দৈনিক ইত্তেফাক
২রা মে ১৯৬৯
শেখ মুজিবরের রিভিশন মামলার শুনানী সমাপ্ত : সোমবার পর্যন্ত রায় স্থগিত
(হাইকোর্ট রিপোর্টার)
গতকল্য (বৃহস্পতিবার) ঢাকা হাইকোর্টে বিচারপতি জনাব আবদুল হাকিমের এজলাসে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমানের রিভিশন মামলার শুনানী সমাপ্ত হয়। মামলার রায় সোমবার পর্যন্ত স্থগিত রাখা হইয়াছে।
আবেদনকারীর কৌসুলী সরকার পক্ষ হইতে আদালতে প্রদত্ত শেখ সাহেবের বাংলা ভাষণের ইংরাজী অনুবাদটি ত্রুটিপূর্ণ বলিয়া আপত্তি জানাইলে মাননীয় বিচারপতি তাঁহাকে অদ্য তাঁহাদের নিজস্ব ইংরাজী অনুবাদ দাখিলের নির্দেশ দেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৬৬ সালের ২০শে মার্চ তারিখে ষ্টেডিয়ামের জনসভায় প্রদত্ত শেখ মুজিবর রহমানের ভাষণকে কেন্দ্র করিয়া পাকিস্তান দেশরক্ষা বিধির ৪১ (৬) ধারাবলে ঐ বছরের ১৭ই এপ্রিল তাঁহার বিরুদ্ধে এক মামলা দায়ের করা হয়। মামলার বিচার শেষে ১৯৬৭ সালের ২৭শে এপ্রিল ঢাকার প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিষ্ট্রেট জনাব আফসার উদ্দিন আহমদ শেখ সাহেবকে দোষী সাব্যস্ত করিয়া এক বছর তিনমাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। উক্ত দণ্ডাজ্ঞার বিরুদ্ধে তিনি ঢাকার দায়রা জজের আদালতে একটি আপিল (আপিল নং ৭৪, ১৯৬৭) দায়ের করেন। অতিরিক্ত দায়রা জজ জনাব কায়সার আলীর আদালতে আপিলের শুনানী হয়। মাননীয় দায়রা জজ শেখ মুজিবর রহমানের দণ্ডাজ্ঞা হ্রাস করিয়া তাহাকে ৮ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন। উপরোক্ত রায়ের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে শেখ মুজিবর রহমান অত্র রিভিশন মামলা দায়ের করেন। গত বুধবার এই মামলার শুনানী আরম্ভ হইলে সরকারের পক্ষ হইতে ডেপুটি লিগ্যাল রিমেব্রান্সার আদালতকে জানান যে, সরকার শেখ মুজিবর রহমানের দণ্ডাজ্ঞা মার্জনা করিয়াছেন। কিন্তু উক্ত দণ্ডাজ্ঞার আইনগত বৈধতা নির্ণয়ের জন্য শেখ সাহেবের প্রধান কৌসুলী জনাব সিরাজুল হক দাবী জানাইলে মাননীয় বিচারপতি গত বুধবার এই প্রশ্নে মামলার শুনানী আরম্ভ করেন।
দণ্ডাজ্ঞার বৈধতার প্রশ্নে শুনানীকালে শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে বলা হয় যে, আবেদনকারী পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বা সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করার মতো আপত্তিকর ভাষণ দেন নাই। তিনি অত্যন্ত সদুদ্দেশ্যে তদানীন্তন সরকারের সমালোচনা করিয়াছেন। তিনি তাঁহার ভাষণে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের জন্য গঠনমূলক সুপারিশ করেন। এ বৈষম্য দূর করা সরকারের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব। দেশের উভয় অংশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করাও সরকারের দায়িত্ব। স্বাধীন দেশের নাগরিক ও একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান হিসাবে গঠনমূলক সমালোচনা করার অধিকার তাঁহার ছিল। ইহা পাকিস্তান দেশরক্ষা বিধির পরিপন্থী নয়। অতএব, শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি প্রদত্ত দণ্ডাদেশ অবৈধ।
গতকল্য আবেদনকারীর কৌসুলী হাইকোর্টে বলেন যে, আবেদনকারীর ভাষণের কোন বিশেষ শব্দ বা কোন বিশেষ অংশকে পৃথকভাবে বিচার না করিয়া তাঁহার ভাষণকে সামগ্রিকভাবে বিচার করিতে হইবে। এই প্রসঙ্গে তিনি বিভিন্ন হাইকোর্টের কতিপয় রায় আদালতে পেশ করেন। তন্মধ্যে ঢাকা হাইকোর্টের প্রদত্ত একটি রায়ের (ঢাকা ল’ রিপোর্ট ১৭ নং খণ্ড, পৃঃ ৪৯৮) প্রতি মাননীয় আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া কৌসুলী বলেন যে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী ও উদার মনোভাব