জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রশ্ন
১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের মর্মান্তিক ঘটনাবলির প্রশ্নে দীর্ঘ ও উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা শুরু হয় এবং তা ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এই আলোচনা ও বিতর্ককালে সোভিয়েত প্রতিনিধিদল চেষ্টা করেন, যাতে বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশের বাস্তব অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়, উদ্ভূত পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করা হয় এবং পাক-ভারত সংঘর্ষ ও বাংলাদেশের গুরুতর রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণগুলো দূর করে তথায় একটি রাজনৈতিক মীমাংসার পথ প্রশস্ত করা হয়। পক্ষান্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও তাদের সহযোগীরা ভারতীয় উপমহাদেশে ও বাংলাদেশের প্রকৃত পরিস্থিতি ও বাস্তব তথ্যাদি সম্পর্কে চোখবুজে থেকে ভূয়া শান্তিস্থাপনকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে পর পর এমনসব অবাস্তব ও একপেশে খসড়া প্রস্তাব পেশ করে, যা গৃহীত হলে পাক-ভারত সংঘর্ষ বন্ধ হত বটে, কিন্তু সংঘর্ষের মূল কারণগুলো দূর হত না। বরং এতে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও গণহত্যাভিযান নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়ার অধিকার পেত। চীন এই মার্কিনী প্রস্তাবগুলোকে সমর্থন করে। কিন্তু সোভিয়েত প্রতিনিধিদলের উপর্যুপরি তিনবার ‘ভেটো’ প্রয়োগের ফলে ভণ্ড শান্তিস্থাপনকারীদের’ উপরোক্ত প্রস্তাবগুলো বাতিল হয়ে যায়। নিরাপত্তা পরিষদকে দিয়ে নিজেদের মনমতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাতে ব্যর্থ হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও তাদের সহযোগীরা প্রশ্নটিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২০০তম অধিবেশনে উপস্থাপিত করে। এই অধিবেশনে সোভিয়েত প্ৰতিনিধি মি. মালিক কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণের যে হুবহু বিবরণ জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে ৮ ডিসেম্বরে বিতরণ করা হয়, নিম্নে তা পুরোপুরি তুলে দেওয়া হলো:
পূর্ব পাকিস্তানের মর্মান্তিক ঘটনাবলি, যা উক্ত অঞ্চলের দুটি বৃহৎ রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষের রূপ নিয়েছে এবং বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপান্তরিত হয়েছে, তৎসম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদে দীর্ঘ ও উত্তপ্ত আলোচনার পর প্রশ্নটি এখন সাধারণ পরিষদে বিবেচনার জন্য উপস্থাপিত হয়েছে।
আমরা নির্ভরযোগ্যভাবে জানি, যাঁদের উদ্যোগে ও প্রেরণায় এই প্রশ্নটি সাধারণ পরিষদে স্থানান্তরিত হয়েছে, তাঁরা হচ্ছেন সেইসব ব্যক্তি, যাঁরা ভারতীয় উপমহাদেশের বাস্তব অবস্থার প্রতি চোখ বুজে থাকতে, উদ্ভূত পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়নকে এড়িয়ে যেতে এবং সংঘর্ষের ও পূর্ব পাকিস্তানের গুরুতর রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণসমূহ দূরীকরণে সর্বপ্রকারে বাধা দিতে চেয়েছিলেন।
নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটি কীভাবে হয়েছে, তা সবাই দেখতে পাচ্ছেন। সেখানে যেসব অবাস্তব খসড়া প্রস্তাব পেশ করা হয়েছিল, সেগুলো পূর্ব পাকিস্তান ও উপমহাদেশের প্রকৃত অবস্থা বিবেচনা করতে ব্যর্থ হয় এবং প্রকৃত তথ্যের প্রতি চোখ বুজে থাকে। ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন দুবার অনুরূপ খসড়া প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয় এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভোটদানে বিরত থাকে। কাজেই নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য তিনটি দেশ উক্ত খসড়া প্রস্তাবগুলোকে সমর্থন করেনি। সমর্থন করেছে কারা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যারা সর্বপ্রথম নিজেদের খসড়া পেশ করেছিল। খসড়াটি রচিত হয়েছিল উক্ত অঞ্চলের জন্য তাদের নিজস্ব যে পরিকল্পনা রয়েছে তদনুযায়ী। চীনা প্রতিনিধিদল এটাকে সমর্থন করে। এই হলো ভোটাভুটির চিত্র। অপরদিকে একমাত্র চীনই নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত খসড়া প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয় এবং সে তা করে একমাত্র এই কারণে যে, ওটা ছিল সোভিয়েত খসড়া। এটা স্নায়ুযুদ্ধের সেই নিকৃষ্টতম দিনগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবর্গের প্রতিনিধিরা সর্বোত্তম সোভিয়েত প্রস্তাবগুলোকেও না পড়েই প্রত্যাখ্যান করে দিত। চীনের প্রতিনিধি এরকমই করেছেন এবং স্পষ্টত সোভিয়েত প্রস্তাবাদি সম্পর্কে চীনের প্রতিনিধি ভবিষ্যতেও এরকম কার্যক্রম অবলম্বনের ইচ্ছাই পোষণ করেন।
নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের আবেগপূর্ণ ভাষণ এবং নিরাপত্তা পরিষদে ও এখানে চীনা প্রতিনিধিদের অনুরূপ আবেগপূর্ণ ভাষণ সোভিয়েত প্রতিনিধিদলকে জবাব দিতে বাধ্য করেছে।
অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারসহ ভারতীয় উপমহাদেশের দুঃখ-দুর্দশা ও বিয়োগান্ত ঘটনাবলি সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল পরিষদে যা যা বলেছেন, সেগুলো যদি ইন্দোচীন পরিস্থিতিতে, যেখানে দুঃখ-দুর্দশা আরো লক্ষ লক্ষ গুণ বেশি, পরিপূর্ণভাবে প্রযুক্ত হতো, তবে ইন্দোচীনে শান্তি আসত। এটাই হচ্ছে সঠিক চিত্র।
চীনা প্রতিনিধি নিরাপত্তা পরিষদে ও এখানে প্রায় সমগ্ৰ অতীত ইতিহাসকে টেনে আনলেও ইন্দোচীনে সাম্রাজ্যবাদী হামলা সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি। বর্তমান অবস্থায় চৈনিক শব্দভাণ্ডারে ওরকম কোনোকিছুর (সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন) অস্তিত্বই নেই। এগুলো হচ্ছে প্রকৃত তথ্য, এটাই হচ্ছে বাস্তবতা এই-ই হচ্ছে তাদের বিপ্লবী লাইন ইন্দোচীন সম্পর্কে একটি কথাও নয়। আমেরিকান ও চীনারা স্পষ্টত বিশ্বাস করেন যে, বিশ্বের ওই অংশে কোনো দুঃখ-দুর্দশা ও মৃত্যু নেই৷
এই প্রশ্নটি কার প্রেরণা ও উদ্যোগে নিরাপত্তা পরিষদ থেকে সাধারণ পরিষদে স্থানান্তরিত হয়েছে, তৎসম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদে যে রিপোর্ট আসে তা আমরা গতকাল নিরাপত্তা পরিষদে শুনেছি। সাধারণ পরিষদে প্রশ্নটি এনেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিরাপত্তা পরিষদ থেকে সাধারণ পরিষদে প্রশ্নটিকে স্থানান্তরিত করার জন্য একটি কৌশলগত পরিকল্পনা তাঁরা তৈরি করেন এবং সেই পরিকল্পনাটি পরিষদের চীনা প্রতিনিধিদলের সক্রিয় সমর্থন লাভ করে। এইভাবে এই ক্ষেত্রেও দ্বৈত সঙ্গীত শুরু হয়েছে এবং এখনও অব্যাহত রয়েছে। এ কথাটা ভেবে দেখা জনৈক বক্তার পক্ষে ভালো হবে, যিনি এখানে বক্তৃতা করেছেন এবং আজ বহুবছর যাবৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের শান্তিপ্রিয় লেনিনবাদী নীতির বিরুদ্ধে তোতাপাখির মতো কুৎসা প্রচার করে এসেছেন।
