সংবাদ
১৮ই জুন ১৯৬৮
প্রদেশের সর্বত্র ৭ই জুন উদযাপিত: স্বায়ত্তশাসন দিতে হইবে: এক ইউনিট বাতিল কর: প্রত্যক্ষ নির্বাচন কায়েম কর: রাজবন্দীর মুক্তি চাই: খাজনা আদায়ে জুলুমবাজী বন্ধ কর: শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী আইন বাতিল কর
এইবার প্রদেশের সর্বত্রই শাহীদের স্মৃতিবিজড়িত ৭ই জুন যথাযোগ্য মর্যাদার সহিত পালন করা হইয়াছে। এই উপলক্ষে প্রদেশের বিভিন্ন শহরে-বন্দরে পোষ্টারিং, পথসভা, কর্মীসভা ও জনসভা অনুষ্ঠিত হইয়াছে। সর্বত্রই পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন, পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বাতিল, প্ৰত্যক্ষ নির্বাচন, রাজবন্দীদের মুক্তি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, খাজনা-ট্যাক্স আদায়ে আমলাদের জুলুম বন্ধ, কৃষকদের জন্য স্বল্পহারে দীর্ঘমেয়াদী ঋণের ব্যবস্থা, গরীব কৃষকদের বকেয়া খাজনা-ট্যাক্স মওকুফ ও শ্রমিক স্বার্থবিরোধী আইনসমূহ বাতিলের দাবী জানান হয়।
ফরিদপুর
গত ৭ই জুন জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে স্থানীয় অম্বিকা ময়দানে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব আদেল উদ্দীন আহাম্মদ এডভোকেটের সভাপতিত্বে এক মহতী জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় বক্তৃতা করেন সদর মহকুমা আওয়ামী লীগ সভাপতি জনাব হায়দার হোসেন এডভোকেট, প্রাক্তন মন্ত্রী বাবু গৌরন্দ্রে বালা, জনাব আমীনুজ্জামান এডভোকেট এবং জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক জনাব শামসুদ্দিন মোল্লা এডভোকেট।
বক্তৃতা প্রসঙ্গে জনাব আমিনুজ্জামান বলেন যে, রাষ্ট্র ভাষার জন্য সংগ্রাম করিয়া আমরা ভাষার দাবীকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিয়াছি। কারণ, আমাদের দাবী ছিল ন্যায্য এবং সঠিক।
দাবী যদি সঠিক হয় এবং জনসাধারণ যদি সেই দাবীকে নিজের দাবী বলিয়া গ্রহণ করে, তাহা হইলে সে দাবী আদায় হইবেই—তাহার প্রমাণ ভাষার দাবী। আজ গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবীও ন্যায্য দাবী এবং ইহা জনসাধারণের প্রাণের দাবী। অতএব এ দাবী অর্জিত হইবেই।
সভাপতির ভাষণের পর ৭ই জুনের শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করা হয়। এক ইউনিট বাতিল, সমাজতন্ত্র কায়েম, ছয়দফার পূর্ণ বাস্তবায়ন, সকল রাজবন্দীর মুক্তিসহ কতিপয় প্রস্তাব গৃহীত হয়।
রাজেন্দ্র কলেজ
৭ই জুন উপলক্ষে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ইউনিয়নের স্বতন্ত্র গ্রুপ এর যৌথ উদ্যোগে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। কলেজের ছাত্র- ছাত্রী সংসদের সহ-সভাপতি এ, কে, এম মামুনুর রশিদ সভায় সভাপতিত্ব করেন।
সভায় ৭ই জুনের শহীদদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা, ছয়দফার বাস্তবায়ন, বেগম মতিয়া চৌধুরী, আঃ রাজ্জাক, মেননসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি, জরুরী আইন প্রত্যাহার, এক ইউনিট বাতিল, নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি কায়েম, ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, শিক্ষা সংকোচন নীতির সমালোচনা, খাদ্যসহ নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যের মূল্য হ্রাস, সকল সামরিক চুক্তি বাতিল, ভিয়েতনামে মার্কিন বর্বরতার নিন্দা ও নিম্নতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে সকল বিরোধী দলীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের আহ্বান জানাইয়া প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
নরসিংদী
