You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969.06.23 | সার্বজনীন ভোটাধিকার ও জনসংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে অবিলম্বে দেশব্যাপী প্রত্যক্ষ সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা দাবী | দৈনিক ইত্তেফাক - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক ইত্তেফাক
২৩শে জুন ১৯৬৯
সার্বজনীন ভোটাধিকার ও জনসংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে অবিলম্বে দেশব্যাপী প্রত্যক্ষ সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা দাবী : আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের নীতি-নির্ধারণী বিবৃতি
(ষ্টাফ রিপোর্টার)

ক্ষমতা হস্তান্তর ও শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে দলীয় নীতি ঘোষণা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান গতকল্য (রবিবার) অবিলম্বে সার্বজনীন ভোটাধিকার ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নিকট দাবী জানান।
নিজ দলের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের সহিত আলোচনার পর আওয়ামী লীগ-প্রধান সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন যে, দেশব্যাপী এই নির্বাচনের উদ্দেশ্য হইবে দেশে একটি ফেডারেল পার্লামেন্টারী শাসন কাঠামো কায়েম করা, যে কাঠামোর অধীনে কেন্দ্রে ও প্রদেশে প্রতিনিধিত্বশীল পরিষদ এবং বে-সামরিক সরকার কায়েম করতঃ অবিলম্বে সেই সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করিতে হইবে। শেখ সাহেব বলেন, আলোচ্য ফেডারেল পরিষদটি একাধারে ফেডারেল পার্লামেন্ট ও গণপরিষদ হিসাবে দ্বিবিধ দায়িত্ব পালন করিবে এবং শেষোক্ত দায়িত্ব পালনকালে উক্ত গণপরিষদ অনধিক ছয় মাসের একটি সময়সূচী নির্ধারণ করিয়া ঐ সময়ের মধ্যে দেশের জন্য একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিবে। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সহিত গতকাল (রবিবার) আওয়ামী লীগ অফিসে রুদ্ধদ্বার কক্ষে প্রায় পাঁচ ঘন্টা আলোচনার পর দ্বিপ্রহর দেড়টায় শেখ মুজিবর রহমান শাসনতন্ত্র ও নির্বাচন প্রশ্নে তাঁর দলের নীতি নির্ধারণী লিখিত বিবৃতিটি সাংবাদিকদের হাতে অর্পণ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে এই বিবৃতিটি সাংবাদিকদের হাতে অর্পণের জন্যই তাঁহাদিগকে আওয়ামী লীগ অফিসে আমন্ত্রণ জানাইয়াছেন, সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দানের জন্য নয়।
শেখ মুজিব তাঁহার বিবৃতিতে বলেন, আওয়ামী লীগ দেশবাসীর জন্য তাঁহাদের দলীয় ৬-দফা ও ছাত্রদের ১১-দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পূর্ব-প্রতিশ্রুতি পুনরায় দৃঢ়তার সহিত ঘোষণা করিতেছে। পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, জনসংখ্যার ভিত্তিতে ফেডারেল পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব, এক ইউনিট বিলোপ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাবেক প্রদেশসমূহের পুনরুজ্জীবনের ধ্যানধারণায় আওয়ামী লীগ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। এই কারণেই আওয়ামী লীগ তাঁহাদের এই কর্মসূচী-যাহার জন্য জনসাধারণ প্রভূত ত্যাগ স্বীকারও করিয়াছে-জনগণের আদালতে পেশ করিয়া নির্বাচনের মাধ্যমে অনুমোদিত করাইয়া লইতে চাহে।

‘৫৬ সালের শাসনতন্ত্র প্রসংগে
১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে শেখ সাহেব তাঁহার দলের নীতি-নির্ধারণী বিবৃতিতে বলেন, আওয়ামী লীগ ‘৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনের বিরোধী; কেননা দেশবাসীর দাবী-দাওয়া ও আশা-আকাংক্ষা যাহা বিগত গণ-আন্দোলনকালে সুস্পষ্টভাবে মূর্ত হইয়া উঠিয়াছিল, বিশেষ করিয়া এক ইউনিটের বিলুপ্তি, জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব এবং আওয়ামী লীগের ৬- দফা ও ছাত্রদের ১১-দফা মাফিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের পথে উক্ত শাসনতন্ত্র প্রতিবন্ধকবিশেষ বলিয়াই তাঁহারা মনে করেন।

বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ
শেখ সাহেব তাঁহার বিবৃতিতে বলেন, দেশবাসীর শাসনতান্ত্রিক বা অন্যবিধ যাবতীয় সমস্যার গ্রহণযোগ্য ও স্থায়ী সমাধানের জন্য পাকিস্তানের জনসাধারণকে গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থাদির মাধ্যমে তাঁহাদের সার্বভৌমত্বের অনুশীলন করিতেই হইবে। এইভাবে কি তাঁহাদের কাম্য এবং কোন্ দলের প্রতি তাঁহাদের সমর্থন রহিয়াছে, সুস্পষ্টভাবে তাহা জানাইয়া দিয়া নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মারফত কেবল দেশবাসী জনসাধারণই বর্তমান সংকট হইতে দেশকে মুক্ত করিতে সক্ষম।
এই কারণেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ক্ষমতার যাহারা প্রকৃত উৎস সেই জনসাধারণের হাতেই আজ ফিরাইয়া দিতে হইবে। বর্তমান কর্তৃপক্ষের জন্যই এই ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজটি আঞ্জাম দেওয়ার উপযুক্ত পন্থাই হইবে সার্বজনীন বয়স্ক ভোটাধিকার ও জনসংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে অবিলম্বে দেশে প্রত্যক্ষ সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এই নির্বাচনের উদ্দেশ্য হইবে একটি ফেডারেল শাসনকাঠামো কায়েম করিয়া কেন্দ্রে ও প্রদেশে প্রতিনিধিত্বশীল পরিষদ এবং একটি বে-সামরিক সরকার গঠন করিয়া সেই সরকারের হাতে অবিলম্বে দেশের শাসনভার বুঝাইয়া দেওয়া।
আলোচ্য ফেডারেল পরিষদটি একাধারে ফেডারেল পার্লামেন্ট ও গণ- পরিষদের দায়িত্ব পালন করিবে এবং শেষোক্ত দায়িত্ব পালনের শুরুতে উক্ত পরিষদকে অনধিক ছয়মাসের একটি সময়সূচী নির্ধারণ করিয়া সেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ অবশ্যই শেষ করিতে হইবে।
জনগণের নিকট হইতে সুস্পষ্ট ম্যান্ডেট প্রাপ্ত, নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ অমীমাংসিত মৌলিক শাসনতান্ত্রিক সমস্যাগুলির সমাধান করিয়া দেশবাসীর আশা-আশাংক্ষার ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিবেনই। জনগণের আশা-আকাঙ্খা এবং সত্যিকারের জাতীয় মন ও মানসের প্রতিফলন ঘটিয়াছে, এমন একটি শাসনতন্ত্রই কেবল দেশের মৌলিক আইনের পবিত্র মর্যাদা পাইতে পারে। একথা বিস্মৃত হইলে চলিবে না যে, আমাদের জাতীয় সমস্যাদি সমাধানের ইহা ছাড়া অন্য কোন শর্টকাট পথ নাই।
দেশের শাসনতান্ত্রিক সমস্যাবলী সমাধানের উদ্দেশ্যে সাম্প্রতিককালে কোন কোন নেতা ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের কথা বলিতেছেন। আওয়ামী লীগ ইহা সমর্থন করে না। কারণ ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের জনসাধারণের মূল দাবী-দাওয়ার অন্তরায়। সাম্প্রতিককালের দেশব্যাপী আন্দোলনে এই সত্য সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হইয়াছে।
জনগণের এই সব দাবী-দাওয়া হইতেছে এক ইউনিট বাতিল, জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব এবং আওয়ামী লীগের ৬-দফা ও ছাত্রদের ১১-দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন। প্রকৃতপক্ষে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র চূড়ান্তভাবে পাস হওয়ার সময় পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ প্রতিনিধি তাহা মানিয়া লন নাই। কারণ তাহাতে ২১-দফা কর্মসূচী মোতাবেক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা ছিল না এবং ভোটাররা ২১-দফার ভিত্তিতেই তাঁহাদের ম্যান্ডেট প্রদান করিয়াছিলেন।
তদুপরি ইহার পর সুদীর্ঘ সময় অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে এবং এই সময়ের মধ্যে নূতন নূতন মৌলিক সমস্যা দেশের সামনে দেখা দিয়াছে। এই সব সমস্যার গ্রহণযোগ্য সমাধান ১৯৫৬ সালের সেকেলে শাসনতন্ত্রে নাই। তদুপরি এই শাসনতন্ত্র সহজভাবে সংশোধনযোগ্যও নয়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রাপ্তবয়স্কদের সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর অধিক সময় ক্ষেপণ না করিয়া নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার জন্য আমরা তাঁহার নিকট অনুরোধ জ্ঞাপন করিব। দেশের কিষান, মজদুর ছাত্র এবং অগণিত মেহনতী মানুষের সমস্যাবলী মোকাবিলার জন্য জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্ব গ্রহণের সুযোগ দান ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থাই সাফল্যলাভ করিবে না।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