সোভিয়েত প্রতিনিধিদল সর্বপ্রথমেই তার এই দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা ঘোষণা করতে চায় যে, আলোচ্য প্রশ্নটির মীমাংসার ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদের সম্ভাবনা একেবারেই নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল এই কথা যথার্থ নয়। ভারতীয় উপমহাদেশে এই যে জটিল ও জরুরি সমস্যা দেখা দিয়েছে, তার একটি কার্যকর সমাধান পরিষদ খুঁজে বের পারত। এই কারণে সোভিয়েত প্রতিনিধিদল প্রশ্নটিকে সাধারণ পরিষদে স্থানান্তরের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সময় সঙ্গে সঙ্গে একথা পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করেছিল যে, ওই কার্যক্রম উক্ত অঞ্চলের শোচনীয় ঘটনাবলির ওপর নিশ্চিত প্রভাব বিস্তারে সক্ষম এমন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণকেই শুধু বিলম্বিত করতে পারে। নিরাপত্তা পরিষদ প্রশ্নটি সম্পর্কে কার্যকর সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি কেন, তা সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হয়ে গেছে। না পারার কারণ ছিল এই যে, দুটি বৃহৎ শক্তি, তাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং আদর্শগত ধ্যান-ধারণা ও সামরিক-রাজনৈতিক অঙ্গীকারের দরুন নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থপর উদ্দেশ্য ও আকাঙ্ক্ষার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। তারা পূর্ব পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত ঘটনাবলি এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তান কর্তৃক তার প্রতিবেশী ভারতের বিরুদ্ধে গৃহীত সামরিক কার্যক্রমের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে যে রাজনৈতিক বাস্তবতার উদ্ভব হয়েছে, তা থেকে পরিষদের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের সাধ্যানুযায়ী সবকিছুই করেছে।
দুটি বৃহৎ শক্তির এই মনোভাব অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক ও গিনির (বিসাউ) আফ্রিকান জাতিগুলোর ওপর যারা হত্যাভিযান ও উৎপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে, সেই পর্তুগীজ সাম্রাজ্যবাদীদের খুবই মনঃপূত হয়েছে। আজ এই সভামঞ্চ থেকে প্রদত্ত পর্তুগালের প্রতিনিধির ভাষণটি বিশ্লেষণ করেই একথা বলা যায়। নিরাপত্তা পরিষদে যখন পর্তুগীজ আগ্রাসনের প্রশ্নে আলোচনা চলে, তখন বৈঠকে তাঁর টিকিটাও দেখা যায় না; কিন্তু আজ নিরাপত্তা পরিষদের দুটি সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক ভারতীয় উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে পর্তুগীজ সাম্রাজ্যবাদীদের পছন্দানুযায়ী নীতি গ্রহণের সুযোগ নিয়ে তিনি এই সভামঞ্চে হাজির হয়ে এক আবেগপূর্ণ বক্তৃতা ঝেড়েছেন এবং তা সবাই শুনেছেন।
নিরাপত্তা পরিষদের সর্বশেষ আলোচনায় এ বিষয়ে সংশয়ের বিন্দুমাত্র অবকাশও রাখা হয়নি যে, ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত প্রকৃত পরিস্থিতি বিবেচনা না করে জাতিসংঘের পক্ষে উক্ত অঞ্চলে সংঘর্ষের অবসান ও স্বাভাবিক অবস্থা কায়েম কিংবা পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক মীমাংসা আনয়নের জন্য আশু ও কার্যকর ব্যবস্থাদি গ্রহণ অসম্ভব হবে।
এই সমস্যার সূচনা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করে, তা সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড ব্রেঝনেভ তাঁর এক সাম্প্রতিক বিবৃতিতে (ওয়ারশ, ৭ ডিসেম্বর প্রদত্ত) স্পষ্ট ও উপযুক্ত ভাষায় তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন:
‘শান্তি ও জাতিসমূহের স্বাধীনতার সকল সমর্থকের মতো আমরা গভীর দুঃখের সাথে এশিয়ার দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে সম্প্রতি যে সশস্ত্র সংঘর্ষ বেধে গেছে এবং যেসব ঘটনা থেকে উক্ত সংঘর্ষের উদ্ভব হয়েছে, তৎসম্পর্কে অবগত হয়েছি। সেইসব ঘটনা কী? তা হলো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহ ও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত ইচ্ছাকে রক্তপাতের মাধ্যমে দমন এবং এক কোটি লোককে শরণার্থীতে পরিণত করার মর্মান্তিক ঘটনা।’
