার নিজের লেখাপড়াও হয়নি। পঁচাত্তরের ঘটনার পর। তো ঐ দুঃখটা তো আমার সারা জীবনের।
আর সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হল যে, যখন জয়-পুতুলকে নিয়ে যাই, আপা তখন গৃহবন্দী। ওদের যখন গাড়িতে নিয়ে যাই আপা – ওইখানে একটা গাছ – আপা গাছের – মানে আপার চোখের পানি আর থামেনা। কিন্তু আমি … আমি খুব শক্ত দেখাচ্ছিলাম। আমি নিয়ে চলে গেলাম।
আমি নইনিতালে ওদের ভর্তি করে দিয়ে তারপরে আসলাম। তো, মনে হয়না যে সৎ বোনও বোনের সাথে এইরকম কঠিন একটা কাজ করে – আমি আপার সাথে …। আপার সেই কান্না আমি ভুলবো না এখনো।

শেখ হাসিনা: আমি আমার বাচ্চাদের ঐ ছুটিতে – কারণ ঢাকায় আনলে তো সময় দিতে পারবো না। ওখানে গেলে একটু সময় দিতে পারবো। ঢাকায় আনতে গেলে আমাকে কাউকে পাঠাতে হবে। ওদের আনতে হবে। খরচেরও ব্যাপার আছে। আর আমি গেলে তো আমি একা যাচ্ছি। ওখানে যেয়ে ওদের সাথে যে কয়টা দিন ছুটি থাকতো কাটাতাম। তো সেই সময়টা খুব কাছে পেতাম। এই৷
আসার পরে যখন ট্যুর করতে শুরু করলাম, আর আমার তো থাকার জায়গা ছিল না। আমি কোথায় থাকবো আমি জানিনা৷ আর বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবো, আমার তো সোর্স অব ইনকামও নাই। ৩২ নাম্বার বাসার তো প্রশ্নই ওঠেনা।
আর ওটা তো তখনো সরকারের হাতে। আমি আসার পরে যে মিলাদ পড়ব আমাকে মিলাদও পড়তে দেয়নি। আমি রাস্তার উপর বসে মিলাদ পড়ায় আসছি।
আসলাম যখন, স্বাভাবিকভাবেই তখন দায়িত্বটা তো বুঝে নিতে হবে, কাজ করতে হবে। তো আমার যেটা লক্ষ্য ছিলো, পার্টির মধ্যে তো অনেক দ্বিধা-বিভক্ত ছিলো, তো আমাকে নিয়ে আসা হইছিল দলের ঐক্য বজায় রাখতে, তো আমি চেষ্টা করে গেলাম যে সংগঠনটাকে আগে গড়ে তোলা।
ইডেন হোটেল যেখানে ছিলো ওখানকার ছাদে আমাদের সভা- টভা হত। সেইখানে আমি প্রথম একটা … মানে ঘোষণা দিয়েছিলাম, “বাংলাদেশে আর আমরা এই রক্তক্ষয় দেখতে চাইনা।” আমি সেনাবাহিনীতে আর বিধবার কান্না শুনতে চাইনা। ছেলেহারা মায়ের কান্না শুনতে চাইনা। সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক সেটাই চাই।
আমি যখন এই বক্তৃতা দেই, অনেকেই আমাকে নিষেধ করেছে। “কী বলছ? এখনই মিলিটারি আসবে। মিলিটারি আসবে।” আমি বললাম যে, “না। আমি … আমাকে বলতে হবে – যেটা সত্য সেটাকে বলতে হবে। এভাবে একটা দেশ চলেনা।

(১৯৯১ এর নির্বাচনের সংবাদের ভিডিও দেখানো হচ্ছে।)

সাংবাদিক বলছেন –
Following nine years of autocratic battle the general election is currently undergoing in Bangladesh amidst overwhelming participation. Sheikh Hasina led Awami League side is speculated to secure a landslide victory with clear majority. The anticipated election puts capital city Dhaka in the center of attraction in South Asian political scene.

Piplu: ৯১ সালের যে নির্বাচন, সেটা আপনার জন্য মনে হয় একটা বড় টার্নিং পয়েন্ট। কী মনে হয়? কী মেসেজ দিছিল ঐ নির্বাচনটা আপনাকে?

শেখ হাসিনা: না, এত আন্দোলন সংগ্রামের পরে, মানে …ঐ নির্বাচনে হারাটা এটা আসলে বিশ্বাস করতে খুব অবাক লাগে।

শেখ রেহানা: সেই হার্ডেল রেসের মত আপা কিন্তু অনেক চড়াই-উৎরাই, অভিজ্ঞতা একভাবে আসে নাই তো – অপমান …। তা সাহসটা ছিলো, সততা ছিলো, কোনকিছুর লোভ নাই তো আর কোন কে ভয় পায়না তো। কারণ পঁচাত্তরের পরে আমরা ভয় পেয়ে করবটা কী?

