You dont have javascript enabled! Please enable it! 1969.03.22 | জনগণ চায় পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এক ইউনিট বাতিল ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব : আদমজীনগরে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশে শেখ মুজিব | দৈনিক পাকিস্তান - সংগ্রামের নোটবুক

দৈনিক পাকিস্তান
২২শে মার্চ ১৯৬৯
জনগণ চায় পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এক ইউনিট বাতিল ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্ব :
আদমজীনগরে লক্ষ লক্ষ লোকের সমাবেশে শেখ মুজিব
(ষ্টাফ রিপোর্টার)

গতকাল শুক্রবার বিকেলে আদমজীনগরের লক্ষ লক্ষ লোকের এক জনসমুদ্রে তুমুল হর্ষধ্বনীর মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান ঘোষণা করেন, জনগণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সামনে কোন সরকারই তা যত শক্তিশালীই হোকনা কেন মাথা নত না করে পারে না।
তিনি রাওয়ালপিণ্ডিতে গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানের পর গতকালই প্রথম শ্রমিক জনসভায় বক্তৃতা করেন। পূর্ব পাকিস্তান চটকল ফেডারেশনের সভাপতি মওলানা সাইদুর রহমান সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন।
সভার কাজ শুরুর আগে মওলানা সাইদুর রহমান শেখ মুজিবকে মাল্য ভূষিত করেন। গতকালের সভায় ৭২টি বিভিন্ন শ্রমিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবর রহমানকে মাল্যভূষিত করার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু পৃথক পৃথকভাবে মাল্য ভূষণে অনেক সময় ব্যয়ের কথা বিবেচনা করে প্রতিষ্ঠানগুলির নাম পাঠ করে শোনানো হয়। শেখ সাহেব তার দলীয় নীতির কথা উল্লেখ করে বলেন, জনসাধারণ চায় ৬-দফার ভিত্তিতে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হোক যাতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিল ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকবে। তিনি সরকারকে বলেন যে, উপরোক্ত দাবী মেনে নিলে দেশে শান্তি ফিরে আসবে। তিনি বলেন জনসাধারণ কি চায়, তা আমরা নির্বাচনের মাধ্যমেই প্রমাণ করে দেব।
তিনি জনসাধারণকে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। গোলটেবিল বৈঠকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম দেশের সমস্যাবলী সমাধানের ঐকান্তিক ইচ্ছে নিয়ে সবাই কাজ করবেন। কারণ, এভাবে যে দেশকে চলতে দেওয়া যায় না সে সম্পর্কে সবাই মতৈক্যে পৌঁছেছিলেন।’
তিনি বলেন, গোলটেবিল বৈঠকে তিনি সব সমস্যার কথা চিন্তা করে যে সব দাবী পেশ করেছিলেন, তার মধ্য থেকে প্রায় ২টি মেনে নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার এক হাতে দিয়ে অন্য হাতে তা আবার ফিরিয়ে নিয়েছেন।
শেখ সাহেব ৬-দফা দাবীর কথা উল্লেখ করে বলেন, এটা স্বায়ত্তশাসনের দাবী ছাড়া আর কিছু নয়। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বহির্বিশ্বে যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে স্বায়ত্তশাসনের দাবী জানানো হয়েছিল, কিন্তু সরকার তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে নানা ধরনের অত্যাচার শুরু করলেন।
তিনি বলেন, এই ৬-দফায় পশ্চিম পাকিস্তানকেও একই রকম স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে তিনি ৬ দফার সমর্থনে অনুষ্ঠিত ১৯৬৬ সালের ৭ই জুনের হরতাল এবং বিভিন্ন স্থানে গুলি বর্ষণের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন জনাব মোনেম খানের শাসনমহলে সরকারী হিসেবেই পুলিশের গুলীতে ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যুর সংখ্যা বেসরকারী হিসেবে কত তা যদি কোনদিন সম্ভব হয় তাহলে কবরে সন্ধান করে দেখিয়ে দেওয়া হবে। কত লোককে হত্যা করা হয়েছিল।
তিনি বলেন পাকিস্তানী জনগণকে হত্যা করার জন্য পাকিস্তান আন্দোলন করা হয়নি। তিনি গ্রামীণ সমস্যাবলীর কথা উল্লেখ করে বলেন, গ্রামে আজ কোন আনন্দ নেই। কারণ কৃষকের ঘরে খাবার নেই। করের ওপর কর চাপিয়ে তাদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর আমরা কিছুই পাইনি যারা পাওয়ার তারাই পেয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, তারা ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির কর মওকুফ করারও দাবি জানিয়ে এসেছেন। শিল্পপতিদের ট্যাক্স হলিডে দেওয়া হয়, এ সময় তার আয় কর কাঁন্তি দেওয়ার ব্যবস্থাও করে থাকেন কিন্তু কৃষকদের কর মওকুফের কোন ব্যবস্থাই করা হয় না।

নির্বাচন প্রসঙ্গে
নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একদল লোক ইদানিং বড় বড় কথা বলছেন। নির্বাচনে যারা অংশ গ্রহণ করবে, তাদের মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, সংগ্রামের সময় এসব লোকের দেখা পাওয়া যায় নি। এসব লোকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “জনাব, নিজের শক্তি জেনেই কথা বলুন।”

শিল্পপতিদের প্রতি আহ্বান
শেখ সাহেব শিল্পপতিদের প্রতি শ্রমিকদের জন্য বেতন বোর্ড গঠনের আহ্বান জানান। তিনি তাদের নিশ্চিন্ত মনে যথারীতি কল-কারখানা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের নীতির ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরাং শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবী ন্যায়সঙ্গত।
তিনি শিল্পপতিদের দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আহ্বান দিয়ে বলেন, আপনাদের কোন ভয় নেই কাজ করে যান কল কারখানা চালু রাখুন।
আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, বর্তমান গণআন্দোলনকে বিপথে পরিচালিত করার জন্য কুচক্রীদল হিন্দু-মুসলমান ও বাঙ্গালী বিহারীর মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
এই অপচেষ্টার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এর ফলে দেশে যে বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে তার সুযোগে কেউ কেউ কামান বন্দুক নিয়ে লাফিয়ে পড়বে।
তিনি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি কুচক্রী মহলের এই প্রচেষ্টাকে ‘মস্তখেলা’ বলে অভিহিত করেন।

প্রগতিশীল ও ধার্মিক
তিনি বলেন যে, একদল প্রগতিবাদী হ’য়েছেন, আর একদল ধর্মের নামে রাজনীতি করেছেন। জনসাধারণ এদের চিনে রাখছেন।
তিনি বলেন, কৃষক শ্রমিকদের উপর দীর্ঘ দিন ধরে যে অনাচার অবিচার হয়েছে, একদিনে তাদের জন্য বেহেশত এনে দেওয়া যাবে না। দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালাতে হবে—তবে এ সংগ্রাম হবে শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক।
তিনি তুমুল করতালির মধ্যে ঘোষণা করেন, এই দাবী না আদায় হওয়া পর্যন্ত তাঁর দিন আর রাতের আরাম তিনি হারাম করবেন।
বক্তৃতা শেষে তিনি নিজে শ্লোগানের নেতৃত্ব দিয়ে বলেন, সংগ্রাম সংগ্রাম বিশাল জনতা কণ্ঠে কণ্ঠে মিলিয়ে বলে উঠে-চলবেই চলবে।
শেখ মুজিব বক্তৃতা দিতে উঠতেই মুহুমুহু শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ, ৬-দফা জিন্দাবাদ, ১১ দফা জিন্দাবাদ, প্রভৃতি ধ্বনি দেওয়া হতে থাকে।
প্রথমে আদমজীনগর সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবের হাতে ৬-দফার প্রতীক হিসেবে ৬টি পায়রা দেওয়া হয়। তিনি তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে সেগুলিকে আকাশে উড়িয়ে দেন।
ঢাকা হইতে আদমজী নগর পর্য্যন্ত পথে বহু স্থান স্থানীয় জনতা জমা হয়ে তাকে স্বাগত জানান। ডেমরা শিল্প এলাকায় পৌঁছানোর পর শ্রমিকদের কয়েকটি মিছিলের সঙ্গে শেখ সাহেবের জীপ, ট্রাক ও মোটরের মিছিলটি মিশে যায়। তারপর সম্ভুক গতিতে মিছিলটি আদমজীনগরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
ডেমরা শিল্পএলাকা থেকে আদমজীনগর পর্যন্ত মোট ৬টি তোরণ নির্মিত হয়েছে। প্রথমটি মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্মরণে দ্বিতীয়টি শেখ মুজিবর রহমানের সম্মানে, তৃতীয়, চতুর্থ ও ৫ম তোরণগুলি যথাক্রমে শহীদ আসাদুজ্জামান, সার্জেন্ট জহুরুল হক ও আদমজীর বীর শ্রমিকের স্মরণে নির্মিত হয়। শেষ তোরণটি শেখ মুজিবের নামেই নির্মিত হয়।
জনসভায় প্রারম্ভে গোদনাইল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি সূর্য পদক, ছিদ্দিরগঞ্জ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ৬ দফার প্রতীক হিসেবে ৬টি তরফা চিহ্নিত স্বর্নপদক ও আদমজী জুটমিল শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একটি রৌপ্য নির্মিত তলোয়ার প্রিয় নেতাকে উপহার দেওয়া হয়।

সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