কিন্তু চীনা প্রতিনিধি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত ইচ্ছা ও মৌলিক অধিকারগুলোকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দেওয়ার ঘটনার প্রতি চোখ বুজে রয়েছেন এবং এই বলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কুৎসা গেয়ে চলেছেন যে, সে (সোভিয়েত ইউনিয়ন) নাকি এশিয়া ও আফ্রিকায় কারো ওপর তার ইচ্ছা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন রক্তলোলুপ একনায়কত্বের পদলেহন করে না। সোভিয়েত নীতি এটাই বৈশিষ্ট্য।
কমরেড ব্রেঝনেভ তাঁর পূর্বোক্ত বিবৃতিতে আরো বলেছিলেন, ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন চূড়ান্তভাবে রক্তপাত বন্ধ করার এবং বাইরের কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে উক্ত অঞ্চলে ন্যায্য ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার উপযোগী অবস্থা সৃষ্টিকল্পে জনগণের আইনসঙ্গত অধিকারগুলোকে বিবেচনার মধ্যে রেখে উদ্ভূত সমস্যাবলির একটি রাজনৈতিক মীমাংসার পক্ষপাতী।’ এটাই হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের নীতি। জাতিসংঘে এই প্রশ্নের আলোচনাকালে এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দাদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের রক্তাক্ত দমননীতি ও সন্ত্রাস অভিযানই ভারতীয় উপমহাদেশের এই সংঘর্ষের মূল কারণ। নিরাপত্তা পরিষদে পাকিস্তানি প্রতিনিধিরা পূর্ব পাকিস্তানে এক গুরুতর রাজনৈতিক সংকটের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। এই সংকট এখন পাকিস্তানের সীমানা অতিক্রম করে অনেকদূরে পরিব্যাপ্ত হয়েছে এবং একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। এটা গুরুতর আন্তর্জাতিক ফলাফল ও জটিলতার উসকানি সৃষ্টি করেছে। এই বাস্তবতা থেকে পালিয়ে যাওয়া, সংঘর্ষের প্রকৃত কারণগুলোকে নীরবে উপেক্ষা করা এবং সন্ত্রাস ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সংগ্রামকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় পরিচালিত ভারতীয় চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের ফল বলে ভান করা খুবই হাস্যকর ব্যাপার। এই আজগুবি কাণ্ড ছোট শিশু অথবা আকাট মূর্খদেরই উপযোগী। এসব ব্যাপার সাধারণ পরিষদকে সমস্যার মূল বিষয় থেকে দূরে সরিয়ে নেবে এবং প্রশ্নটির গুরুতর ক্ষতিসাধন করবে। সমস্যার মূলবস্তু হচ্ছে এই যে, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের রক্তাক্ত দমননীতির ফলেই পূর্ব পাকিস্তানে লক্ষ লক্ষ শান্তিপ্রিয় নরনারী মৃত্যুবরণ করেছে এবং প্রায় ১ কোটি মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে প্রতিবেশী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।
এটা এক বিরাট ট্র্যাজেডি। ইতিহাসে এমন ঘটনা পূর্বে কখনো ঘটেনি এবং এই বাস্তবতা সম্বন্ধে অন্ধ থাকতে থাকতে পারে কেবল তারাই—যারা এই রক্তাক্ত সন্ত্রাস ও উৎপীড়নকে উৎসাহ দিচ্ছে ও লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। ঘটনাবলির ইতিহাস সকলেরই জানা আছে। এখানে তৎসম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এবং আমি এখন আর এ বিষয়ে কিছু বলব না। জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত ১৬৭ জন সদস্যের সকলকেই পার্লামেন্টের কাজে অংশগ্রহণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং তাঁদের পার্টিকে সরকার গঠনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। উক্ত পার্টি এই অধিকার জয় করে নিয়েছিল, কিন্তু সেটা প্রয়োগ করতে দেওয়া হয়নি তাকে। বিভিন্ন অজুহাতে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এইসব প্রতিনিধিদের সরকারে অংশগ্রহণে বাধা দিয়েছে। উপরন্তু তাঁদের নেতাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতর করা হয়েছে। বর্তমানে তাঁর ওপর বিচারের হুমকি উদ্যত।