নরসিংদী, ঢাকা ১০ই জুন (নিজস্ব সংবাদদাতা)।- কৰ্ম্মচঞ্চল বিপনীকেন্দ্ৰ সুতাপট্টীতে গতকল্য স্থানীয় বিশিষ্ট সমাজকর্মী মতিউর রহমানের সভাপতিত্বে ৭ই জুনের ডাকে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে। সভায় প্রারম্ভে ৭ই জুনের শহীদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, প্রত্যক্ষ নির্বাচন ও সার্বজনীন ভোটাধিকার, রাজবন্দীর মুক্তি, জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার, শ্রমিক-কৃষকদের বাঁচার দাবী, এক ইউনিট বাতিল প্রভৃতির জোর দাবী জানান হয়। অপর এক প্রস্তাবে সকল বিরোধীদলকে নিম্নতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ তুমুল গণআন্দোলন গড়িয়া তোলার আকুল আহ্বান জানান হয়। সভায় যাহারা বক্তৃতা করিয়াছেন তাহাদের মধ্যে জনাব মজিবুর রহমান, শহীদুল্লাহ বাহার, এ রহমান চৌধুরী, আবুল হোসেন খান প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, উক্ত সভা স্থানীয় জিন্না পার্কে অনুষ্ঠিত হইবে বলিয়া সংগ্রামী ছাত্রসমাজের পক্ষে জনাব শহীদুল্লাহ বাহার কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত ছাপানো বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়। কিন্তু ঐদিন উক্ত জিন্না পার্কে ঈদ-এ-মিলাদুন্নবী উপলক্ষে দরিদ্র মিসকিনদের মধ্যে স্থানীয় কোন বিশেষ মহল কর্তৃক খিচুরী বিতরণ করার ফলে এই সভা সুতাপট্টিতে অনুষ্ঠিত হইয়াছে।
বরিশাল
বরিশাল, ৮ই জুন (নিজস্ব সংবাদদাতা)। – গতকল্য পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ৭ই জুন উপলক্ষে এক কর্মীসভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন বরিশাল জেলা সংসদের সভাপতি মোঃ শাজাহান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় বিভিন্ন বক্তা ৭ই জুনের আন্দোলন হইতে অভিজ্ঞতা গ্রহণ করিয়া পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র, শিক্ষা সংকোচন নীতি পরিহার করতঃ গণশিক্ষার ব্যাপক প্রসার, রাজবন্দীর মুক্তি প্রভৃতি আশু দাবীর ভিত্তিতে সকল গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ জঙ্গী গণআন্দোলন গড়িয়া তোলার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সভায় আলোচনা করেন জিলা ছাত্র ইউনিয়নের কার্যকরী সাধারণ সম্পাদক মাসুদ আহমেদ মাসুদ, নওশের জাহান, নূরুর রহমান প্রমুখ। শেখ মুজিবসহ সামরিক আইনে আটক সকলকে স্বাভাবিক পরিবেশে এবং সাধারণ আইনে বিচার অনুষ্ঠান, পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, বেগম মতিয়া চৌধুরী, মানবেন্দ্র বটব্যাল ও আলী হায়দর খানসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি, তৃতীয় বিভাগে পাস করা ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার সুযোগদান প্রভৃতি দাবীতে কতিপয় প্রস্তাব গৃহীত হয়।
গৌরীপুর
গৌরীপুর (ময়মনসিংহ), ১২ই জুন (নিজস্ব সংবাদদাতা)। – গত ৭ই জুন শুক্রবার থানা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বিকাল ৪ টায় স্থানীয় বাজার ময়দানে জনাব জামশেদ আলীর সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অনুমান ৫ হাজার লোক ও বিপুলসংখ্যক ছাত্র ও যুবক যোগদান করেন। আওয়ামী লীগের সহকারী সম্পাদক জনাব হাতেম আলী মিয়া বর্তমান সরকারের প্রতিটি গণ-বিরোধী কার্যকলাপের তীব্র সমালোচনা করেন। ৭ই জুনের মর্মান্তিক ঘটনার ইতিহাস ব্যাখ্যা করে।
সভায় থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাঃ এম এ সোবহান, জনাব আবদুল ওয়াহেদ, সহ-সম্পাদক জনাব মুরতোজ আলী ফকির, গৌরীপূর কলেজের ছাত্রনেতা জনাব ফজলুল হক, স্থানীয় আর কে হাই স্কুলের ছাত্র জহিরউদ্দীন সরকারের ছাত্র নির্যাতনের তীব্র নিন্দা করেন। সভায় কতিপয় প্রস্তাব গৃহীত হয়। সভায় ৭ই জুনের শহীদদের আত্মার মাগফেরাৎ কামনা, শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজনের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও শহীদদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য সরকারের নিকট জোর দাবী জানানো হয়।
