You dont have javascript enabled! Please enable it!

সংবাদ
২রা এপ্রিল ১৯৬৮
ঢাকার ছাত্র-যুব সমাবেশে ভুট্টোর বক্তৃতা সকল বিরোধীদলকে ঐক্যবদ্ধ করার সঙ্কল্প
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক)

পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো গতকাল (সোমবার) তিনি অন্যান্য বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দের সহিত ইতিমধ্যেই আলোচনা করিয়াছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি মওলানা ভাসানী ও মিয়া মমতাজ দৌলতানার সহিত তাঁহার সাক্ষাৎকারের বিষয় উল্লেখ করেন। কিছুদিন পূর্বে কারাগারে শেখ মুজিবের সহিত সাক্ষাৎকারের ব্যর্থ প্রচেষ্টার কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, আগামীতে তিনি পিডিএম নেতৃবৃন্দ ও অন্যান্যদের সাথে আবার আলোচনায় মিলিত হইবেন।
জনাব ভুট্টো বলেন যে, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করাই তাঁহার পার্টির লক্ষ্য এবং গণতন্ত্রে সংগ্রামে তাহার পার্টি সকল গণতান্ত্রিক শক্তির সহিত একযোগে কাজ করিতে আগ্রহী, তেমনি সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্যও পাকিস্তান পিপলস পার্টি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী শক্তিসমূহের সাথে একযোগে কাজ করিবে।

স্বায়ত্তশাসন
তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর প্রতিও দৃঢ় সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং বলেন যে, স্বায়ত্তশাসনের দাবীদার শক্তিসমূহের সহিত তাহার পার্টি পূর্ণ সহযোগিতা করিতে প্রস্তুত রহিয়াছে। তিনি ৬-দফা কর্মসূচী সম্পর্কেও বিশদ আলোচনা করেন।
আগামী প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে অংশগ্রহণ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে জনাব ভুট্টো বলেন যে, অন্যান্য বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দের সহিত আলোচনা করার পূর্বে তিনি এ সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্ত জ্ঞাপন করিতে পারেন না।
তবে তিনি বলেন যে, বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির মারফত জয়লাভ করা না করা এবং নির্বাচন মারফত জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা দুইটি স্বতন্ত্র প্রশ্ন। তিনি মৌলিক গণতন্ত্রী পদ্ধতির কঠোর সমালোচনা করেন।

গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র
জনাব ভুট্টো বলেন যে, জনগণের ভোটে একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করাই হইতেছে আজিকার মুহূর্তের প্রধান কর্তব্য। সকল শাসনতান্ত্রিক সমস্যার সমাধানের ভার জনগণের হাতে ছাড়িয়া দিতে হইবে এবং এই ব্যাপারে সকল প্রাপ্তবয়স্কের গোপন ভোট গ্রহণ করিতে হইবে। তিনি বলেন যে, জাতির ভাগ্যের সহিত জড়িত শাসনতান্ত্রিক সমস্যাসমূহ কখনই কোন স্বার্থসর্বস্ব কোটারী ফয়সালা করিতে পারে না। তিনি বলেন যে, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর প্রথম গণপরিষদ শাসনতন্ত্র প্রদানে ব্যর্থ হয় তৎপর ১৯৫৬ সালের গণপরিষদ একটি শাসনতন্ত্র প্রদান করে। যদিও এই গণপরিষদের নিকট জনগণের পূর্ণ ম্যান্ডেট ছিল না। আর ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্র তো জনগণের উপর জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়া হইয়াছে। জনগণের অধিকার হরণের পরিণামে কোন পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নের সমাধান এ যাবৎ সম্ভব হয় নাই। তিনি আরও বলেন যে, গত ২০ বৎসরে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে জনগণের মতামত লওয়া হইলে এক্ষণে স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্র কায়েমের আন্দোলন করার প্রয়োজন হইত না।

