সংবাদ
২১শে অক্টোবর ১৯৬৮
পল্টন ময়দানে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জনসভা:
৬-দফা কর্মসূচী জরুরী দাবী-দাওয়া ভিত্তিক আন্দোলন গড়িয়া তোলার পরিপন্থী
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
গতকাল রবিবার পল্টন ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত বিরাট জনসভায় সভাপতির ভাষণদান প্রসঙ্গে জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন যে, ৬-দফা কর্মসূচী, প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার, প্রত্যক্ষ নির্বাচন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, রাজবন্দীদের মুক্তি, জরুরী অবস্থার প্রত্যাহার, খাদ্যশস্যসহ নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যমূল্য হ্রাস প্রভৃতি আশু ও জরুরী দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের অন্তরায় নয়। তিনি আন্দোলনের জন্য ঐক্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান।
জনাব নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ৬-দফার বিরুদ্ধবাদী এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ উত্থাপনকারীদের ‘প্রচারণার’ কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি ৬-দফার ব্যাখ্যাদান প্রসঙ্গে বলেন যে, আওয়ামী লীগ শক্তিশালী কেন্দ্রের পরিবর্তে শক্তিশালী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রয়াসী।
তিনি বলেন যে, ২২টি ধনিক পরিবারের স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানকে পণ্যের বাজারে পরিণত করা এবং পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পাচার বন্ধের দাবী ৬- দফা কর্মসূচীতে সন্নিবেশিত করিয়া তাহারা পাকিস্তানের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর কোন কাজ করেন নাই। তিনি বলেন যে, পাকিস্তানের দুইটি অঞ্চল শক্তিশালী হইলে পাকিস্তান শক্তিশালী হইবে। যাহারা শক্তিশালী কেন্দ্রের কথা বলেন, তাহাদের মানসিকতা গণতান্ত্রিক ভাবধারা লালিতপালিত নয়। তিনি বলেন, শক্তিশালী কেন্দ্র সাম্রাজ্যে শোভা পায়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নয়।
তিনি জিজ্ঞাসা করেন, বিচ্ছিন্নতাবাদ আওয়ামী লীগের কাম্য হইলে প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক দফতর কেন্দ্রের হস্তে দিতে আওয়ামী লীগ সম্মত কেন?
তিনি ৬-দফার ব্যাখ্যাদান প্রসঙ্গে আরো বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান হইতে অর্থ পাচার বন্ধ করা হইলে এবং পূর্ব পাকিস্তানকে উহার বঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার ন্যায্য অংশ প্রদানের নিশ্চয়তা প্রদান করা হইলে আওয়ামী লীগ অর্থ দফতরও কেন্দ্রের হস্তে ছাড়িয়া দিতে সম্মত রহিয়াছে।
দেশরক্ষা ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার প্রয়োজনীয়তার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া পূর্ব পাকিস্তানে যে একটি আধা সামরিক বাহিনী গঠনের প্রস্তাব ৬-দফায় করা হইয়াছে উহাতে বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ কেমন করিয়া থাকিতে পারে তাহা বুঝিতে তিনি অক্ষম বলিয়া জানান। তিনি বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা এই প্রদেশের প্রতিরক্ষার প্রশ্নকে কখনই পরমুখাপেক্ষী সর্বনাশ ও বিনিময়ের বিষয়ে পরিণত হইতে দিতে পারে না।
সভায় জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী, জনাব আবদুল মালেক উকিল, জনাব কাজী মোহাম্মদ ফয়েজ, জনাব নুরুল হক, জনাব রফিক উদ্দিন ভুঁইয়া, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখ বক্তৃতা করেন। ইহা ছাড়া সন্দীপের জনাব শফি মিঞা দুইটি সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
বৈদেশিক ঋণ
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে পুঁজিপতিদের ভাগ্য উন্নয়নের সমালোচনা করিয়া বলেন যে, বর্তমানে বিদেশী ঋণের পরিমাণ প্রায় দুই হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াইয়াছে। প্রাক্ উন্নয়ন দশক আমলে বিদেশী ঋণ শোধ করিতে যে ক্ষেত্রে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় শতকরা এক ভাগের প্রয়োজন পড়িত বর্তমানে তাহা শতকরা ২৫ ভাগে উন্নীত হইয়াছে বলিয়া তিনি জানান। তিনি বলেন যে, এই বৈদেশিক ঋণ পুঁজিপতিদের স্বার্থে-আনা হইয়াছে, উহার সুযোগ ১১ কোটি মানুষের নিকট পৌঁছে নাই।
তারবেলা হোক্ কিন্তু আমাদের বেলায় কার্পণ্য কেন?
তিনি বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে মঙ্গলা বাঁধ নির্মাণ করা হইয়াছে, লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা দূর করিয়া আবাদী জমির পরিমাণ বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলিতেছে-তারবেলা নির্মিত হইতেছে ইহাতে পূর্ব পাকিস্তানী জনসাধারণ অসন্তুষ্ট নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বহারা মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হোক-পূর্ব পাকিস্তানী জনসাধারণ তাহা চায়। কিন্তু প্রতি বৎসর যে বন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় একশত কোটি টাকার শস্য-সম্পদ বিনষ্ট হইতেছে, সেই বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কার্পণ্য কেন? তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের উপরোক্ত প্রকল্পসমূহের ন্যায় পূর্ব পাকিস্তানের বন্যাও এজমালী তহবিল হইতে নিয়ন্ত্রণের দাবী জানান।
সেনাবাহিনীতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানীর সংখ্যা
জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিরাজমান বৈষম্য দূর করার দাবী জানাইয়া বলেন যে, সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানীর সংখ্যা যেক্ষেত্রে সাড়ে ৯২ ভাগ সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানীর সংখ্যা সাড়ে ৭ ভাগ মাত্র। অথচ শৌর্যবীর্য্যে পূর্ব পাকিস্তানীরা যে কাহারো চাইতে কম নয় বিগত পাক-ভারত যুদ্ধ তাহার প্রমাণ বলিয়া তিনি উল্লেখ
করেন।
ট্যাক্সের বোঝা
জনাব চৌধুরী ট্যাক্সের হার বৃদ্ধির তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে, সাম্প্রতিককালে এক টাকার ট্যাক্স ১১ টাকায় দাঁড়াইয়াছে। তাহার উপর আবার বসানো হইয়াছে শতকরা ৫৫ ভাগ উন্নয়ন কর। ইহা ছাড়া বহু নূতন নূতন ট্যাক্স ধার্য করা হইয়াছে।
শক্তিশালী পাকিস্তান
জনাব আবদুল মালেক উকিল স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগের তীব্র সমালোচনা করিয়া বলেন যে, আওয়ামী লীগের প্রত্যেকটি নেতা ও কর্মী এবং পাকিস্তানের প্রতিটি মানুষ খাঁটি দেশপ্রেমিক নাগরিক। তিনি বলেন যে, আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে যে স্বার্থান্বেষী মহল এই অভিযোগ উত্থাপন করেন, প্রকৃতপক্ষে তাহারাই দেশের গুরুতর ক্ষতিসাধন করিতেছেন। তিনি শক্তিশালী কেন্দ্র নয়— সুখী, সমৃদ্ধিশালী ও শক্তিশালী পাকিস্তান গড়াই আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য বলিয়া মন্তব্য করেন।
একটি পয়সা মাফ করা হয় নাই
জনাব আবদুল মালেক উকিল চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল এবং প্রদেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলাগুলির সাম্প্রতিক বন্যা দুর্গত মানবতার নিদারুণ অবস্থার উল্লেখ করিয়া বলেন যে, বড় বড় পুঁজিপতিদের ‘ট্যাক্স হলিডে’ প্রদান করা হইতেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পশ্চিম পাকিস্তানের লারকানার অধিবাসীদের ইতিপূর্বে কর মওকুফ করা হইয়াছে, অথচ পূর্ব পাকিস্তানের দুর্গত মানবতার উপর হইতে এক কপর্দকও কর মওকুফ করা হয় নাই; বরং সার্টিফিকেট জারীর মাধ্যমে হয়রানি করা হইতেছে।
উন্নয়ন দশক
জনাব মালেক উকিল উন্নয়ন দশক উদযাপন অন্তঃসারশূন্য বলিয়া অভিহিত করেন। তিনি বলেন যে, উন্নয়ন দশকে উন্নয়নের প্রচারণা ভুয়া। জনাব মালেক উকিল উন্নয়ন দশকে কেবলমাত্র দুর্নীতি ও জনসাধারণের দুর্গতের প্রসার ঘটিয়াছে বলিয়া মন্তব্য করেন।
আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতি
পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক জনাব কাজী ফয়েজ মোহাম্মদ আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতির সমর্থন এবং লিঙ্গুরা ফ্রাঙ্কার সমালোচনা করিয়া বলেন যে, প্রত্যেকটি অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতির অবাধ শিক্ষা একান্ত অপরিহার্য। উহা পাকিস্তানী জাতীয়তার পক্ষে হানিকর নয়। তিনি বাঙ্গালী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, বেলুচী প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষাভাষীর আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ভাষার স্বাধীন বিকাশের অপরিহার্যতা ব্যাখ্যা করেন।
নেতার ঐক্য নয়
প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য জনাব নূরুল হক বর্তমান অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন করিয়া দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকল্পে গুটিকতক নেতার ঐক্য নয়- জনতার ঐক্য প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। তিনি দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করিয়া সর্বপ্রকার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের উপর জোর দেন।
ভাষার উপর হস্তক্ষেপ
জনাব রফিক উদ্দিন ভূইয়া বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে চক্রান্তের ব্যাপারে সকলকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান৷
ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলন
ক্যাপ্টেন মনসুর আলী বলেন যে, আমাদের সমস্যা একটি— তাহা হইল আমরা বাঁচিব, না মরিব এবং বাঁচার মত বাঁচিতে হইলে ঐক্যবদ্ধ গণ- আন্দোলন প্রয়োজন।
সংগ্রাম অসত্যের বিরুদ্ধে
জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী বন্যা, ভাষা, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করিয়া আওয়ামী লীগের সংগ্রাম শোষণ, নির্যাতন, অসত্য ও অসুন্দরের বিরুদ্ধে বলিয়া মন্তব্য করেন।
প্রস্তাব
সভায় শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ আস্থা, রাজবন্দীর মুক্তি, রাজনৈতিক মামলা-মোকদ্দমা প্রত্যাহার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বন্যা দুর্গতদের পর্যাপ্ত সাহায্যদান, দীর্ঘমেয়াদী কৃষি ঋণসহ দুর্গত জনসাধারণকে অন্যান্য ঋণদান, ক্রুগ মিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন এবং ৬-দফা বাস্তবায়নে দুর্বার আন্দোলন গড়িয়া তোলার আহ্বান জানাইয়া প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা
সভায় গৃহীত অপর এক প্রস্তাবে ‘লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা’ বা সংহতির নামে বাংলা ভাষার উপর কোন প্রকার আঘাত সহ্য করা হইবে না এবং রাষ্ট্রভাষা লইয়া কোনরূপ বিতর্ক সৃষ্টি এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার আবদার অব্যাহত থাকিলে ৬ কোটি বাংলাভাষী শতকরা ৫৬ জন পাকিস্তানীর মুখের ভাষা বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে দাবী করিতে ও তজ্জন্য মৃত্যুপণ করিতে বাধ্য হইবেন বলিয়া ঘোষণা করা হয়।
ইহা ছাড়া সভায় জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ‘ইত্তেফাক’-এর ছাপাখানা বাজেয়াপ্তি আদেশ প্রত্যাহার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য হ্রাস, শ্রমিক শোষণ বন্ধ ও তাহাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক প্রদান, প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান, দেশরক্ষা আইনে বন্দী খোন্দকার মুশতাক আহমদকে চিকিৎসার্থ হাসপাতালে স্থানান্তর এবং শিক্ষাসংকোচন ও ছাত্র নির্যাতন বন্ধ প্রভৃতি দাবী জানাইয়া কতিপয় প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ খণ্ড: ষাটের দশক ॥ তৃতীয় পৰ্ব ॥ ১৯৬৮