সংবাদ
২০শে নভেম্বর ১৯৬৮
মুক্তাগাছায় আওয়ামী লীগ জনসভায় রায়:
ওয়ালী খান, ভুট্টো প্রমুখসহ শত শত নেতা ও কর্মী গ্রেফতারের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হইবে না
মুক্তাগাছা, ১৬ই নভেম্বর (নিজস্ব সংবাদদাতা)।- পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা, রাজবন্দীদের মুক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রদানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন।
গত বৃহস্পতিবার মুক্তাগাছা শহর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত বিরাট জনসভায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম বক্তৃতা করেন।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, এই জনসভা রাজবাড়ী মাঠে অনুষ্ঠানের কথা প্রচারিত হইয়াছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালিপনায় মাত্র সাড়ে ৬ ঘণ্টা আগে দরিচারাণীর বাজার ময়দানে জনসভা স্থানান্তরিত করিতে হয়।
এই জনসভায় জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছাড়াও বক্তৃতা করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এম, এন, এ, প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগম, ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব রফিকউদ্দিন ভূইয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব খোন্দকার আবদুল মালেক (শহীদুল্লাহ), টাঙ্গাইলের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা জনাব শামসুর রহমান খান, কিশোরগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব মোস্তাফিজুর রহমান খান ও চাঁদপুরের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ কর্মী জনাব আবদুল মতিন পাটওয়ারী প্রমুখ নেতা ও কর্মী।
প্রত্যেক বক্তার বক্তৃতার সময় জনতার মধ্য হইতে মুহুর্মুহু “শেখ মুজিবসহ সকল আটক ও রাজবন্দীদের মুক্তি চাই”, “ট্যাক্স-খাজনার বোঝা কমাতে হবে”, “কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা এক হও” ইত্যাদি শ্লোগান উত্থিত হইতে থাকে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, আজ পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষও জাগিয়া উঠিয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রচণ্ড গণআন্দোলনকে দমাইয়া দেওয়ার জন্য বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ন্যায় ক্ষমতাসীন সরকার নগ্ন দমননীতির আশ্রয় লইয়াছে। আর তাই সারা পশ্চিম পাকিস্তানে বেপরোয়া গুলীবর্ষণ, কাঁদুনে গ্যাস, লাঠিচার্জ ও পাইকারী হারে গ্রেফতারী অভিযান পরিচালনা করিয়া ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হইয়াছে।
পশ্চিম পাকিস্তানের সম্প্রতিক ঘটনাবলীর আশু বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবী করেন।
আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নবপর্যায়ে গ্রেফতারী অভিযানের তীব্র নিন্দা করিয়া বলেন, ন্যাপ-সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান, পিপলস পার্টির সভাপতি জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রমুখকে গ্রেফতার করিয়া কিংবা শত শত রাজনৈতিক ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক নেতা ও কর্মী অথবা সাংবাদিক-সাহিত্যিককে বৎসরের পর বৎসর বিনাবিচারে আটক করিয়া সমস্যার সমাধান হইবে না; বরং দেশপ্রেমের মনোভাব লইয়াই সকল রাজবন্দীকে মুক্তিদান করিয়া সমস্যার সমাধান করিতে হইবে। আড়াই বৎসর যাবৎ বিনাবিচারে আটক অসুস্থ আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশতাক আজ মৃত্যু পথযাত্রী।
তিনি মানবিক কারণে খোন্দকার মোশতাক আহমদকে মুক্তি দানের দাবী জানান।
মিজানুর রহমান চৌধুরী
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী বক্তৃতা প্রসঙ্গে কনভেনশন মুসলিম লীগের চাঁইদের সতর্ক করিয়া দিয়া বলেন, “আপনারা জনাব ভুট্টোর পরিণতি হইতে শিক্ষা গ্রহণ করুন।”
তিনি আরো বলেন, যে তিনজন শক্তিধর জেনারেল পিস্তলের সাহায্যে ইস্কান্দার মীর্জাকে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করিয়াছিলেন, তাঁহারা আজ কোথায়?
একনায়কত্ববাদী শাসনে একনায়কের আসনই শুধু স্থিতিশীল।
তিনি আরো বলেন, জনৈক বিশেষ ব্যক্তির পুত্রের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স দশ বছর আগে ছিল ৬৩৬ টাকা, আর এখন ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্ণ দেন ২১ কোটি টাকা।
জনাব চৌধুরী পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যের খতিয়ান তুলিয়া ধরিয়া বলেন, গত পাক-ভারত যুদ্ধে যে বাংগালী সৈনিকরা শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিল, সেনাবাহিনীতে সেই বাংগালীদেরই স্থান হইল শতকরা মাত্র সাড়ে ৭ ভাগ।
আমেনা বেগম
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাক্তন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদিকা মিসেস আমেনা বেগম ট্যাক্স ও খাজনা আদায়ে সরকারী জুলুমের তীব্র সমালোচনা
করিয়া বলেন, কোটি কোটি টাকা মুনাফা লুণ্ঠনকারী শিল্পপতিগণ ট্যাক্স হলিডের মাধ্যমে ট্যাক্স মাফ পাইতেছেন আর ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ যে কৃষক-সমাজের সেই কৃষক-সমাজ গত কুড়ি বছরে বহুগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত খাজনা পরিশোধ করিতে যাইয়া আজ সর্বহারা।
তিনি আরো বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পশ্চিম পাকিস্তানের লারকানার অধিবাসীদের কর ইতিপূর্বে মওকুফ করা হইয়াছে। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার সর্বস্বান্ত মানুষদের ট্যাক্স- খাজনা এক পয়সাও মওকুফ করা হয় নাই; বরং সার্টিফিকেট জারী করিয়া বডিওয়ারেন্ট ও ক্রোকী পরোয়ানার মাধ্যমে খাজনা আদায় করিতে যাইয়া কৃষক সমাজকে হয়রানির মধ্যে ফেলা হইয়াছে।
তিনি আরও বলেন, আজ দেশে আইনের শাসন নাই। বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রদেশের বিভিন্ন শিক্ষায়তনের অঙ্গন আজ বিষাক্ত। প্রকাশ্যে গুণ্ডামি চলিয়াছে।
জনাব রফিকউদ্দিন ভুইয়াও সভায় বক্তৃতা করেন।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ খণ্ড: ষাটের দশক ॥ তৃতীয় পৰ্ব ॥ ১৯৬৮