দৈনিক পয়গাম
২২শে মার্চ ১৯৬৯
শ্রমিক সমাবেশে শেখ মুজিবের ঘোষণা : নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিব ও জনগণের সকল দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালাইয়া যাইব
(ষ্টাফ রিপোর্টার)
বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমান গতকল্য (শুক্রবার) ঘোষণা করেন যে, তাঁহার দল একই সঙ্গে নির্বাচনে অংশ গ্রহণও করিবে এবং জনগণের দাবী-দাওয়া আদায়ের জন্য নিয়মতান্ত্রিকভাবে শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম চালাইয়া যাইবে।
স্মরণকালের বৃহত্তম শ্রমিক সমাবেশে গোলটেবিল বৈঠক পরবর্তী প্রথম জনসভায় আওয়ামী লীগ প্রধান আদমজী নগরে উপরোক্ত ঘোষণা করেন। অজস্র পুষ্পবৃষ্টি ও মুহুর্মুহু হর্ষধ্বনি ও জিন্দাবাদ ধ্বনির মধ্যে বক্তৃতা করিতে উঠিয়া গম্ভীরকণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেন, আজ এই মহতী ঐতিহাসিক শ্রমিক সমাবেশে আমি স্মরণ করি সেই সব বীর সন্তানদের যাহারা অধিকার আদায়ের জন্য অকালে রাজপথের ধূলায় তাহাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়াছেন। আমি স্মরণ করি, শহীদ ডঃ শামসুজ্জোহা, শ্রমিক মুজিবুল্লাহ, মনু মিয়া, আসাদুজ্জামান আরও নাম না জানা বীর সন্তানদের-যাহাদের রক্তে স্বৈরাচারের রাইফেল কলঙ্কিত হইয়াছে। এই কথা কয়টি বলিতে বলিতে শেখ মুজিবের কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হইয়া যায় এবং কান্না জড়িত স্বরে তিনি শহীদদের আত্মার মাগফেরাতের জন্য সকলকে দোয়া করিবার অনুরোধ জানান। আবেগের ভার কাটিয়া গেলে বঙ্গ শার্দুল তাহার স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যসহ কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করেনঃ “সাবধান, লক্ষ্য রাখিবেন এই রক্তদান যেন বিফলে না যায়।”
তিনি বলেন যে, ৬-দফা দাবী ঘোষণার পর হইতে শোষিত জনগণের উপর যে নির্যাতন নামিয়া আসিয়াছে ইতিহাসে তাহার তুলনা নাই। কিন্তু কি ছিল ৬-দফায়? তিনি বলেন যে, ৬-দফায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবী পেশ করা হইয়াছিল। কিন্তু সরকার ইহার তাৎপর্য না বুঝিয়া ক্ষেপিয়া গেলেন।
শেখ সাহেব বলেন যে, তিনি সরকারকে বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন যে, ৬৫ সালের যুদ্ধে দেখা গিয়াছে পূর্ব পাকিস্তান দেশের অপর অংশ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছে। সুতরাং পূর্ব বাংলার স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা থাকা দরকার।
শেখ মুজিব বলেন যে, সরকার তাহার এই বক্তব্যের উল্টা ব্যাখ্যা করিয়াছে। দাবী মিটাইবার বদলে নামিয়া আসিয়াছে জেল, গুলী, মামলা, ষড়যন্ত্র মামলা প্রভৃতি হাজারো নির্যাতন।
বাঙ্গালীদের কলিজা নিংড়াইয়া
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন যে, ২১ বৎসরের ইতিহাসে বাঙ্গালীরা কম দেয় নাই। তাঁহাদের কলিজা নিংড়াইয়া কয়েকটি পরিবারের স্বার্থকে গড়িয়া তুলিয়াছে। জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ জন হওয়া সত্ত্বেও রাজধানী করাচীতে গিয়াছে। তাহার পর রাওয়ালপিণ্ডিতে স্থানান্তর ও বর্তমানে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ইসলামাবাদে নূতন রাজধানী গড়িয়া তোলা হইতেছে। সশস্ত্র বাহিনীর সদর দফতরসমূহ পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা করা হইয়াছে।
আর দেওয়ার মত কিছু নাই
রাজধানীর সুযোগে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু লোক ব্যবসায় বাণিজ্যের শতকরা ৭০/৮০ ভাগ সুযোগ গ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু এখন বাঙ্গালীর হাতে আর কিছু দেওয়ার মত অবশিষ্ট নাই।
কি পাইয়াছি?