স্বায়ত্তশাসন
জনাব ভুট্টো ফেডারেল ধরনের শাসনব্যবস্থা কায়েমের এবং বিশেষভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের পক্ষে জোরালো বক্তব্য উপস্থাপিত করেন। তিনি বলেন যে, ক্ষমতাসীনরা দাবী করিতেছেন যে, বর্তমান শাসনতন্ত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হইয়াছে। কিন্তু আসলে গভর্ণরের মাধ্যমে এখানে এজেন্সী শাসন কায়েম করা হইয়াছে। তিনি বলেন যে, এই এজেন্সী ব্যবসায় পূর্ব পাকিস্তানের উপর শোষণের মাত্রা বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাইয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ব্যবস্থা সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন যে, তিনি মনে করেন বিষয়টি বিতর্কমূলক এবং জনগণের মতানুসারেই এই প্রশ্নের ফয়সালা করিতে হইবে।

৬-দফা
জনাব ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের দাবী জানাইলেও ৬-দফা কর্মসূচীর সহিত তিনি যে পূরাপূরি একমত নহেন, উহাও প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, প্রদেশসমূহকে ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করিয়া যেমন প্রদেশ ও কেন্দ্রের বুনিয়াদ শক্তিশালী করিতে হইবে এবং জাতীয় ঐক্যকে মজবুত করিতে হইবে। তেমনি কেন্দ্রের হাতে মাত্র ২টি বিষয় রাখিয়া এবং কেন্দ্রকে ট্যাক্স আদায়ের কোন ক্ষমতা প্রদান না করিয়া উহাকে প্রদেশসমূহের— পেনশনভোগীও করা চলিবে না। তিনি বলেন, কেন্দ্র ও প্রদেশ উভয়ের হাতে ট্যাক্স আদায়ের ক্ষমতা রাখিতে হইবে। উল্লেখযোগ্য, ৬-দফা কর্মসূচীতে ট্যাক্স আদায়ের ক্ষমতা শুধু প্রদেশকে প্রদানের প্রস্তাব রহিয়াছে এবং কেন্দ্রের হাতে শুধু দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র এই দুইটি বিষয় থাকিবে বলিয়া বলা হইয়াছে।

দুইটি মুদ্রা
৬-দফা কর্মসূচীতে উল্লেখিত দুইটি মুদ্রা কায়েমের প্রস্তাবেরও তিনি বিরোধীতা করেন। তিনি বলেন যে, পূর্ব-পাকিস্তান হইতে পশ্চিম পাকিস্তানে পুঁজির পাচার রোধ করাই যদি উদ্দেশ্য হয় তবে দুইটি কিম্বা ততোধিক মুদ্রা চালু করিয়া উহা করা সম্ভব হইবে না। পুঁজির পাচার বন্ধ করিতে হইলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিলোপ করিতে হইবে। তিনি আরও বলেন যে, দুইটি মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করিয়া পূর্ব পাকিস্তান হইতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, পশ্চিম জার্মানী, জাপান প্রভৃতি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রেও পুঁজি ও মুনাফা পাচার বন্ধ করা যাইবে না।

বৈদেশিক মুদ্রা
৬-দফা কর্মসূচীতে পূর্ব পাকিস্তানী কর্তৃক অর্জিত বৈদেশিক মূদ্রার উপর পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার যে প্রস্তাব করা হইয়াছে। সে সম্পর্কে তিনি বলেন যে, শাসনতন্ত্রে এইরূপ বিধান সন্নিবেশনের প্রয়োজন নাই। পশ্চিম পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের শোষণ বন্ধ করার জন্য প্রয়োজন বৃহৎ পুঁজিবিরোধী একটি সৎ রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের। তিনি বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ও পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ উভয়েই নির্মমভাবে শোষিত হইতেছে একচেটিয়া ধনিকদের হাতে।
৬-দফা কর্মসূচীতে পূর্ব পাকিস্তানে আধা সামরিক বাহিনী গঠনের যে প্রস্তাব করা হইয়াছে সে সম্পর্কে জনাব ভুট্টো বলেন যে, তিনি সমগ্র জনগণের হাতে অস্ত্র তুলিয়া দেওয়ার পক্ষপাতী।