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এই ব্যাপারে এক দৃঢ় ও অবিচার মনোভাব গ্রহণ করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রীম সোভিয়েতের সভাপতিমণ্ডলীর সভাপতি কমরেড পদগোর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিকট পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের বিরুদ্ধে উৎপীড়ন ও রক্তপাত বন্ধ করার এবং মীমাংসার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পন্থা অবলম্বনের জরুরি আবেদন সংবলিত এক বিশেষ বাণী প্রেরণ করেন।
উক্ত বাণীতে বলা হয়, ‘আমরা নিশ্চিত যে, এটা সমগ্র পাকিস্তানি জনগণের স্বার্থের ও উক্ত এলাকার শান্তির পক্ষে অনুকূল হবে।’ দমনমূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখায় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে। এখন এটা সকলের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, পাকিস্তান সরকার যদি বিভিন্ন সরকার ও রাষ্ট্রনায়কদের, বিশেষভাবে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের প্রধানদের যুক্তিসঙ্গত পরামর্শ ও আবেদনে কান দিতেন তাহলে সাধারণ পরিষদে এ প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার কোনো প্রয়োজনই হত না। কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছেন বুঝতে পেরে এবং তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজতে গিয়ে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ প্রতিবেশী দেশ ভারতকে আক্রমণ করে বসেছেন। তাঁদের মতলব সুস্পষ্ট—পরিস্থিতির অবনতির প্রকৃত কারণগুলো থেকে বিশ্বের দৃষ্টিকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া, নিজেদের ক্লীবত্বকে ঢেকে রাখা এবং অপর কোনো পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাঁরা স্পষ্টত পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপান্তরিত করার এবং বৃহৎ শক্তিবর্গ ও জাতিসংঘের হস্তক্ষেপের মাধ্যমে তার সমাধান করার আশা করেছিলেন। নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনায় এর সত্যতা সম্পূর্ণরূপে প্রতিপন্ন হয়েছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না যে, ভারতীয় উপমহাদেশের সংঘর্ষের মূল কারণসমূহের চূড়ান্ত, দ্রুত ও কার্যকর বিলুপ্তি সাধন ব্যতিরেকে নিরাপত্তা পরিষদ কিংবা সাধারণ পরিষদ কেউই একটি উপযুক্ত মীমাংসায় উপনীত হতে পারবে না। প্রতিনিধিদের সবাই তাঁদের ভাষণে সঠিকভাবেই ভারত ও পাকিস্তানে যুদ্ধ-বিরতির প্রয়োজন ও গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে তাঁদের মধ্যে কয়েকজন—সংখ্যায় তাঁরা খুব কম নন—ঘটনাচক্রে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে সংশ্লিষ্ট আরেকটি সমস্যা—সংঘর্ষের প্রধান কারণটিকে অবিলম্বে দূর করার প্রয়োজন সম্পর্কে উল্লেখ করেননি। কেবল ভারত ও পাকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনীগুলোর মধ্যে যুদ্ধবিরতি হলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কোনো উপকার হবে না, এতে কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও হত্যাভিযান চালিয়ে যাওয়ার অধিকারই দেওয়া হবে।
