You dont have javascript enabled! Please enable it!

সংবাদ
২০শে অক্টোবর ১৯৬৮
জরুরী দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে সকল রাজনৈতিক দলসমূহকে
ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনে শরিক হইতে হইবে:
ঢাকায় আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন শুরু
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)

গতকাল (শনিবার) সকালে ঢাকার হোটেল ইডেনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধনী অধিবেশনে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জরুরী দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শামিল হওয়ার জন্য সকল বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি ঘোষণা করেন যে, গণ-আন্দোলনের জন্যই আওয়ামী লীগ ঐক্য কামনা করে, অন্য কোন প্রয়োজনে নয়।
তিনি বলেন, ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণের মধ্যে আজ ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি করিতে হইবে।
গতকাল সকাল ১০টায় মোট ১৪৫৩ জন কাউন্সিলার ও ডেলিগেটের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়।
সম্মেলনের উদ্বোধন করেন ইত্তেফাক সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিঞা)। তিনি অসুস্থ বিধায় উপস্থিত হইতে পারেন নাই। তাঁহার উদ্বোধনী ভাষণ পাঠ করিয়া শোনান হয়।
উদ্বোধনী অধিবেশনে বিশেষ আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে যোগদান করেন পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির অন্যতম নেতা জনাব মহিউদ্দীন আহমদ এবং পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ-এর যুগ্ম-সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান।
উদ্বোধনী অধিবেশনে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এম-এন-এ, সম্পাদকের রিপোর্ট পেশ করেন। এই অধিবেশনে মরহুম মওলানা আকরম খাঁ এবং আওয়ামী লীগের পরলোকগত নেতা ও কর্মীদের নামে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
সম্মেলন প্যাণ্ডেলটি “৬-দফা জিন্দাবাদ,” “শেখ মুজিব জিন্দাবাদ,” “রাজবন্দীদের মুক্তি চাই,” “প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার দিতে হবে”, “গণতন্ত্র কায়েম কর,” “একনায়কত্ব চলবে না,” “জরুরী আইন বাতিল কর”, “বন্যার স্থায়ী সমাধান চাই,” “সোনার বাংলা শ্মোশান কেন”? প্রভৃতি দাবী সম্বলিত অসংখ্য পোষ্টারে সুশোভিত করা হয়। প্যাণ্ডেলের সম্মুখভাগে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবের প্রতিকৃতি টাঙ্গান হয়।
সম্মেলন চলাকালে কাউন্সিলার-ডেলিগেটরা মূহুর্মুহু “নির্বাচন বর্জন কর”, “সংগ্রামে মুক্তি” প্রভৃতি ধ্বনি প্রদান করেন।
সম্মেলনে সন্দ্বীপের শফি মিঞাসহ কয়েকজন কয়েকটি গণ-সঙ্গীত পরিবেশন করেন।