লইয়া শেখ মুজিবর রহমানের ভাষণটিকে সামগ্রিকভাবে বিচার করিলে দেখা যাইবে, বিদ্বেষ সৃষ্টির কোন অসাধু উদ্দেশ্য তাহার ছিল না। অতএব তাঁহার ভাষণকে আপত্তিকর বলা অসঙ্গত। আবেদনকারীর কৌসুলী বিচারপতি জনাব আবদুল হাকিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলেন যে, “তফাজ্জল হোসেন বনাম পূর্ব পাকিস্তান সরকার” মামলায় বিচারপতি জনাব সাত্তার মন্তব্য করেন যে, সরকারের বিরুদ্ধে অসঙ্গত সমালোচনা করার অধিকার কাহারো নাই। কিন্তু ন্যায়সঙ্গত সমালোচনার অধিকারও কাহাকেও অস্বীকার করা যায় না।
বিচারপতি সাত্তারের উপরোক্ত মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আবেদনকারীর কৌসুলী আরো বলেন যে, জনাব শেখ মুজিবর রহমান একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। অতএব, তিনি দেশবাসীর জন্য তাঁহার দলীয় কর্মসূচী ও ছয় দফা বিশ্লেষণ করিতে পারেন। ‘রাজনৈতিক দল আইনেও’ রাজনীতিকদের এই অধিকারের স্বীকৃতি রহিয়াছে। অতএব শেখ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা যায় না।
জনাব মুজিবর রহমানের ভাষণের বিভিন্ন অংশের প্রতি মাননীয় বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া কৌসুলী বলেন যে, জনাব মুজিবর রহমান তাঁহার ভাষণে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের কথাই বলিয়াছেন। ইহা বিদ্রোহাত্মক নয়।
“সংগ্রাম” শব্দটির প্রতি মাননীয় বিচারপতি আবেদনকারীর কৌসুলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করিলে তিনি বিচারপতি জনাব সাত্তারের এক রায়ের উদ্ধৃতি দিয়া বলেন যে, অতীতে সংগ্রাম শব্দে জনমনে যে প্রতিক্রিয়া হইত এখন আর তাহা হয় না। কালের প্রবাহ ও সময়ের পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে আমরা অতি সাধারণ অর্থে এই শব্দটিকে গ্রহণ করিয়া থাকি। ইহার ফলে জনমনে কোন বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় না। অতএব, যুগের হাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এই শব্দটিকে বিচার করিতে হইবে।
শেখ মুজিবর রহমানের ভাষণের বিভিন্ন অংশের উল্লেখ করিয়া কৌসুলী জনাব সিরাজুল হক বলেন যে, প্রকৃতপক্ষে জনগণের ঐক্য ও দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনই জনাব মুজিবর রহমানের বক্তব্যের লক্ষ্য ছিল। এই উদ্দেশ্যে তিনি দেশের উভয় অংশের মধ্যে বৈষম্য ও ভুল বুঝাবুঝির অবসানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন। উদার মনোভাব লইয়া বিচার করিলে তাঁহার ভাষণটিকে ঘৃণা বা বিদ্বেষপ্রসূত বলিয়া বর্ণনা করা যায় না। দেশের নিরাপত্তা ও সংহতি বিধানই তাহার ভাষণের উদ্দেশ্য ছিল এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতেই তাহার ভাষণটির বিচার করিতে হইবে।
সরকার পক্ষে ডি-এল-আর জনাব মাসুদ শেখ সাহেবের বক্তৃতার দুইটি অংশ সম্পর্কে বিশেষ করিয়া আপত্তি তুলেন। তিনি বলেন, দেশরক্ষা বিভাগের সব কয়টি সদর দফতরই পশ্চিম পাকিস্তানে, মূলধন গঠনের সকল উৎসও দেশের অপর অংশে—ইত্যাকার যে সব কথার তিনি অবতারণা করিয়াছেন তাহাতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টির প্রবণতা রহিয়াছে। দ্বিতীয়তঃ দলে দলে গ্রামাঞ্চলে ছড়াইয়া পড়িয়া সংগ্রাম ও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্য দলীয় কর্মীদের প্রতি তিনি যে আহ্বান জানাইয়াছেন তাহাতে দেশে আইন ও শৃংখলা বিঘ্নিত করিয়া বিশৃংখলা সৃষ্টির প্রয়াস পাওয়া হইয়াছে।
জবাবে আবেদনকারীর কৌসুলী বলেন যে, সামরিক সদর দফতর ও মূলধন গঠনের উৎস সম্পর্কে শেখ সাহেব তাঁহার আলোচ্য বক্তব্য পেশের সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও বলিয়াছেন।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