You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারত উপমহাদেশের জনগণের বন্ধু এবং শত্রু

রেড স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে এ চিস্তিয়াকোভ বলেছেন, ‘ভারত উপমহাদেশে বর্তমান সামরিক সংঘর্ষের মূল কারণ ছিল পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের কার্যকলাপ, দেশের পূর্ব অংশে তাঁরা এক রক্তাক্ত সন্ত্রাস চালিয়েছিলেন।’
প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ভারত উপমহাদেশের জনগণের অকৃত্রিম মিত্ররা এ-রূপ বিপজ্জনক ঘটনার প্রতি উদাসীন থাকতে পারেননি। এ বছরের সেই এপ্রিল মাসেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ সোভিয়েতের সভাপতিমণ্ডলীর সভাপতি নিকোলাই পদগোর্নি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে প্রেরিত এক বার্তায় ‘পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য, সেখানকার মানুষের ওপর নিপীড়নের অবসান ঘটাবার জন্য এবং এক শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের উপায় উদ্ভাবনের জন্য অতি জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের’ আবেদন জানিয়েছিলেন।
গত সেপ্টেম্বর মাসে, শ্রীমতী গান্ধীর সম্মানে প্রদত্ত এক ভোজসভায় ভাষণ প্রসঙ্গে সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেকসেই কসিগিন বলেছিলেন: ‘সকল দেশের শান্তিকামী মানুষ, ভারত ও পাকিস্তানের সকল বন্ধুই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছে যথাশীঘ্র সম্ভব পূর্ব পাকিস্তানে এমন একটা রাজনৈতিক মীমাংসা প্রত্যাশা করেন, যাতে সেখানকার জনসমষ্টির ন্যায়সঙ্গত স্বার্থকে যথাযথভাবে গণ্য করা হবে, তার স্বাভাবিক বিকাশকে সুরক্ষিত করবে এবং পাক-ভারত সম্পর্কের অধিকতর অবনতির বিপদ দূর করবে।’ ভারত উপমহাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিকাশের পক্ষে একান্ত গুরুত্বপূর্ণ শান্তিকে রক্ষা করায় আগ্রহী, সেখানকার জনগণের অকৃত্রিম মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থান এই ছিল, এখনও আছে।
প্রবন্ধে বলা হয়েছে, অন্য কিছু কিছু রাষ্ট্রের রাজধানীতে ভারত উপমহাদেশের বিপজ্জনক ঘটনাবলির সম্পর্কে একেবারে ভিন্ন একটি মনোভাব দেখা গেছে। বস্তুতপক্ষে, ওয়াশিংটন বা লন্ডন কেউই ভারত উপমহাদেশের ঘটনা সম্পর্কে সরকারি কোনো বক্তব্য বলেনি। অধিকন্তু, কিছু সংবাদপত্র সামরিক তৎপরতা শুরু করার জন্য ভারত ও পাকিস্তানকে সরাসরি উসকানি দিতে থাকে আর পেন্টাগন সর্বক্ষণ পাকিস্তানকে তার অস্ত্র সরবরাহ চালিয়ে যেতে থাকে অব্যাহতভাবে। তদুপরি, মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও পুনর্গঠন ব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক কনসর্টিয়াম (এখানেও মূল গায়েন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) ভারতকে প্রদত্ত সাহায্যের পরিমাণ প্রচণ্ডভাবে হ্রাস করে। এখন জানা গেছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে।
প্রবন্ধকার দেখিয়েছেন যে, পিকিংয়ের নেতৃত্ব মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে একই শিবিরে গিয়ে ভিড়েছেন। ভারত উপমহাদেশের ঘটনা সম্পর্কে তাঁদের অবস্থান বরং আরো ক্ষতিকর। একথা সুবিদিত যে, মাওবাদীরা ইতিপূর্বে ‘গ্রাম দিয়ে শহরকে ঘেরা’, ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ প্রভৃতি তাঁদের ছদ্ম-বিপ্লবী স্লোগানগুলো পূর্ব পাকিস্তানে প্রচার করতে প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন। তাঁদের চরম- বামপন্থী চরদের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে তাঁরা নিয়ন্ত্রিত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু প্রাথমিক নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে একটা গণ-আন্দোলন যখন দানা পাকিয়ে উঠতে শুরু করল, তখন তথাকথিত ‘জনযুদ্ধের’ পিকিংস্থিথ উসকানিদাতারা সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে মাখামাখি করতে শুরু করলেন। পূর্ব পাকিস্তানে রক্তাক্ত নিপীড়নের নিন্দা করা তো দূরের কথা, তাঁরা পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের এ ধরনের কাজকে সমর্থন করলেন এবং তাদের সামরিক সাহায্য দিলেন।
বর্তমানে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষের সময়ে, পিকিং যুদ্ধের অগ্নিশিখাকে আরো বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করে। সুবিদিত তথ্য ও ঘটনাবলিকে উড়িয়ে দিয়ে সে ভারতের নামে ‘আগ্রাসনের’ অভিযোগ তোলে এবং পাকিস্তানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানায়। নিরাপত্তা পরিষদে এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে ভারত উপমহাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে আলোচনার সময় মাও সে-তুঙের প্রতিনিধিবর্গ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিবর্গ কথা বলেন সমস্বরে। চিস্তিয়াকোভ বলেছেন, ভারত উপমহাদেশে এখন যেসব মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে, তাতে এই উপমহাদেশের জনগণের প্রকৃত বন্ধু ও প্রকৃত শত্রুর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা, যারা তাঁদের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে আর যারা সংঘর্ষ বাড়িয়ে তুলতে চায়, তাকে আরো জটিল করতে চায় তাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা সহজ হয়ে উঠেছে। পোলিশ ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স পার্টির ৬ষ্ঠ কংগ্রেসে বক্তৃতা প্রসঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেঝনেভ জোর দিয়ে বলেছেন: ‘বাইরের কোনো শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়া, জনগণের বিধিসম্মত অধিকারকে যথাযথভাবে গণ্য করে এবং উক্ত অঞ্চলে এক স্থায়ী ও ন্যায়সঙ্গত শান্তির উপযোগী অবস্থা সৃষ্টির জন্য, সেখানে যেসব সমস্যার উদ্ভব হয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন দৃঢ়তার সঙ্গে তার একটা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক মীমাংসার সপক্ষে।’
উপসংহারে চিস্তিয়াকোভ বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক গৃহীত এবং প্রচুর সংখ্যক শান্তিকামী রাষ্ট্র কর্তৃক সমর্থিত এরূপ অবস্থানই ভারত উপমহাদেশের জনগণের প্রকৃত স্বার্থের অনুকূল হবে।
১৩ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!