সংবাদ
২১শে অক্টোবর ১৯৬৮
আওয়ামী লীগ শক্তিশালী কেন্দ্রের কাউন্সিল অধিবেশন সমাপ্ত: শেখ মুজিব পুনর্বার সভাপতি নির্বাচিত
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)
আসন্ন সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে আগামী ৩ মাসের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব প্রাদেশিক কার্যকরী কমিটির বর্ধিত সভার উপর অর্পণ করিয়া সকল বিরোধীদলের প্রতি জনগণের জরুরী দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে সত্যিকারের আন্দোলনের জন্য ঐক্য গঠনের আহ্বান জানাইয়া, শেখ মুজিবর রহমানের উপর আস্থার পুনরুক্তি করিয়া এবং আগামী ২ বৎসরের জন্য তাঁহাকে পুনর্বার সভাপতি এবং দেশরক্ষা বিধিবলে আটক জনাব তাজুদ্দিন আহমদকে পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করিয়া গতকাল (রবিবার) পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন সমাপ্ত হইয়াছে।
অধিবেশন শেষে গতকাল অপরাহ্নে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভা শেষে এক শোভাযাত্রা শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। জনসভা ও শোভাযাত্রায় ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার দিতে হবে’, ‘জরুরী অবস্থার অবসান চাই’, ‘বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা চাই’, ‘৬-দফা জিন্দাবাদ’ ‘বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বন্ধ কর’ প্রভৃতি ধ্বনি প্রদান করা হয়।
গতকাল কাউন্সিল সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে গৃহীত এক রাজনৈতিক প্রস্তাবে আগামী সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে জানুয়ারী মাসের মধ্যেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব কার্যকরী কমিটির এক বিশেষ বর্দ্ধিত সভার উপর অর্পণ করা হইয়াছে। প্রস্তাবে বলা হয় যে, যেহেতু সমগ্র পাকিস্তানে জরুরী আইন বলবৎ রাখা হইয়াছে, যেহেতু মৌলিক গণতন্ত্রে জনগণের ভোটাধিকার নাই, যেহেতু জনসাধারণের বাকব্যক্তি স্বাধীনতা রুদ্ধ করা হইয়াছে, জেল-জুলুম ও চরম নির্যাতনে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের নাজেহাল করা হইতেছে, সেহেতু দেশে কোন স্বাধীন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইতে পারে না এবং এই নির্বাচনের ফলাফলে জনমত প্রতিফলিত হইতে পারে না। উপরোক্ত অবস্থার পর্যালোচনা করিয়া এবং অন্যান্য বিরোধীদলের সহিত এই ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করিয়া জানুয়ারী মাসের মধ্যেই আগামী নির্বাচন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব প্রাদেশিক কার্যকরী কমিটির এক বিশেষ বর্ধিত সভার প্রতি প্রদান করা হইতেছে। এই সভায় প্রাদেশিক কমিটির সদস্যবৃন্দ ছাড়াও জেলা ও মহকুমাসমূহের সভাপতি ও সম্পাদকগণ উপস্থিত থাকিবেন। বিষয় নির্বাচনী কমিটির পক্ষে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক জনাব কামরুজ্জামান এম, এন, এ, প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন এবং সমর্থন করেন জনাব নূরুল হক এডভোকেট।
এই প্রস্তাবটি লইয়াই কাউন্সিল অধিবেশনে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামের জনাব এম, এ, আজিজ একটি পাল্টা প্রস্তাব উত্থাপন করিয়া এই কাউন্সিলেই নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আহ্বান জানান। তদীয় প্রস্তাবের সমর্থনে তিনি বলেন যে, এই ব্যাপারে কালক্ষেপণ করা উচিত হইবে না। পরবর্তী পর্যায়ে তিনি বিষয়-নির্বাচনী কমিটির প্রস্তাবের স্বপক্ষে স্বীয় প্রস্তাব প্রত্যাহার করেন। এই প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপনের পূর্বেই ইহার মর্মের স্বপক্ষে বক্তৃতা করেন খুলনা জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব শেখ আবদুল আজিজ, চট্টগ্রাম সিটি আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী ও নোয়াখালী জেলা সম্পাদক জনাব নূরুল হক এম, পি, এ ও জনাব আবদুল মালেক উকিল। জনাব এম, এ, আজিজের প্রস্তাবের মর্মের অনূকুলে বক্তৃতা করেন মিসেস আমেনা বেগম।
কাউন্সিল অধিবেশনে প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার, রাজবন্দী মুক্তি, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি জরুরী দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ গণ-আন্দোলনে শামিল হওয়ার জন্য সকল বিরোধীদলের প্রতি আহ্বান সম্বলিত ইতিপূর্বেকার দলীয় সিদ্ধান্তের পূনরুক্তি করা হয়।
কাউন্সিল অধিবেশনে সর্বসম্মতক্রমে নিম্নোক্ত কর্মকর্তাগণকে নির্বাচিত করা হয়।