আলোচনার প্রয়োজন
জনাব ভুট্টো বলেন যে, ৬ দফার মূল কথা স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে দ্বিমতের অবকাশ নাই। তবে স্বায়ত্তশাসনের পরিমাণ সম্পর্কে যে ভিন্নমত বিরাজমান উহা আলোচনার মারফত নিষ্পত্তিযোগ্য। কিছুদিন পূর্বে তিনি কারাগারে শেখ মুজিবের সহিত সাক্ষাতের অনুমতি প্রার্থনা করিয়াছিলেন। তিনি বলেন যে, আলোচনার মারফতে রাজনৈতিক প্রশ্নের সমাধান করাই হইতেছে গণতন্ত্রের রীতি। তিনি প্রকাশ করেন যে, শেখ মুজিব নিজেও ৬ দফা কর্মসূচী প্রকাশকালে বলিয়াছিলেন ইহা কোন চূড়ান্ত দলিল নয়। ইহার এখানে সেখানে রদবদলও করা যাইতে পারে।
জনাব ভুট্টো বলেন যে, স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে বিতর্কের ও আলোচনার সুযোগ না দিয়া ক্ষমতাসীন সরকার জাতীয় ঐক্যের ও জাতীয় স্বার্থের মূলে কুঠারাঘাত হানিতেছে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে জনাব ভুট্টো বলেন যে, অভিযুক্তদের প্রকাশ্য বিচারের ব্যবস্থা করিতে হইবে এবং জনগণকে সমর্থনের সুযোগ দিতে হইবে। স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলিয়া বিচ্ছিন্ন করার সরকারী প্রয়াসের কঠোর সমালোচনা করিয়া জনাব ভুট্টো বলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা সংখ্যাগরিষ্ট। সংখ্যাগরিষ্ট জনগণ বিচ্ছিন্ন হইতে চাহে ইহা বলা আহাম্মকী। তিনি বলেন যে, স্বায়ত্তশাসনের দাবী প্রতিটি পাকিস্তানীর দাবী। সকল বিরোধীদল এবং পিডিএম-এর ৮-দফা কর্মসূচীতেও এই স্বায়ত্তশাসনের দাবীর স্বীকৃতি রহিয়াছে।
জনাব ভুট্টো ক্ষমতাসীনদের স্মরণ করাইয়া দেন যে, ১৯০৫ সালের শাসনতন্ত্রেও কিছু পরিমাণে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করিতে ঔপনিবেশিক ইংরেজরা বাধ্য হইয়াছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কাহারও পক্ষেই দীর্ঘদিন ধরিয়া এই দাবীকে অস্বীকার করা সম্ভব হইতে পারে না। তিনি বর্তমান শাসনতন্ত্রকে ১৯০৫ সালের শাসনতন্ত্র অপেক্ষা নিকৃষ্ট আখ্যায়িত করেন।
তিনি আরও বলেন যে, ক্ষমতাসীনরা প্রচার করিতেছেন যে, স্বায়ত্তশাসন প্রদান করিলে পাকিস্তান দুর্বল হইয়া পড়িবে। তিনি প্রশ্ন করেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রসমূহের ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন রহিয়াছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কি তাই বলিয়া দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে। জনাব ভুট্টো তাঁহার সহিত সহযোগিতা করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানী তরুণদের প্রতি আহ্বান জানান। চলতি সফরে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাড়া লক্ষ্য করিয়াও তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইয়াছেন। তিনি বলেন যে, সংবাদপত্রে খবর ছাপা না হইলেও রংপুর ও সিলেটে তিনি জনসাধারণের নিকট হইতে অভূতপূর্ব সাড়া লাভ করিয়াছেন। তিনি বলেন, ছাত্ররা যাহাতে কোন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করিতে না পারে তজ্জন্য সরকার কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স জারী করিয়াছে, যে অর্ডিন্যান্স বলে ছাত্রদের ডিগ্রি পর্যন্ত কাড়িয়া লওয়া যায়। জনাব ভুট্টো বলেন যে, সঠিক নেতৃত্ব প্রদান করিতে পারিলে দেশবাসীকে দিয়া একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও উন্নত পাকিস্তান গড়িয়া তোলা সম্ভব হইবে।

সূত্র: সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধু চতুর্থ খণ্ড: ষাটের দশক ॥ তৃতীয় পৰ্ব ॥ ১৯৬৮

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!