এটা খুবই পরিষ্কার যে, সংঘর্ষের এই প্রধান উৎস, এই প্রধান কারণটির অবলুপ্তির প্রশ্নই হচ্ছে মূল বিষয়। কাজেই যুদ্ধ-বিরতির প্রশ্নের সঙ্গে এই দাবিটি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত থাকতে হবে যে, পাকিস্তান সরকার অবিলম্বে রক্তপাত বন্ধ করুক এবং দ্রুত ও বিনাশর্তে ডিসেম্বরের নির্বাচনে প্রদত্ত পাকিস্তানি জনগণের রায়কে মেনে নিক।
বহুসংখ্যক প্রতিনিধি ইতোমধ্যেই যেমন বলেছেন, এসব প্রশ্ন পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। তার মানে এই যে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণই কেবল তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করতে পারে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাজ করার অধিকার কারো অস্বীকার করা উচিত নয়। উক্ত অঞ্চলে উদ্ভূত রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতি সাধারণ পরিষদ চোখ বুজে থাকতে পারে না এবং চোখ বুজে থাকা পরিষদের উচিতও হবে না। সাধারণ পরিষদ সংঘর্ষের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে সমস্যার একটি অংশের মীমাংসার—যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করতে পারে না এবং তা করা পরিষদের উচিতও হবে না।
সাধারণ পরিষদ বাস্তবতাকে অগ্রাহ্য করে একপেশে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আরম্ভ করলে, যা প্রথমদিকে অধিকতর আকর্ষণীয় মনে হতে পারে, সমস্যার সমাধানে ও সংঘর্ষের দ্রুত অবসানে সহায়তা তো দূরের কথা, যুদ্ধ- বিরতি ঘটানো এবং উক্ত অঞ্চলে রক্তপাত বন্ধ করার কাজও অধিকতর জটিল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ভারতীয় উপমহাদেশের এই গুরুতর রাজনৈতিক বাস্তবতাকে মনে রেখে আমাদের প্রতিনিধিদল এ-এল ৬৪৮ নং দলিলের অন্তর্ভুক্ত খসড়া প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের বিবেচনার্থে পেশ করেছে। তার বিষয়বস্তু আমি ব্যাখ্যা করব না, যেহেতু প্রতিনিধিদলসমূহ তা অবগত আছেন। আমাদের প্রস্তাবের সারমর্ম হলো এই যে—যুদ্ধবিরতি, রক্তপাত ও হানাহানির অবসান এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ভিত্তিতে তথাকার সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের আরম্ভ একই সঙ্গে হওয়া উচিত। আলোচ্য সমস্যাটি সম্পর্কে এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হলে শুধু যে যুদ্ধবিরতি সম্ভব হবে তাই নয়, বরং এতে সমগ্র অঞ্চলটিতে রক্তপাত বন্ধ হবে, শান্তিপ্রিয় জনসাধারণের বিনাশ ও দুর্দশার অবসান হবে, রক্তাক্ত দমননীতি বন্ধ হবে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের অবসান ঘটবে।
সোভিয়েত প্রতিনিধিদল এই প্রশ্নটি সম্পর্কে নিরাপত্তা পরিষদে যে ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা গ্রহণ করেছিল তা অপরিবর্তিত রয়েছে। আমরা এখানেও অনুরূপ দৃঢ়তার সঙ্গে ওই ধরনের একটি সিদ্ধান্তের জন্য চেষ্টা করব।
উপসংহারে চীনা প্রতিনিধিদল কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর পরিচালিত সর্বশেষ আক্রমণ সম্পর্কে আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই। জাতিসংঘের সদস্যগণ অধিক থেকে অধিকতর স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছেন যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও অন্যান্য সংস্থার বক্তৃতামঞ্চ চীনের কাছে প্রয়োজনীয় ছিল শান্তি ও নিরাপত্তা দৃঢ়তর করার মানসে জাতিসমূহের মধ্যে সহযোগিতার জন্য নয়, কিংবা নিরস্ত্রীকরণ ও ঔপনিবেশিকতার হতাবশেষগুলোর বিলুপ্তি ইত্যাদির জন্য নয়। সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতক চীনা দলত্যাগীরা এটাকে ব্যবহার করছে হীন কুৎসা ও সোভিয়েতবিরোধী প্রচারণার কাজে। দিনের পর দিন তারা এই প্রশংসাহীন নোংরা কাজে সর্বোপরি এই সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় কাজে জাতিসংঘ সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে চলেছে।
