You dont have javascript enabled! Please enable it!

দৈনিক পয়গাম
২১শে অক্টোবর ১৯৬৮
আওয়ামী লীগ কাউন্সিল: নরমে-গরমে লড়াই
(ষ্টাফ রিপোর্টার)

আগামী সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডা ও হৈ চৈ-এর মধ্যে কোনরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছাড়াই গতকল্য (রবিবার) ছয়দফাপন্থী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন সমাপ্ত হয়।
সমাপ্তি অধিবেশনে শেখ মুজিবর রহমান ও জনাব তাজুদ্দিন আহমেদ যথাক্রমে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে পুননির্বাচিত হন। দলীয় নির্বাচনের প্রশ্নেও কাউন্সিলরদের মধ্যে সর্বক্ষণ বাকযুদ্ধ চলিতে থাকে এবং এক এক পর্যায়ে হাতাহাতিরও উপক্রম হয়।
গতকল্য (রবিবার) সকালে অধিবেশন শুরু হইলে প্রথমে অসমাপ্ত জেলা রিপোর্ট পেশ করা হয়। পরে আগামী সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রশ্নে কেহ কেহ নির্বাচন বর্জন করার দাবী উত্থাপন করেন। এই ব্যাপারে কোন কোন নেতার ‘নরম নীতির’ বিরুদ্ধে কাউন্সিলরদের বিক্ষোভ প্রদর্শন করিতে দেখা যায়। ফলে ক্রমেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হইয়া উঠে এবং সম্মেলন প্যাণ্ডেলে এক বিশৃঙ্খলা অবস্থার উদ্ভব হয়। অতঃপর এই ব্যাপারে অধিক ঘাঁটাঘাঁটি করা সঙ্গত বিবেচনা না করিয়া এই প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব প্রাদেশিক কার্যনির্বাহক কমিটির উপর ন্যস্ত করা হয়। দলীয় নির্বাচনের প্রশ্নে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী ও মিসেস আমেনা বেগমের সমর্থকদের মধ্যেই তীব্র বাকযুদ্ধ হয় এবং এক পর্যায়ে বাকযুদ্ধ হাতাহাতিতে রূপান্তরিত হওয়ার উপক্রম দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত একাধিক গ্রুপ বৈঠকের পর পরিস্থিতি আয়ত্তে আসে এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীকেই উক্ত পদে নির্বাচিত করা হয়।
উল্লেখযোগ্য যে, সাংগঠনিক সম্পাদকই ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করিবেন। এছাড়া সৈয়দ নজরুল ইসলামও ভারপ্রাপ্ত সভাপতির পদে পুনরায় নির্বাচিত হইয়াছেন।
চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম রাজসাক্ষী ডঃ সাইদুর রহমানের বহিষ্কারের প্রশ্নেও আর একদফা হৈচৈ হয়। পরে সম্মেলনের সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানান যে, ডঃ রহমানের বহিষ্কারের জন্য চট্টগ্রাম কমিটি যে প্রস্তাব করিয়াছেন প্রাদেশিক কমিটিতে তাহা বিবেচনাধীন রহিয়াছে।
চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব জহুর আহমেদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এবং প্রখ্যাত শিল্পপতি জনাব এম, আর, সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে পার্টি বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ উত্থাপন করিলে আর একবার গোলযোগের সূত্রপাত হয়। সামগ্রিকভাবে শুরু হইতে শেষ পর্যন্ত কাউন্সিল অধিবেশনে বিশৃঙ্খলা অবস্থা অব্যাহত থাকে।
সম্মেলনে গৃহীত বিভিন্ন প্রস্তাবে ভিয়েতনামে মার্কিন হামলার নিন্দা করা হয় এবং ভিয়েনাম ও প্যালেষ্টাইনের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রতি সমর্থন জানান হয়।
ইহাছাড়াও বহু সংখ্যক প্রস্তাব গ্রহণ করা হইলেও কাশ্মীর সমস্যার সমাধান অথবা কাশ্মীরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে কোন প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় নাই।

পল্টনে জনসভা
গতকল্য (রবিবার) অপরাহ্নে পল্টন ময়দানে ছয়দফাপন্থী আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী, প্রাদেশিক পরিষদে বিরোধীদলের অন্যতম নেতা জনাব আবদুল মালেক উকিল, পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কাজী ফয়েজ মোহাম্মদ, চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা জনাব জহুর আহমেদ চৌধুরী, জনাব নূরুল হক এম, পি, এ, ময়মনসিংহের আওয়ামী লীগ নেতা জনাব রফিকুদ্দিন ভুইয়া এবং পাবনার আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মনসুর আলী সভায় বক্তৃতা করেন।
সভায় আওয়ামী নেতৃবৃন্দ প্রদেশের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান সম্পর্কে কোনরূপ বাস্তব ও গঠনমূলক সুপারিশ না করিয়া চিরাচরিত অগ্নিখরা ভাষায় কেন্দ্রীয় সরকারে বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, “শক্তিশালী কেন্দ্রের উপর আঘাত হানাই ছয়দফার লক্ষ্য।”
তিনি বলেন যে, ছয়দফার মধ্যে এমন কিছু নাই যাহার জন্য অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের হুমকি প্রদান করা যাইতে পারে।
জনাব ইসলাম ভারতের সহিত সহযোগিতা, জরুরী অবস্থার প্রত্যাহার এবং বর্তমানে শাসনতন্ত্র বাতিলের দাবী জানান।
সিন্ধুর হারী নেতা এবং পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কাজী ফয়েজ মোহাম্মদ পরোক্ষভাবে এক ইউনিট বাতিলের দাবী জানান। তিনি বলেন, পাকিস্তানকে পূর্ব ও পশ্চিম- এই দুই নামে নামকরণ করিয়া বাঙ্গালী, সিন্ধী, পাঠান ও বেলুচী নাম মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। তিনি পাকিস্তানের প্রতিটি আঞ্চলিক ভাষার উন্নয়ন দাবী করেন এবং লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কার সমালোচনা করেন।
হারী নেতা পাকিস্তানের এক অঞ্চলের সম্পদ অন্য অঞ্চলের জন্য ব্যবহারকে অন্যায় বলিয়া উল্লেখ করেন।
ময়মনসিংহের জনাব রফিকুদ্দিন ভূঁইয়া বলেন যে, নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ফলপ্রসূ না হইলে অন্য পন্থা অবলম্বনের বিষয় বিবেচনা করা হইবে।
জনাব আবদুল মালেক উকিল কোরিয়া যুদ্ধের সময় (মরহুম লিয়াকত আলী খান তখন পাকিস্তানের উজিরে আজম ছিলেন) পাট বিক্রয় হইতে ৪০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিরোধের জন্য ১০০ কোটি টাকাও ব্যয় না করার সমালোচনা করেন।
তিনি রংপুর-দিনাজপুর এলাকার বন্যাদুর্গত জনসাধারণের প্রতি চিরাচরিত প্রথার মৌখিক সহানুভূতি প্রকাশ করেন।
জনাব আবদুল মালেক উকিলের মতে আওয়ামী লীগ বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে বিশ্বাসী হইলে পূর্ব পাকিস্তানে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরী এবং করাচী হইতে নৌ-বাহিনীর সদর দফতর স্থানান্তরের দাবী জানাইতেন।
আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এম, এন, এ, বক্তৃতা প্রসঙ্গে অভিযোগ করেন যে, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানীরা শৌর্যের পরিচয়দানের পরও সেনাবাহিনীতে শতকরা মাত্র সাড়ে সাত ভাগ পূর্ব পাকিস্তানীকে ভর্তি করা হইয়াছে। প্রদেশে স্থায়ী বন্যা নিরোধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কিছুই করেন নাই বলিয়া তিনি ঢালাও অভিযোগ করেন।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ খণ্ড: ষাটের দশক ॥ তৃতীয় পৰ্ব ॥ ১৯৬৮

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!