আজাদ
২১ শে অক্টোবর ১৯৬৮
আওয়ামী লীগের অধিবেশন সমাপ্ত: নির্বাচন প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ মুলতবী
(ষ্টাফ রিপোর্টার)
আগামী সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করিবে, না নিৰ্বাচন বর্জ্জন করিবে, সেই সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের কার্য্যকরী পরিষদের আগামী বর্ধিত সভার উপর ন্যস্ত করা হইয়াছে। গতকাল প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের দুই দিবসব্যাপী দ্বি-বার্ষিকী সভার সমাপ্তি অধিবেশনে কার্যকর পরিষদের উপর নির্ব্বাচনের প্রশ্নটি সম্পর্কে সিদ্ধান্তের দায়িত্ব দেওয়া হইয়াছে।
কাউন্সিল অধিবেশনে অধিকাংশ বক্তাই নির্বাচন বৰ্জ্জনের পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের নেতৃবর্গের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যাপারে আলোচনা সাপেক্ষে শেষ পর্য্যন্ত এই বিষয়টির উপর সিদ্ধান্তের দায়িত্ব কার্যকরী পরিষদের সভার উপর অর্পণ করা হয়। শেখ মুজিবর রহমানকে সর্বসম্মতিক্রমে পুনরায় প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচন করা হইয়াছে এবং এক প্রস্তাবে তাহার প্রতি গভীর আস্থা প্রকাশ করা হয়। চট্টগ্রামের শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডাক্তার সায়েদুর রহমানকে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগ হইতে বহিষ্কার করা হইয়াছে বলিয়া প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধিবেশনে ঘোষণা করেন।
অধিবেশনের এক প্রস্তাবে পূৰ্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিলের বিগত অধিবেশনে গৃহীত ইস্যুভিত্তিক যৌথ আন্দোলন সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করা হইয়াছে।
প্রতিষ্ঠানের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত অধিবেশনে ঘোষণা করা হয় যে, আগামী বছর জানুয়ারী মাসে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্য্যকরী পরিষদের সভা হইবে। সমাপ্তি অধিবেশনে বিভিন্ন বক্তা তাহাদের মত প্রকাশ করেন যে, বর্তমান ব্যবস্থায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া সম্ভব নহে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ নির্ব্বাচন বর্জ্জন করাই শ্রেয় এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা উচিত হইবে না। নির্বাচন বর্জ্জনের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অধিবেশনে বেশ মতবিরোধ ও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। সমাপ্তি অধিবেশনে নির্বাচন বর্জ্জনের সিদ্ধান্ত লওয়ার জন্য জনৈক কাউন্সিলার প্রস্তাব করেন। অপর একজন কাউন্সিলার প্রস্তাব করেন যে, অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের সহিত আলোচনা চালাইয়া নিৰ্ব্বাচন সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের কার্য্যকরী কমিটির বর্ধিত সভার উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হউক। এই দুইটি প্রস্তাবের দুই দল সমর্থকদের মধ্যে অধিবেশনে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। অতঃপর দীর্ঘ আলোচনার পর সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই প্রস্তাবটি কাউন্সিলারদের ভোটাভুটির মাধ্যমে গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন এবং বলেন যে, নির্বাচন বৰ্জ্জন সিদ্ধান্ত লওয়া হইবে কি হইবে না, ইহা আলোচনা সাপেক্ষ। ইহার পর সাধারণ নির্বাচন বর্জ্জন সম্পর্কে অধিবেশনেই সিদ্ধান্ত লওয়ার প্রস্তাব উত্থাপনকারী কাউন্সিলর তাহার প্রস্তাব প্রত্যাহার করেন। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতামত যাচাইয়ের পর কার্য্যকরী পরিষদের আগামী বৰ্দ্ধিত সভায় নির্বাচন সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম অধিবেশনে জানান যে, ডাক্তার সায়েদুর রহমানকে ইতিমধ্যেই চট্টগ্রাম জেলা শহর আওয়ামী লীগ হইতে বহিষ্কার করা হইয়াছে এবং এই বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের পত্র আমাদের নিকট পৌঁছিয়াছে। তাহাকে কার্যকরী পরিষদের আগামী বর্ধিত সভায় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পার্টি হইতে বহিষ্কার করা হইবে।
সমাপ্তি অধিবেশনে আওয়ামী লীগ ও প্রাদেশিক পরিষদের যুক্ত পালামেন্টারী পার্টির নেতা জনাব আবদুল মালেক উকিল আগামী দুই বছরের জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সংসদের কর্ম্মকর্তা নির্বাচনের উদ্দেশ্যে প্যানেল পাঠ করেন। শেখ মুজিবর রহমানকে পুনরায় সভাপতি করিয়া কেন্দ্রীয় সংসদের পূর্ববর্তী সকল কর্মকর্তার নামই প্যানেলে ঘোষণা করা হয়। জনাব মালেক উকিল বলেন যে, কারাগারে আটক আমাদের নেতা শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি আস্থা ও অন্যান্য আটক আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যেই পুনরায় কেন্দ্রীয় সংসদের পূর্ব্ববর্ত্তী কর্মকর্তাদের নাম প্রস্তাব করা হইয়াছে। প্যানেলে একমাত্র সাংগঠনিক সম্পাদক ছাড়া অন্যান্য সকলের নাম সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। জনৈক কাউন্সিলার সাংগঠনিক সম্পাদকের পদে মিসেস আমেনা বেগমের নাম প্রস্তাব করেন। পরে এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করা হয়। দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগ গঠনতন্ত্রের সংশোধনীর মাধ্যমে কৃষি সম্পাদক নামে একটি নতুন পদ সৃষ্টি করা হইয়াছে।
প্রস্তাবাবলী
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিকী কাউন্সিল সভার সমাপ্তি অধিবেশনে গৃহীত প্রথম প্রস্তাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর অগ্রনায়ক প্রখ্যাত সাংবাদিক-সাহিত্যিক, প্রবীণ চিন্তানায়ক মওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁর এন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়।
অপর এক প্রস্তাবে পূৰ্ব্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি পূর্ণ অবস্থা জ্ঞাপন করা হয়। আরও একটি প্রস্তাবে শেখ মুজিবর রহমানসহ সকল রাজনৈতিক বন্দীদের সকল প্রকার রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের দাবী জানাইয়া তাহাদের মুক্তি দাবী করা হইয়াছে।
ইহাছাড়া পূৰ্ব্ব পাকিস্তানে চিরস্থায়ী বন্যা নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা সংকোচন নীতি বর্জ্জন এবং ভিয়েতনামে মার্কিনী হামলা বন্ধ করার দাবী করিয়া আরও কতিপয় প্রস্তাব গৃহীত হইয়াছে।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ খণ্ড: ষাটের দশক ॥ তৃতীয় পৰ্ব ॥ ১৯৬৮