দৈনিক পাকিস্তান
২৩শে জুন ১৯৬৯
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের ঘোষণা : ‘৫৬ সালের শাসনতন্ত্র জনগণের মূল দাবী আদায়ের অন্তরায়
(ষ্টাফ রিপোর্টার)
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমান ঘোষণা করেছেন যে আওয়ামী লীগ ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র পুনপ্রবর্তনের দাবী সমর্থন করে না; কারণ ঐ শাসনতন্ত্র দেশের উভয় অংশের জনগণের মূল দাবীসমূহ আদায়ের পথে অন্তরায় বিশেষ।
গতকাল রোববার অপরাহ্নে শেখ মুজিবর রহমান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের এক বৈঠক শেষে শাসনতন্ত্র সম্পর্কে বর্তমানে কতিপয় রাজনৈতিক নেতা যে বিতর্ক শুরু করেছেন সেই প্রশ্নে আওয়ামী লীগের ভূমিকা ব্যাখ্যা করেন।
তিনি ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের সমালোচনা করে বলেন যে, সাম্প্রতিক দেশব্যাপী আন্দোলনকালে দেশের দুঅংশের জনগণ এক ইউনিট ব্যবস্থা বাতিল, জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব এবং আওয়ামী লীগের ছয়দফা ও ছাত্রদের এগার-দফার আলোকে স্বায়ত্তশাসন দাবী করেছে।
আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রাপ্ত বয়স্কদের সার্বজনীন ভোটাধিকার ও জনসংখ্যা অনুযায়ী প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে অবিলম্বে প্রত্যষ নির্বাচনের ব্যবস্থা দাবী করেন।
তিনি আরও বলেন যে আওয়ামী লীগ ছয়-দফা ও ছাত্রদের এগার দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
প্রকৃতপ্রস্তাবে
১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, একুশদফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের কোন ব্যবস্থা ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে না থাকায় এই শাসনতন্ত্র পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ গ্রহণ করেনি। তারপর দীর্ঘদিন চলে গেছে, এই সময়ে অনেক মৌলিক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, যুগের অনুপযোগী এই শাসনতন্ত্রের মধ্যে দেশ সেসব সমস্যার সমাধান পাবে না। তদুপরী এই শাসনতন্ত্র সংশোধনের কোন সহজ ব্যবস্থাও এখানে নেই।
বর্তমান শাসনতান্ত্রিক সংকটের সমাধান প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান বলেন, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকার ও জনসংখ্যা অনুসারে প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে অবিলম্বে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা প্রয়োজন। এই নির্বাচনের উদ্দেশ্য হবে দেশে ফেডারেল পার্লামেন্টারী শাসনব্যবস্থার কাঠামো সৃষ্টি করা। এর মাধ্যমে দেশে জনপ্রতিনিধিদের আইন পরিষদ ও বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা যাবে, যে সরকারের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা প্রত্যার্পণ করা যাবে।
একযোগে আইন ও গণপরিষদ
বিবৃতিতে তিনি উল্লেখ করেন, এই ফেডারেল পরিষদ একযোগে আইন ও গণপরিষদ হিসেবে কাজ করবে। পরিষদকে ৬ মাসের মধ্যে শাসনতন্ত্র প্রণয়নের লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট করা দরকার।
তিনি বলেন, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ জনগণের পরিষ্কার ম্যান্ডেট নিয়ে অবশ্যই মৌলিক শাসনতান্ত্রিক সমস্যাবলীর সমাধানের চেষ্টা করবেন, দীর্ঘদিন যাবত এসব সমস্যার কোন সমাধান করা যায়নি। তাঁরা জনগণের আশা-আকাংখা প্রতিফলিত এবং জাতির স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রেখে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন। জনগণের ইচ্ছা ও মতৈক্যের ভিত্তিতে যে শাসনতন্ত্র প্রণীত হবে কেবলমাত্র সেই শাসনতন্ত্রই মৌলিক আইনের মর্যাদা লাভ করতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
শেখ সাহেব বলেন, দেশে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রেসিডেন্ট এহিয়া প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তিনি বলেন, “আর অধিক সময় নষ্ট না করে অবিলম্বে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য আমরা তাঁকে অনুরোধ করব।”
তিনি বলেন, দেশের কৃষক, শ্রমিক ছাত্র ও জনগণের ক্রমবদ্ধমান সমস্যাবলী সমাধানের দায়িত্বভার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর অর্পণ করা ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে এসবের সমাধান সম্ভব নয়।
তিনি আরো বলেন, শাসনতান্ত্রিকসহ অন্যান্য যাবতীয় সমস্যার স্থায়ী ও গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য গণতান্ত্রিক সংস্থাবলীর মাধ্যমে পাকিস্তানের জনগণকে তার সর্বময় ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দিতে হবে। কারণ, জনগণ এবং একমাত্র জনগণই তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে দেশকে বর্তমান দুর্যোগের কবল থেকে মুক্ত করতে এবং দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেদের পছন্দমত আদর্শ ও রাজনৈতিক দল নিয়ে অগ্রগতির সাথে এগিয়ে যেতে পারে। সুতরাং রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা জনগণের হাতেই প্রত্যার্পণ করা দরকার।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