(স্ক্রিনে নীচের লেখাটা আসে।)
Sheikh Hasina’s party, the Awami league, unexpectedly lost the 1991 general election.
She became Prime Minister in 1996, leading her party back into power for the first time in 21 years.
The new government repealed the Indemnity Ordinance, which had given legal immunity to the murderers of Sheikh mujib and his family.

শেখ হাসিনা: আমাদের তো পাঁচ বছর সময় চলে গেল। আমরা .. বিচারটা তো শেষ হলনা। ঐ অবস্থায় পড়ে ছিলো। খুব স্বাভাবিক, বিএনপি আসার পরে তো আর ঐ কেস চালায়নি। ওটা ওভাবেই পড়ে ছিলো। ২০০৯ এ যখন আমি সরকার গঠন করি – আবার উদ্যোগ নেই। মামলাটা দিনের পর দিন চলেছে।
আমি বলব যে যিনি রায় দিয়েছিলেন, জজ সাহেব – গোলাম রসুল সাহেব –অত্যন্ত সাহসের সাথে তিনি রায় দিয়েছেন এবং অবাক হবেন যে তার তিনটা মেয়ে ছোট ছোট। কিভাবে যেন তার বাড়ীতে, মানে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলল, যে মেয়েগুলো যেন হয়ত মানসিকভাবে কিছু একটা সমস্যা বা তার স্ত্রীকে নানাভাবে ভয় ভীতি দেখানো এবং যেদিন বিচারের রায় হবে সেইদিন বিএনপি হরতাল ডাকল। যাতে করে জজ সাহেব কোর্টে যেতে না পারে। কোর্ট না বসে। রায় যেন না দিতে পারে। সেই বাধাও কিন্তু দিয়েছিলো।
প্রথম রায় যখন পাই, আমি সাথে সাথে ৩২ নাম্বারে চলে গেছিলাম। ঐ সিঁড়ির কাছে যেয়ে – আমি সব সময় সিঁড়ির কাছে বসতাম। কী জানি মনে হয়, ওখান থেকেই তো আব্বার আত্মাটা বের হয়ে গেছে না?

(ব্যাকগ্রাউন্ডে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় গানটি বাজানো হয়। আশা না মিটিল সকলি ফুরায়ে যায় মা…)

(এবং নীচের লেখাটা দেখানো হয়।)

The trial began in 1997, twenty-two years after the events of August 15th, 1975.
Justice was finally delivered in 2010, thirty-five years after Sheikh Mujib and his family were murdered.
Of the twelve convicted killers who received the death sentence, six are still alive today.
Two of the killers are absconding in Canada and the US. The whereabouts of four others are unknown.

শেখ হাসিনা: আমার ছোটবেলা থেকে একটু ভয় ডর কম। গ্রামে মানুষ হয়েছি, এভাবে খোলা বাতাসে খোলা পরিবেশে মানুষ হলে বোধ হয় মানুষের মানসিক শক্তিটা একটু বাড়ে। কারণ গ্রাম ছাড়া ভালো লাগে নাকি? যখন স্কুল ছুটি হত, আমরা চলে আসতাম। বিশেষ করে ডিসেম্বর মাসের ছুটির সময় সবাই চলে আসতেন, ঘরে ঘরে রাঁধা হচ্ছে, খাওয়া হচ্ছে, সবাই একসাথে – বিরাট – পরিবারের আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে একটা হৈ চৈ অন্যরকম একটা পরিবেশে সবাই থাকতো। এবং আমার আকাঙ্ক্ষা আছে আমি যখন রিটায়ার করব তখন আমি টুঙ্গিপাড়া এসে থাকবো।

শেখ রেহানা: বাংলাদেশের জনগণ বা যেখানে যে আছে নির্যাতিত নিপীড়িত দুঃখী মানুষ তারা তো বঙ্গবন্ধুকে তার অভাবটাকে দেখতে পাচ্ছে আর আমরা বাবা হিসাবে পাচ্ছি – কিন্তু তার থেকেও বেশি আমাদের ক্ষতি হয়ে গেছে আমার মা চলে যেয়ে।
আমি শুধু চিন্তা করি যে মাকে যদি বলতে পারতাম যে, “মা, তোমার হাসু এখন আর অলস নেই। সে ‘আলসে-খানা’য় থাকেনা।”

শেখ হাসিনা: এখনো কোন কাজ করতে গেলে মনে হয় যে, মা এটা পছন্দ করবে কিনা। মা থাকলে কী বলত।

শেখ রেহানা: মাকে না বলা পর্যন্ত আমাদের শান্তি নাই। তো এখনো মনে হয় দৌড় দিয়ে যদি বনানীতে যেয়ে বা মাকে একটা চিঠি লিখে পাঠাতে পারতাম বা আব্বাকে পাঠাতে পারতাম। এই জিনিসগুলো খুব অনুভব করি।

(Based on conversations with Sheikh Hasina & Sheikh Rehana from 2013 to 2018)

(THE END)

Compiled by Dr Md Razibul Bari

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!