সভাপতি শেখ মুজিবর রহমান, সহ-সভাপতি-সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও খোন্দকার মুশতাক আহমদ (দেশরক্ষা বিধিবলে কারারুদ্ধ), সাধারণ সম্পাদক- জনাব তাজুদ্দিন আহমদ (কারারুদ্ধ), সাংগঠনিক সম্পাদক-জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী, প্রচার সম্পাদক-এ্যাডভোকেট আবদুল মোমেন (কারারুদ্ধ) ও শ্রম সম্পাদক-জহুর আহমদ চৌধুরী, কৃষি সম্পাদক- (নূতন সৃষ্ট পদ)-জনাব সোহরাব হোসেন, দপ্তর সম্পাদক-জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ; মহিলা সম্পাদিকা- মিসেস আমেনা বেগম, সাংস্কৃতিক, সমাজকল্যাণ, সাহায্য ও পূনর্বাসন সম্পাদক- জনাব ওবায়েদুর রহমান (কারারুদ্ধ)। কোষাধ্যক্ষ-মুহিবুস সামাদ।
কার্যকরী কমিটির সদস্যগণ সভাপতি কর্তৃক মনোনীত হইবেন। কাউন্সিলে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিলারদেরও নির্বাচিত করা হয়।
কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন এবং তাঁহার বিরুদ্ধে আনীত সকল রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার ও সকল রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে আনীত মামলা প্রত্যাহারের দাবী করা হয়।
রাজবন্দীর মুক্তি
অপর এক প্রস্তাবে বন্দী আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, শ্রমিক, ছাত্র ও গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দের বিনাশর্তে আশু মুক্তি দাবী করা হয়।
রংপুর-দিনাজপুরকে দূর্ভিক্ষ এলাকা ঘোষণার দাবী
অপরাপর প্রস্তাবে বন্যার্তদের জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য প্রদান, রংপুর ও দিনাজপুর জেলাকে দুর্ভিক্ষ এলাকা ঘোষণা, বন্যা-উপদ্রুত এলাকায় যাবতীয় ঋণ ও খাজনা মওকুফ, বন্যা সমস্যাকে জাতীয় সমস্যায় হিসাবে বিবেচনাপূর্বক ত্বরিৎ বন্যা নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ, জরুরী অবস্থার অবসান, দমননীতির অবসান, সকল নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কায়েম, ‘ইত্তেফাকের’ বাজেয়াপ্তি আদেশ প্রত্যাহার, শিক্ষা সংকোচন নীতির অবসান, বেসরকারী কলেজসমূহের প্রাদেশিকীকরণের নীতি প্রত্যাহার, সকল ছাত্রের জন্য উচ্চশিক্ষার দ্বার অবারিত করা, আই-এল-ও সনদ অনুযায়ী সকল শ্রম আইন প্রণয়ন, মোহাজের সম্পত্তি এওয়াজ হস্তান্তর (এক্সচেঞ্জ) রেজিষ্ট্রীকরণ, মোহাজেরদের পুনর্বাসন, উপদ্রুত ব্যক্তি অর্ডিন্যান্স বাতিল, শত্রু সম্পত্তিকে ব্যক্তিগত মালিকানায় তুলিয়া দেওয়ার পরিবর্তে ঐগুলিকে সরকারী মালিকানায় আনয়ন ইপিআইডিসি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহকে পুঁজিপতিদের হাতে না দিয়া মিল শ্রমিকদের যৌথ মালিকানায় হস্তান্তর করা, সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের জন্য জনাব আবদুল কুদ্দুস এডভোকেট জামিনের আবেদন জানান। প্রতি ২ বৎসর অন্তর অন্তর ন্যূনতম বেতন বোর্ড গঠন, পাটের ন্যায্যমূল্য প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ, সার্টিফিকেট যোগে খাজনা আদায় বন্ধ করার দাবী এবং নূতন করিয়া ভাষার প্রশ্ন উত্থাপন করার বিপদ সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ, ফারাক্কা বাঁধ প্রশ্নে সরকারী ব্যর্থতার নিন্দা এবং ভিয়েনাম হইতে মার্কিনী সেনার অপসারণ এবং মধ্যপ্রাচ্যের দখলীকৃত আরব এলাকা হইতে ইসরাইলী সৈন্য প্রত্যাহারের দাবী জানান হয়।
সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে চট্টগ্রামের ডঃ সাইদুর রহমানকে আওয়ামী লীগ সংগঠন হইতে বহিষ্কার করা হয়।
কর্মসূচীর ব্যাখ্যা প্রদান
সমাপ্তি অধিবেশনে খুলনার জনাব শেখ আবদুল আজিজ আওয়ামী লীগের কর্মসুচী সম্পর্কে প্রতিটি সদস্যের পরিষ্কার ধারণা রাখার উপর জোর দেন। তিনি বলেন যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি এবং স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির যে দাবী আওয়ামী লীগের মেনিফেষ্টোর অন্তর্ভূক্ত হইয়াছে, দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে উহার তাৎপর্য উপলব্ধি করার জন্য আওয়ামী লীগ সদস্যদের অনুরোধ জানান। আওয়ামী লীগ কর্মীদের প্রতি তিনি শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতী মধ্যবিত্তের জীবন সংগ্রামের সাথী হওয়ার এবং ৬-দফা ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রামে ত্যাগের মনোভাব লইয়া অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানান। জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে নূতন ধারায় অগ্রসর করিয়া লওয়ায় এবং আন্দোলনের জন্য সম্ভাব্য ব্যাপকতম গণতান্ত্রিক ঐক্য গঠনের গুরুত্বও তিনি ব্যাখ্যা করেন।
মিসেস আমেনা বেগম বলেন যে, “জনসাধারণের সংগ্রামী মনোভাবের উপর আমাদের আস্থা রাখিতে হইবে।” তিনি নির্বাচন বর্জনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন।
সমাপ্তি অধিবেশনে জনাব আবদুল মালেক উকিল, জনাব জহুর আহমদ চৌধূরী ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনও বক্তৃতা করেন।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ খণ্ড: ষাটের দশক ॥ তৃতীয় পৰ্ব ॥ ১৯৬৮