এই একই পুরাতন মিথ্যা বুলি—ইতিহাসের একপেশে বিকৃতি; ঐতিহাসিক তথ্যগুলোকে নিয়ে একঘেয়ে ভেল্কিবাজি, সম্পূর্ণরূপে অপ্রাসঙ্গিক কুখ্যাত মাঞ্চুকুও র উল্লেখসহ অতীত ঘটনাবলির তালিকা আবৃত্তি। দিনের পর দিন তারা ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’ কথাটা আওড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভদ্রমহোদয়গণ, সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদ ভাজা বরফের মতোই একটা মহা আজগুবি বস্তু। প্রতিনিধিরা অবশ্য এতে বিরক্তিবোধ করতে শুরু করেছেন এবং চীনা প্রতিনিধিবৃন্দ এখানে তাঁদের জন্য এই যে তামাশা চালু করেছেন তৎপ্রতি অনেকেই উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন।
নিরাপত্তা পরিষদে অন্যান্য প্রতিনিধি যা যা বলেছেন চীনা প্রতিনিধি এখানে সঙ্গে সঙ্গে প্রায় আক্ষরিক অর্থে হুবহু তারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। কেবল একটি জিনিস তিনি সাধারণ পরিষদকে বলেনি। তিনি বলেননি জাপানি জঙ্গিবাদীরা যাকে সিংহাসনে বসিয়েছিল সেই যুদ্ধাপরাধী ও দেশদ্রোহী প্রাক্তন মাঞ্চুকুও সম্রাটকে কীভাবে সোভিয়েত সেনাবাহিনী বন্দী করেছিল এবং চীনের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধী ও দেশদ্রোহীরা সর্বত্র শাস্তি পেয়েছিল—নুরেমবার্গে তাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, বেলজিয়ামে ফাঁসি কিংবা গুলি, নরওয়েতেও তারা পরিত্রাণ পায়নি। চীনারা উক্ত বিশ্বাসঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীকে লাইব্রেরিয়ান পদে নিয়োগ করে। এই ঘটনাটা চীনারা স্মরণ করতে চায়নি। এগুলো ঐতিহাসিক তথ্য।
জাতিসংঘের সভামঞ্চে এরকম দৃশ্যের অবতারণা করে তারা যদি আনন্দ পায়, তবে তারা তাই করে যাক। প্রতিনিধিদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এতে ইতোমধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন এবং জাতিসংঘের অভ্যন্তরে ও বাইরে সাম্রাজ্যবাদী মহলের প্রতিনিধিরা এই তামাশা দেখে খুবই মজা ও আমোদ অনুভব করছে।
তবে একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারা যায় না। সেটা হলো এই যে, সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাকারী এই ব্যক্তিদের সকল আক্রোশ ও সকল বিদ্বেষের লক্ষ্য হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এটা বোধগম্য। আমাদের নীতি ন্যায়ভিত্তিক, শান্তিকামী। আমরা সকল জাতির সঙ্গে বন্ধুত্ব উপভোগ করি। যেখানে সম্ভব, আমাদের সাধ্যানুযায়ী, আমরা অর্থনৈতিক ও নৈতিক সাহায্য দিয়ে থাকি। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২৪তম কংগ্রেসে আমাদের শান্তি ও মৈত্রীর নীতির রূপদান করা হয়েছে। এই কারণে তারা আমাদের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে তারা কিছুই বলে না। উপরন্তু, কতিপয় ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, সাধারণ অবস্থান থেকে তারা সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে যৌথ সংযোগ স্থাপন ও যৌথ কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। তারা ভারত-সোভিয়েত মৈত্রীর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করে। আমরা এই মৈত্রীর জন্য গর্বিত, একে আমরা আমাদের চোখের মণির মতোই প্রিয় জ্ঞান করি। এটা ছিল লেনিনের স্বপ্ন, আমরা তাকে বাস্তবায়িত করেছি। আমরা বাস্তবায়িত করেছি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের জনগণের মধ্যে, বন্ধুত্বের—এক যথার্থ, অকৃত্রিম ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ মৈত্রী এবং সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে। সমাজতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাকারী চীনারা ভান করছে যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতীয় উপমহাদেশ জয় করে চীনের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতে চায়। ও-কথা কে বিশ্বাস করবে? আমি আগেই বলেছি যে, ওরকম রূপকথা ক্ষুদে শিশু কিংবা আকাট মূর্খদের নিকট বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে।
জোট-বহির্ভূত দেশসমূহের প্রতিনিধিবৃন্দ, তৃতীয় বিশ্বের প্রতিনিধিবৃন্দ, আপনারা কি পিকিং-এর একটি অতি আকর্ষণীয় ধারণার দ্বারা সজাগ হয়ে ওঠেননি? বন্ধুত্বের অর্থ যদি নিয়ন্ত্রণ হয়, যদি তার অর্থ হয় শাসন, একটি অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাষ্ট্র যদি দুর্বলতর একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ হয় এবং তার অর্থ যদি এই দাঁড়ায় যে, শক্তিশালী রাষ্ট্রটিকে অবশ্যই দুর্বলতর রাষ্ট্রটির ওপর নিয়ন্ত্রণ ও প্রভুত্ব আরোপ করতে হবে, তবে কী এ-কথাই বুঝতে হবে না যে, এটা চীনের সত্যিকার মনোভাবেরই প্রতিফলন, চীনের প্রকৃত অভিসন্ধির অভিব্যক্তি? অভিসন্ধির? সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে, বিশেষভাবে জোট-বহির্ভূত দেশগুলোর সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি দেশগুলোর সঙ্গে, বন্ধুত্বের বুলি ঝেড়ে তাদেরকে স্বীয় প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণাধীন করা? আমার মনে হয়, এখানে উপবিষ্ট অনেকেই এই বিষয়টি সম্পর্কে গুরুত্বসহকারে ভাবনা চিন্তা করবেন।
সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনো কাউকে হুমকি দেয়নি, এখনো দিচ্ছে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন চীনকে হুমকি দিচ্ছে বলে আজ এই সভামঞ্চ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, তা একটা বানোয়াট, সর্বৈব মিথ্যা। চীন ও তার জনগণের প্রতি আমরা মৈত্রী ও সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করেছি। সোভিয়েত ইউনিয়নে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-উন্মাদনা সৃষ্টি করা হয়নি। চীনই সাম্প্রতিককালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-উন্মাদনা সৃষ্টির ও সোভিয়েতের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টির জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করেছে। তাহলে একটি অসুস্থ মস্তিষ্ক থেকে সুস্থ মস্তিষ্কের ওপর দায়িত্ব স্থানান্তরিত করার এই প্রচেষ্টা কেন? নিজের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ঢেকে রাখার জন্য—এটাই একমাত্র সম্ভাব্য ব্যাখ্যা।
সর্বশেষে, চীনা প্রতিনিধি সোভিয়েত ইউনিয়ন কী পরিকল্পনা করছে, কী সে করতে চায়, সম্পর্কে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আমি তাঁকে পরামর্শ দিতে পারি যে, আপনি সোভিয়েত যে, আপনি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ২৪তম কংগ্রেসের বিবরণী পাঠ করুন। ওতে আপনি শান্তির, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকে শক্তিশালী করার, দুনিয়ার সকল জাতির সঙ্গে বন্ধুত্ব বিকাশের একটি কর্মসূচী এবং যেসব জাতি এখনো ঔপনিবেশিকতার জোয়ালে আবদ্ধ রয়েছে, তাদের মুক্তির একটি কর্মসূচী খুঁজে পাবেন। এটাই হচ্ছে পার্টি কর্তৃক অনুমোদিত কর্মপন্থা এবং এই পরিকল্পনাই আমরা করছি।
সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা