দৈনিক পয়গাম
২৩শে মার্চ ১৯৬৯
সম্বর্ধনা সভায় শেখ মুজিবের ঘোষণা : পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ে বদ্ধপরিকর
(ষ্টাফ রিপোর্টার)
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দীর্ঘ দিনের শোষণের অবসান ঘটাইয়া প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনসহ তাহাদের ন্যায়সঙ্গত দাবীসমূহ আদায় করিতে বদ্ধপরিকর। গতকল্য (শনিবার) রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের উদ্যোগে মালিবাগ চৌরাস্তায় আয়োজিত এক বিরাট সম্বর্ধনা সভায় ভাষণ দানকালে শেখ মুজিব উপরোক্ত মন্তব্য করেন। সভার শুরুতে কোরান তেলওয়াতের পর সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করিয়া মোনাজাত করেন।
শেখ মুজিব ভাষণদানের জন্য মাইকের সামনে দণ্ডায়মান হইলে উপস্থিত হাজার হাজার শ্রোতা অগ্নিপুরুষ শেখ মুজিব জিন্দাবাদ “আমার নেতা-তোমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব” ধ্বনিতে চারিদিক প্রকম্পিত করিয়া তোলে। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব বলেন, যাহারা এ দেশের মানুষের জন্য এ দেশের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য-পূর্ব বাংলার ন্যায্য দাবী আদায়ের জন্য শহীদ হইয়াছেন, তাহাদের আজ স্মরণ করি।
পূর্বাহ্নে রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব মহিউল ইসলাম চৌধুরী (কার্জন) মানপত্র পাঠ করেন। শেখ মুজিব সভাস্থলে পৌঁছিলে আওয়ামী লীগ কর্মী, ছাত্র ও জনসাধারণের পক্ষ হইতে তাহাকে বিপুলভাবে মাল্য ভূষিত করা হয়।
শেখ মুজিব বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণ মানুষের মত বাঁচিতে চায়, ছাত্ররা চায় সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা, কৃষক-শ্রমিক চায় তাহাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার। কিন্তু বিনিময়ে তাহারা পাইয়াছে গুলী-যে গুলী এদেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকা দিয়া ক্রয় করা হয়।
বেঈমানী করিব না
শেখ মুজিব উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, “আপনারা আমার প্রতি যে স্নেহ, যে মমতা দেখাইতেছেন, উহার সাথে আর কেহ বেঈমানী করিলেও শেখ মুজিব কোন দিনই বেঈমানী করিবেন না।
তিনি জনসাধারণের উদ্দেশে বলেন যে, আমাদের সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে হইবে-তবে সেই সংগ্রাম শান্তিপূর্ণভাবে চালাইতে হইবে।
সতর্কবাণী
জনসাধারণকে সতর্ক করিয়া দিয়া তিনি বলেন, দেশের এক শ্রেণীর লোক যাঁহারা আন্দোলনের সময় আগাইয়া আসেন নাই, তাঁহারা আজ আন্দোলনকে বিপথগামী করার জন্য আগাইয়া আসিতেছেন। তিনি উল্লেখ করেন যে, একদল অতি প্রগতিবাদী ও অপর একদল ধর্মের নামে দেশে বিশৃংখলা সৃষ্টি করিতে চেষ্টা করিতেছে। তাঁহাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য শেখ মুজিব জনগণকে হুঁশিয়ার করিয়া দেন।
পশ্চিম পাকিস্তানীদের দরদ রহিয়াছে—
শেখ মুজিব বলেন, পাঞ্জাবী, সিন্ধী, বেলুচী পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের সহিত আমাদের কোন সংঘাত নাই। তিনি বলেন যে, পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের দরদ রহিয়াছে। তদন্ত কমিটি গঠনের দাবী
শেখ মুজিব তাহার ভাষণে উল্লেখ করেন যে, সাম্প্রতিক আন্দোলনে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যদানের জন্য গঠিত সাহায্য তহবিলের টাকা-পয়সা আসিয়া পৌঁছিতেছে, পক্ষান্তরে তিনি সার্জেন্ট জহুরুল হক, ডাঃ শামসুজ্জোহা, মনু মিয়া ও অন্যান্যের হত্যার কারণ উদ্ঘাটনের জন্য অতি সত্বর তদন্ত কমিটি গঠন করিতে সরকারের প্রতি দাবী জানান।
মন্ত্রী হইতে চাই না
শেখ মুজিব বলেন, মন্ত্রী হওয়া অপেক্ষা কারাগারের ‘সেল’ আমার কাছে প্রিয়। তিনি বলেন, বাংলার মানুষ আমাকে ভালবাসে তাহাদের স্নেহ- ভালবাসা আমার মনে শক্তি সঞ্চার করে।
যাহারা আচকান-পাজামা পরিধান করিয়া মন্ত্রী হওয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি করিতেছেন, তাহাদের হুশিয়ার করিয়া দিয়া শেখ মুজিব বলেন যে, এখন বাংলার মানুষ গুলী খাইতে শিখিয়াছে। কাজেই বাংলার জনগণের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিলে কাহাকেও তাহারা ক্ষমা করিবে না।
তিনি বলেন, দেশবাসীর ন্যায়সঙ্গত দাবী-দাওয়া ও অধিকারের প্রতি যাহাদের দরদ নাই, তাহারা কোনদিনই এদেশের মাটিতে টিকিয়া থাকিতে পারিবে না। তিনি গভর্ণর মোনয়েমের উল্লেখ করিয়া বলেন যে, তাহাকেও এদেশের মাটি ত্যাগ করিতে হইয়াছে। তিনি বলেন, পূর্ব বাংলার সোনার মাটিতে যেমন সোনার ফসল ফলে তেমনি পরগাছারও জন্ম হয়।
শেখ মুজিব বলেন, আমাদের মনে রাখিতে হইবে যে, এদেশে যেমন মীরজাফরের জন্ম হইয়াছিল তেমনি জন্ম হইয়াছিল সিরাজ, মোহন লালের।
আমি একগুঁয়ে, তবে-
গোলটেবিল বৈঠকে একগুঁয়েমি সম্পর্কে জনৈক পিডিএম নেতা কর্তৃক তাহার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন, ইহা সত্য যে, আমি একগুঁয়ে। তবে জনগণের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য আমার একগুঁয়েমি নহে। আমার একগুঁয়েমি জনগণের দাবী আদায়ের জন্য, তাহাদের অধিকার আদায়ের জন্য। শেখ মুজিব সেই পিডিএম নেতার উল্লেখ করিয়া বলেন, “এই নেতাই মন্ত্রী হওয়ার আশায় রাওয়ালপিণ্ডি গমন করিয়াছিলেন।”
আওয়ামী লীগ গঠনের আহ্বান
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ভাল ভাল কর্মীদের সমবায়ে প্রতি ওয়ার্ডে শক্তিশালী আওয়ামী লীগ কমিটি গঠনের আহ্বান জানান।
মালীবাগ শহীদ মিনারে
শেখ মুজিবুর রহমান সম্বর্ধনা সভায় আগমনের পূর্বে সাম্প্রতিক আন্দোলনে মালীবাগ এলাকায় নিহত শহীদদের স্মৃতিমিনারে গমন করেন ও পুষ্পস্তবক অপর্ণ করেন। তিনি শহীদানের রুহের মাগফেরাত কামনা করিয়া মোনাজাত করেন।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