৬-দফা আংশিক কর্মসূচী
সভাপতির ভাষণে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিরোধীদলীয় ঐক্যের আহ্বান জানান ছাড়াও আওয়ামী লীগ সংগঠনকে সর্বত্র ছড়াইয়া দেওয়ার জন্য কর্মীদের অনুরোধ করেন। তিনি আওয়ামী লীগের কর্মসূচী ও লক্ষ্য এবং ৬- দফা কর্মসূচীর ব্যাখ্যাও প্রদান করেন।
তিনি বলেন যে, ৬-দফা আওয়ামী লীগের পরিপূর্ণ মেনিফেষ্টো নয়। ইহা মেনিফেষ্টোর একটি প্রধান অংশ মাত্র।
তিনি আরও বলেন যে, আওয়ামী লীগ ইহার মেনিফেষ্টোতে দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমের কর্মসূচী অন্তর্ভুক্ত করিয়াছে। তবে এই প্রসঙ্গে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করিয়া তিনি জানান, “সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দ্বারা আওয়ামী লীগ জনগণের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করিয়া বিশেষ পার্টি তথা একশ্রেণীর ব্যুরোক্রেটিক ডিক্টেটরশীপ-এর প্রবর্তন করিতে চায় না।”
তিনি আরও বলেন যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ৬-দফার আশু রূপায়ণ আওয়ামী লীগ কর্তব্য বলিয়া মনে করে। ৬-দফা কর্মসূচী বাস্তবায়িত হইলে একচেটিয়া পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর পণ্যদ্রব্যের বাজার হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানকে ব্যবহার করা আর চলিবে না এবং পূর্ব পাকিস্তানে উৎপন্ন কাঁচামাল রপ্তানি মারফত অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা আত্মসাত করিয়া বর্তমানে যে একচেটিয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হইয়াছে উহারও ভিত্তিমূল ধসিয়া পড়িবে।
জনাব নজরুল ইসলাম ৬-দফা কর্মসূচী সম্পর্কে নিজস্ব ব্যাখ্যা প্রদান করিয়া বলেন যে, ইহার দ্বারা তিনি পূর্ণ গণতন্ত্র, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, আন্তঃজাতিসত্তা ভুল বুঝাবুঝির অবসানের জন্য একটি সত্যিকারের ফেডারেল শাসনতন্ত্রের প্রবর্তন, মুষ্টিমেয় ২২টি শিল্পপতি পরিবারের শোষণ বন্ধকরণ, পূর্ব পাকিস্তানের তথা সারা পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজিবাদের অবসান সাধারণ মানুষ কল্যাণ সাধনের একটি দলিল বুঝেন।
তিনি ৬-দফা কর্মসূচীর বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন শাসকবর্গের এক অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে প্রভাবান্বিত একটি ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের জঘন্য অপপ্রচার ও যুদ্ধংদেহী মনোভাবের কঠোর সমালোচনা করেন। অতীতে কতিপয় বামপন্থী নেতার ভুল ব্যাখ্যার জন্যও তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, ১৯৬৫-এর বেদনাদায়ক পাক- ভারত যুদ্ধ সৃষ্ট পরিস্থিতির অভিজ্ঞতাই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে ৬- দফার আকারে আরও সুনির্দিষ্ট রূপ প্রদান করে।
তিনি বলেন যে, ৬-দফার দ্বারা পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবে না বরং ৬-দফা কর্মসূচী শক্তিশালী কেন্দ্রের বদলে দেশে শক্তিশালী পাকিস্তান গড়িয়া তুলিতে সাহায্য করিবে। ৬-দফা কর্মসূচীতে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র দফতর রাখার এবং দুই অঞ্চলে আলাদা আলাদা রিজার্ভ ব্যাংক স্থাপনের মাধ্যমে আলাদা অর্থ সার্কুলেশনের হিসাব রাখিয়া পূর্ব পাকিস্তানের অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার বন্ধ করার শর্তে বিকল্প হিসাবে অর্থ বিভাগ কেন্দ্রের হাতে রাখার প্রস্তাব রহিয়াছে। ইহাতে কানাডার মত আঞ্চলিক রাষ্ট্রের হাতে বৈদেশিক বাণিজ্য ন্যস্ত করা, সোভিয়েট ইউনিয়নের মত অর্থ দফতরকে অঙ্গ রাষ্ট্রের হাতে নেওয়া এবং ট্যাক্স আদায়ের পূর্ণ ক্ষমতা আঞ্চলিক সরকারের হাতে রাখার প্রস্তাব রহিয়াছে। কেন্দ্রের খরচ নির্বাহের জন্য আঞ্চলিক সরকারের আয় হারাহারিভাবে কেন্দ্রের হাতে জমা দেওয়ার কথাও রহিয়াছে।
তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগ শুধু পূর্ব পাকিস্তানকে লইয়াই চিন্তা করিতেছে না বলিয়া পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিলের দাবী ইহার কর্মসূচীর অঙ্গীভূত করিয়াছে। তিনি ভুয়া গণতন্ত্রের নামে বর্তমানের একনায়কত্ববাদী শাসনব্যবস্থার ও ব্যক্তি কেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য পরিণাম হিসাবে প্রাধান্যপ্রাপ্ত আমলাশাহীর কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, এই আমলাতন্ত্রের সহায়তায় কয়েকটি পরিবারের বৃহৎ ও একচেটিয়া পুঁজিপতিরা দেশের প্রায় সকল সম্পদ নিজেদের কুক্ষিগত করিয়াছে, ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদী শ্রেণী নিজেদের প্রাধান্যকে আঁকড়াইয়া থাকিতেছে ও পূর্ব পাকিস্তানে আধা সামন্তবাদ শ্রেণী শক্তিশালী হইতেছে। সরকারী পয়সার ছড়াছড়ি এবং কন্ট্রাক্ট লাইসেন্সের মারফত গ্রাম ও শহরে যথাক্রমে একদল টাউট ও উঠন্ত ধনীক এই দুর্নীতিপরায়ণ শাসনব্যবস্থায় অন্ধ সমর্থকে পরিণত হইতেছে।
ইহারই অপর পার্শ্বের চিত্র তুলিয়া ধরিয়া তিনি বলেন যে, এই সব শোষক শ্রেণীর স্বার্থেই জনগণকে প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার হইতে বঞ্চিত করা হইয়াছে। খাজনা ও ঋণের ভারে কৃষকের মেরুদণ্ড ভাঙ্গা হইতেছে, শ্রমিকদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হইতে বঞ্চিত করা হইয়াছে। শিক্ষা-সংকোচন নীতি অনুসরণ করা হইতেছে, ভাষা ও সংস্কৃতির উপর হামলা চালান হইতেছে, ধর্মান্ধতা, অন্ধবিশ্বাস ও বুদ্ধির আড়ষ্টতায় জীবন জিজ্ঞাসার পথ রুদ্ধ করা হইতেছে, নৈতিকতার অধঃপতন ঘটান হইতেছে, দমননীতি ও গুণ্ডামির আশ্রয়ে জনগণকে হতচকিত করার চেষ্টা হইতেছে।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের নূতন পররাষ্ট্র নীতির উল্লেখ করিয়া বলেন যে, পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগ পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির আলোকে আজ জোটবিহীন নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির সপক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছে এবং সকল যুদ্ধ জোট হইতে পাকিস্তানের বাহির হইয়া আসার দাবীকে ইহার কর্মসূচীর অঙ্গীভূত করিয়াছে।
তিনি বলেন যে, বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির মারফত ক্ষমতাসীন সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব নয়। এই ব্যবস্থায় অবদানের জন্য তিনি গণ-আন্দোলন সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আন্দোলনের নিম্মোক্ত ৪টি পন্থার কথা উল্লেখ করেনঃ- (১) সভা-সমিতি ও মিছিল, (২) হরতাল, (৩) অসহযোগ আন্দোলন, (৪) আইন অমান্য আন্দোলন।
তিনি বলেন যে, এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ প্রথমোক্ত দুইটি পন্থার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে।
জনাব নজরুল ইসলাম প্যারিটি প্রশ্নের পুনরুজ্জীবন এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে পরিষদের আসন সংখ্যা বণ্টনের দাবী উত্থাপন করেন।

সম্পাদকের রিপোর্ট
সম্পাদকের রিপোর্টে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন যে, সরকারী দমননীতি ও গুণ্ডামী, ব্যাপক গ্রেফতার, পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার, ৭ই জুন পরবর্তী ব্যাপক ধরপাকড়, ১৪৪ ধারা জারী, কথায় কথায় লাঠি ও গুলী চালনা, কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, ‘ইত্তেফাক’ প্রেসের বাজেয়াফতি, শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার বিলোপ এবং সর্বোপরি ষড়যন্ত্র মামলায় দলীয় প্রধানের জড়িত হওয়া, সাধারণ সম্পাদকের এবং অন্যান্য কর্মকর্তা, নেতা ও কর্মীর দেশরক্ষা বিধিবলে একটানা আটক থাকা এবং পি-ডি-এম গঠনের প্রশ্নে কিছু সহকর্মীর দলত্যাগ সত্ত্বেও গত দুই বৎসর আওয়ামী লীগ সংগঠন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র দলীয় কর্মসূচীর প্রচার অভিযান অব্যাহত রাখিয়াছে।
তিনি অন্যান্য দলের সাথে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন সংগঠনের ব্যাপারে প্রাদেশিক কমিটির তৎপরতার কথা উল্লেখ প্রসঙ্গে বলেন যে, এই ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত সভাপতিকেই ভার দেওয়া হইয়াছে। এই প্রচেষ্টাকে তিনি আশাপ্রদ বলিয়া অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি আরও বলেন যে, অপর ন্যাপকে আমন্ত্রণ না জানানোর কারণে তাঁহারা মওলানা ভাসানী আহূত নেতৃ সম্মেলনে যোগদানে অস্বীকৃত হন। তিনি আরও বলেন, এই ন্যাপকে বাদ দিয়া জোট করা অর্থহীন, তিনি দলত্যাগী আওয়ামী লীগারদের দলে ফিরাইয়া আনার প্রসঙ্গে বলেন যে, এই ব্যাপারেও প্রচেষ্টা চালান হইয়াছে।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ খণ্ড: ষাটের দশক ॥ তৃতীয় পৰ্ব ॥ ১৯৬৮

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!