অন্যান্য প্রস্তাব হইল সকল রাজবন্দীর আশুমুক্তি, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা, ৬-দফার বাস্তবায়ন, ১৪৪ ধারার নিন্দা, জরুরী আইন প্রত্যাহার, সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা, দৈনিক ইত্তেফাকের উপর হইতে বাজেয়াপ্ত প্রত্যাহার, বর্ধিত খাজনা হ্রাস, শিক্ষা সংকোচন নীতি পরিবর্তন, পাটের মণ ৪০ টাকা ধার্যকরণ, সকল প্রকার দুর্নীতি বন্ধকরণ, সার্টিফিকেট ও বডি ওয়ারেন্ট স্থগিত রাখার দাবী।
নেত্রকোনা
নেত্রকোনা, ৮ই জুন (নিজস্ব সংবাদদাতা)। – পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার হারা শোষিত জনসাধারণের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবী দাওয়া বিশেষ করিয়া স্বায়ত্তশাসন-এর দাবীর ‘স্মৃতি বিজড়িত’ ৭ই জুন যথাযোগ্য মর্যাদার সহিত নেত্রকোনাতে প্রতিপালিত হইয়াছে। এই দিবসকে সম্মুখে রাখিয়া নেত্রকোনার সংগ্রামী সমাজ রাজবন্দীর মুক্তি, প্রত্যক্ষ নির্বাচন, পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, এক ইউনিট বাতিল, খাজনা ও ট্যাক্সের বোঝা কমানো, ছাত্রদের ২২ দফা প্রভৃতি দাবী দাওয়ার উপর সমস্ত শহরে পোষ্টারিং-এর ব্যবস্থা করে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ হইতে ৭ই জুনের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করিয়া প্রচারপত্র বিলি করা হয়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ছোট ছোট পথসভার আয়োজন করিয়া কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র তথা শোষিত জনতার বিভিন্ন দাবী দাওয়া ও গণবিরোধী সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল কার্যাবলীর উল্লেখপূর্বক বিভিন্ন বক্তা বক্তৃতা করেন। ঐদিন বিকাল ৪টায় নেত্রকোনা তরকারী মহালে এক জনসভার আয়োজন করা হয়। জনাব ফজলূর রহমান খান মোক্তার-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সভায় জনসাধারণ এর বিভিন্ন দাবী দাওয়ার প্রেক্ষিতে বক্তৃতা করেন ছাত্রলীগের পক্ষে সাফায়েত উদ্দীন খান, মহকুমা ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষে সেন্টু রায়, হাসান ইমাম ও নুরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের পক্ষে জনাব আবদুল খালেক ও জামালউদ্দীন আহম্মদ, মহকুমা ন্যাপের পক্ষে আবদুল কুদ্দুস ও শাহ আবদুল মোতালিব। সকল বক্তাই স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনীয়তা, সংগঠন গড়ার প্রয়োজনীয়তা, দাবী আদায়ের পন্থা প্রভৃতির উপর আলোচনা করেন।
৭ই জুন সকাল হইতে সমস্ত শহরে বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র পুলিস মোতায়েন করা হয়। জনসভার স্থানেও লাঠিধারী পুলিসের বেষ্টনী সৃষ্টি করা হয়। শুধু তাই নয় শহরে যে সমস্ত পোষ্টার লাগান হয় কোন অদৃশ্য শক্তির যাদুবলে সেই সমস্ত পোষ্টার রাত্রির গভীর অন্ধকারে ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়।
সভায় মনি সিং, তাজুদ্দিন, মতিয়া চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, এডভোকেট মোমেন, মিহির মজুমদার ও শ্রী সুকুমার ভাওয়ালসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি, ৬-দফার প্রতি সমর্থন, পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, এক ইউনিট বাতিল, প্রত্যক্ষ নির্বাচন, খাজনা-ট্যাক্স কমান, শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী দান, ছাত্রদের ২২-দফা দাবী কায়েম প্রভৃতি দাবী জানাইয়া কতিপয় প্রস্তাব গৃহীত হয়।
গৈলা
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন গৈলা শাখার উদ্যোগে ৭ই জুন পালন করা হয়। এই উপলক্ষে গৈলার ছাত্রগণ এক সভায় মিলিত হইয়া ৭ই জুনের তাৎপর্য আলোচনা করেন এবং এই আন্দোলনের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। সভায় বিভিন্ন স্থানে ১৪৪ ধারা জারীর নিন্দা জ্ঞাপন করা হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, এক ইউনিট বাতিল, পূর্ণ গণতন্ত্র, রাজবন্দীদের মুক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ খণ্ড: ষাটের দশক ॥ তৃতীয় পৰ্ব ॥ ১৯৬৮