দৈনিক ইত্তেফাক
২৪শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
মহাসমুদ্রের মহাকল্লোলে-
(ষ্টাফ রিপোর্টার)
গতকাল (রবিবার) অপরাহ্ন ২টায় ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক দেশ গৌরব নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে যে নজিরবিহীন ঐতিহাসিক গণসম্বর্ধনা প্রদান করা হয়, উহাতে শুধু রাজধানী ঢাকার সকল শ্রেণির নাগরিক নহেন-অধিকন্তু সুদূর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা প্রভৃতি স্থান হইতেও অসংখ্য লোক যোগদান করেন।
গতকাল বিকালে সুদীর্ঘ পৌনে তিন বছর কারাবাসের পর জননায়ক শেখ মুজিবর রহমানের প্রথমবারের মত জনসভায় আবির্ভাব লক্ষ লক্ষ ভক্ত, অনুরক্ত ছাত্র-জনতার মুহুর্মুহু করতালি ও জিন্দাবাদ ধ্বনি অবিরাম পুষ্প বর্ষণ এবং নেতার নিকটবর্তী হইয়া তাঁহাকে প্রাণভরিয়া দেখার জন্য জনতার আকুল আকুতির দুর্লভ ঐশ্বর্যে মহিমামণ্ডিত হইয়া উঠিয়াছে। অগণিত প্রাণের নিঃশেষিত প্রীতিরসে সিঞ্চিত হইয়াছে সংগ্রামী গণনায়কের নতুন যাত্ৰা পথ৷
দশ লক্ষাধিক লোক এই গণ সম্বর্ধনায় শরীক হইয়া এমন দৃশ্যের অবতারণা করেন যার তুলনা নাই। এরা মহাসমুদ্রের মত গভীর, ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ সাগরের উত্তাল তরঙ্গের চাইতে এরা ভয়াল, উদীয়মান সূর্যের চাইতে এরা লাল, পর্বতের চাইতে এরা অটল। এই মহাসমুদ্রের প্রতিবিন্দু বারি যখন এক সঙ্গে করতাল শুরু করিল তখন মহাকল্লোলে আকাশবাতাস প্রকম্পিত হইল প্রলয় হিল্লোলে মহাসমুদ্রের বুকে ঢেউ এর উপর রৌদ্রের ঝিলিমিলি একই ছন্দে প্রবাহিত হইল, আলোর ঝলকানিতে উদ্ভাসিত করিয়া দিল দিক- দিগন্তে। আলোকোজ্জল পথে শুরু হইল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংগ্রামী মানুষের নবীন যাত্রা।
গতকাল সকাল হইতেই কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কালিয়াকৈর, নরসিংদী, ভৈরব প্রভৃতি স্থান হইতে শত শত লোক জাতীয় পতাকা সুসজ্জিত বাস ও ট্রাকযোগে ঢাকায় আগমন করে। গতকাল ট্রেনেও মফস্বল এলাকা হইতেও শত শত লোক ঢাকায় আগমন করে।
বেলা ১১টা হইতে ১২টার দিকে রাজধানীর সকল প্রবেশপথ দিয়া ট্রাক ও বাস বোঝাই মানুষের স্রোত ঢাকায় আগমন করিতে থাকে এবং তাহাদের দৃপ্তকণ্ঠের “জেলের তালা ভেঙ্গেছি শেখ মুজিবকে এনেছি” “বঙ্গ শার্দূল শেখ মুজিব-জিন্দাবাদ” প্রভৃতি ধ্বনিতে সারা রাজধানী প্রকম্পিত হইয়া উঠে।
টঙ্গী, তেজগাঁও, আদমজী নগর, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি শিল্প এলাকা হইতেও সহস্র সহস্র শ্রমিক সুসজ্জিত ট্রাকে নাচিয়া নাচিয়া গান গাহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত বিরল এই গণসম্বর্ধনায় যোগদান করে।
ইহাছাড়া আরও যাহারা এই গণসম্বর্ধনায় যোগদান করিতে আসেন, তাঁহাদিগকে এমনভাবে রাজধানীর কোন অনুষ্ঠানেই কোন দিন দেখা যায় নাই। তাহারা হইতেছেন, গ্রাম বাংলার জনজীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নৌকার মাঝি, লাঠিয়াল দল, পল্লীর স্বভাবসুলভ কবি, কাড়ানাকাড়ার বাদ্যযন্ত্রী শিল্পী, আর একতারা হাতে বাউল কবি।
মাঝিদের হাতে ছিল পদ্মা-যমুনা-মেঘনা-ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী-ধলেশ্বরী আর মধুমতী বিধৌত বাংলার অতি পরিচিত প্রতীক নৌকার বৈঠা। লাঠিয়াল দল আসে ঢাক-ঢোল লাঠি লইয়া বাউল কবি লইয়া আসিয়াছেন তার সাধনার নিত্য সঙ্গী সাধের একতারা ও কাসের মন্দিরা। সকলের মধ্যেই এক নব জীবনে স্পন্দন ও এক নব উল্লাস তাহাদের প্রাণবন্যা দৃষ্টে মনে হয় যেন শত শতাব্দীর বন্ধন ছিন্ন করিয়া তাহারা মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়াছে।
শেখ সাহেব আসিবার সঙ্গে সঙ্গে অন্তহীন গণসমুদ্র শেখ মুজিব জিন্দাবাদ ধ্বনিতে দিগন্ত প্রকম্পিত করিয়া সঙ্গে সঙ্গে ময়দানের চতুর্দিক হইতে সদম্ভে গর্জিয়া উঠে শত শত বোম পটকা, ক্র্যাকার, আকাশে উড়িতে থাকে নেতার অসংখ্য ছবি ও রঙ্গীণ কাগজের ফুলঝুরি।
রমনা রেসকোর্সের উন্মুক্ত আকাশের নীচে সুসজ্জিত সুউচ্চ মণ্ডপের নিকট নেতা আসিতেই জনতা করতালি ও হর্ষধ্বনিতে মহাসমুদ্রের মত গর্জিয়া উঠে। জনতার প্রান্তভাগে অসংখ্য ট্রাকের উপর দাঁড়াইয়া থাকে মানুষের পাহাড়। ময়দানের সুবিস্তৃত বট গাছের ডালাপালা মানুষের ভারে নুইয়া পড়ে।
শেখ মুজিব মণ্ডপে উঠিলে বিপুলভাবে তাঁহাকে মাল্যভূষিত করা হয়। যাহারা মঞ্চে উঠিয়া মাল্যভূষিত করিতে পারেন নাই তাহারা নিজ স্থান হইতেই তাঁহার দিকে মালা ছুড়িয়া দেন। মঞ্চের চারদিক হইতে শুরু হয় পুষ্প বৃষ্টি।
নেতা মঞ্চে উঠিয়া হাত নাড়াইয়া তাঁহার প্রিয় দেশবাসীর নিকট হইতে অভিভাদন গ্রহণ করার সময় বিশাল জনসমুদ্র আবেগ-আপ্লুত হইয়া উঠে।
সুত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু: পঞ্চম খণ্ড ॥ ষাটের দশক ॥ চতুর্থ পর্ব ॥ ১৯৬৯