তিনি বলেন যে, ২১ বৎসরে আমরা কি পাইয়াছি? দালান-কোঠা কিছু উঠিয়াছে সত্য; কিন্তু গ্রাম বাংলা খালি হইয়া গিয়াছে। তিনি বলেন যে, বর্তমান সরকারের ১০ বৎসরের শাসনামলে শ্রমিক কৃষকের অধিকার অপহরণ করা হইয়াছে। সরকারের মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থা দেশকে জাহান্নামে লইয়া গিয়াছে। শেখ মুজিব বলেন যে, এই অন্যায় অত্যাচারের অবসান ঘটাইবার উদ্দেশ্যে ৬-দফা মুক্তি সনদ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে স্বার্থবাদী প্রতিক্রিয়াশীল মহলের অন্তরাত্মা কাঁপিয়া উঠে। শুরু হয় গ্রেফতার। তারপর ৭ই জুনের হরতালের দিনে নারায়ণগঞ্জ ও তেজগাঁ এলাকায় শ্রমিকদের গুলী করিয়া হত্যা করা হয়।
শেখ সাহেব বলেন যে, জনসাধারণের ট্যাক্সে কামান বন্দুক কেনা হয় বিদেশী শত্রুর আক্রমণ মোকাবিলা করার জন্য দেশের জনগণকে হত্যা করার জন্য নয়।
গুলীর হিসাব
আওয়ামী লীগ প্রধান অভিযোগ করেন যে, গত ৭ বৎসরে সরকারী হিসাব মতে প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ৮০ জন লোককে গুলী করিয়া হত্যা করা হইয়াছে। তিনি বলেন যে, বেসরকারি হিসাবে আরও বহু লোকের মৃত্যু হইয়াছে। সময় হইলে সেইসব বীর শহীদদের কবর খুঁজিয়া বাহির করা হইবে।
তিনি বলেন যে, এই সংগ্রামী জনগণের নিরলস আন্দোলনের জন্যই তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করিতে হইয়াছে। শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, “আমরা পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করিয়াছি এই জন্য নয় যে, পাকিস্তানের পুলিশ, পাকিস্তানের মিলিটারী পাকিস্তানের মানুষের উপর গুলী চালাইবে।”
গোলটেবিল
গোলটেবিল বৈঠক সম্পর্কে শেখ সাহেব বলেন : “আমি আশা করিয়াছিলাম, এইবার নেতারা একটা সমাধান গ্রহণ করিবেন। কিন্তু তাহা হইল না। বৈঠকে এক হাতে সামান্য কিছু দিয়া অন্য হাতে আবার সব লইয়া গিয়াছেন।”
তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়া বলেন: “গোলটেবিলে সমাধান না করিয়া আপনারা ভুল করিয়াছেন। পূর্ব বাংলার মানুষ এখন গুলী খাইতে শিখিয়াছে। অতএব, আর দাবী নিয়া ছিনিমিনি খেলিবেন না।” তিনি বলেন, অবিলম্বে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন দিয়া দেন। পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভাঙ্গিয়া দেন। দেশে তবেই শান্তি ফিরিয়া আসিবে।
শিল্পপতিদের প্রতি
শিল্পপতি ও পুঁজিপতিদের লক্ষ্য করিয়া আওয়ামী লীগ প্রধান বলেন: ‘আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন, আপনাদের মিল আপনাদেরই থাকিবে। তবে মেহেরবাণী করিয়া আপনারা শ্রমিকদের ন্যায্য দাবী-দাওয়া পূরণ করুন। জিনিষপত্রের যে হারে দাম বাড়িয়াছে সেই হারে তাহাদের বেতন বাড়াইয়া দিন, তাহাদের শ্রমিক অধিকার ফিরাইয়া দিন। আপনাদের কোন ভয় নাই।’
জমির খাজনা
নির্যাতিত নেতা শেখ মুজিব সব হারা কৃষকদের সমস্যা আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন যে, মিল মালিকগণ ৫/১০ বৎসর করিয়া ট্যাক্স হলিডে পাইয়া থাকে। সরকার তাহাদের কোটি কোটি টাকা আয়কর হইতে অব্যাহতি দেন। অথচ জাতির প্রাণ কৃষকের কোন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। তিনি ২৫ বিঘার কম জমির মালিকদের খাজনা রহিত করার দাবী জানান। তিনি প্রতিশ্রুতি দেনঃ আমরা যদি বাঁচিয়া থাকি কৃষকের এই দাবী পূরণ করা হবে।
নির্বাচন
শেখ সাহেব বলেন যে, যাহারা আন্দোলনে ছিল না এমন এক দল লোক এখন সবহারা শ্রেণীর দরদী সাজিয়াছে। এখন তাহারা পোড়াইয়া ফেলার কথা বলিতেছেন। তিনি বলেন : “জনাব, পোড়াইয়া ফেলার আগে নিজের ক্ষমতা কতখানি তাহা একবার ভাবিয়া দেখুন।” তিনি বলেন : “আমরা নির্বাচন ও সংগ্রাম এক সঙ্গে চালাইয়া যাইব।”
শান্তি রক্ষার আহ্বান
শেখ মুজিব বলেন যে, বর্তমানে অতি প্রতিক্রিয়াশীল ও অতি প্রগতিবাদী দুই দল লোক হিন্দু-মুসলিম, ও বাঙ্গালী, বিহারী বিদ্বেষ সৃষ্টির প্রয়াস পাইতেছে। তিনি বলেন যে, সংগ্রামী-শ্রমিক-কৃষক ছাত্র জনতাকে এই অশুভ চক্রান্তকে বানচাল করিয়া শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে সংগ্রামকে আগাইয়া নিতে হইবে।
সাবধান বাণী উচ্চারণ করিয়া জননেতা বলেন : সংগ্রাম চালাইতে হইবে। কিন্তু খেয়াল রাখিবেন, গোলযোগ যেন না হয়। শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক সংগ্রামই জনগণের সংগ্রাম।
উপসংহারে শেখ মুজিব বলেন, আমি বাঙ্গালীর সন্তান। বাংলার মানুষ আমাকে ভালবাসে। বাংলাকেও আমি ভালবাসি। আমি ওয়াদা করিতেছি : আজ হইতে আমার দিনের বিশ্রাম ও রাতের আরাম হারাম। জনগণের অধিকার সম্পূর্ণরূপে অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমি ক্লান্ত হইব না।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