You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.10 | পাক-ভারত উপমহাদেশে সংকটের মূল কারণ দূর করতে হবে - আই প্লিশেভস্কি, এপিএন ভাষ্যকার - সংগ্রামের নোটবুক

পাক-ভারত উপমহাদেশে
সংকটের মূল কারণ দূর করতে হবে
আই প্লিশেভস্কি
এপিএন ভাষ্যকার

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এমন কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে পাক-ভারত উপমহাদেশে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে পারে। খসড়া প্রস্তাবের অভাবের জন্য যে এটা হয়েছে, তা নয়। বরং খসড়া প্রস্তাব অনেকগুলোই ছিল। কিন্তু অধিকাংশ প্রস্তাবই মূল সমস্যা সমাধানের কথা বলেনি। মূল সমস্যা হলো পাক-ভারত উপমহাদেশে সংকটের কারণ নির্ণয়। সেজন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তোলার কাজে এইসব প্রস্তাবের কোনো অবদান নেই।
ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে এবং দুপক্ষের সশস্ত্র বাহিনীকে স্ব স্ব সীমানায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য যে মার্কিন প্রস্তাব গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিনিধি সমর্থন করেছে, ইতালি ও বেলজিয়ামের যুক্তভাবে রচিত যে প্রস্তাবে জাপানও যোগ দিয়েছে এবং নিরাপত্তা পরিষদের আটটি অস্থায়ী সভ্য দেশের প্রতিনিধিরা যে খসড়া প্রস্তাব রচনা করেছে, সেই প্রস্তাব বাইরে থেকে আকর্ষণীয় মনে হয়।

সমস্যার মূল
কিন্তু ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই সশস্ত্র সংঘর্ষ বন্ধ হলেই কি পাক-ভারত উপমহাদেশে রক্তপাত বন্ধ হবে? মোটেও তা হবে না। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে এপ্রিল, মে এবং জুন মাসে বা তারপরেও কোনো সংঘর্ষ শুরু হয়নি। সংঘর্ষ শুরু হল ডিসেম্বর মাসে। কিন্তু ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে অজস্র ধারায় রক্ত প্রবাহিত হলো। পূর্ব পাকিস্তানের বহু সহস্র মানুষ নিহত হলো। আর প্রায় এক কোটি মানুষ কোনোরকমে প্রাণ নিয়ে ভারতে পালিয়ে এল, কারণ পূর্ব পাকিস্তানে তখন ব্যাপক সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলার রাজত্ব শুরু হয়। যদি কেউ ‘শীঘ্র’ অথবা ‘অবিলম্বে’ যুদ্ধ বন্ধের ডাকে সাড়া দেয়, তবে তার অর্থ হবে এই যে, নিরাপত্তা পরিষদ নতুনভাবে পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এবং নতুনভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিজের দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করছে।
ফলত, সামরিক সংঘর্ষ বন্ধ করাই একমাত্র জরুরি কাজ নয়। এই রক্তপাত বন্ধের কথা সোভিয়েত ইউনিয়নের খসড়া প্রস্তাবে আছে। কিন্তু গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রতিনিধিদের ভেটো প্রয়োগের ফলে এই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।
মার্কিন খসড়া প্রস্তাবে পাক-ভারত সীমান্তে জাতিসংঘের সামরিক পর্যবেক্ষক রাখার কথা বলা হয়েছে। এই ব্যবস্থা গ্রহণের অর্থ হলো এই যে, এর ফলে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে তার বিরোধীদের ওপর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার অবাধ সুযোগ দেওয়া হবে—আর তারাই হলো পাকিস্তানের জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। তাদের জীবনে শতগুণ দুর্দশা নেমে আসবে। সীমান্ত পেরিয়ে জীবনরক্ষার যে সুযোগ ও সম্ভাবনা ছিল, তাও নষ্ট হয়ে সেখানে এক বাধার সৃষ্টি হবে। তার ফলে মনে হবে যেন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সন্ত্রাস সৃষ্টির কাজকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ পরোক্ষে সমর্থন জানাচ্ছে।

মুক্তিকামী মানুষের ওপর নিপীড়ন
একথা সকলেরই জানা আছে যে, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, সেই সংসদীয় নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের রাজনৈতিক আস্থা জ্ঞাপন করেছিল। আওয়ামী লীগ এক রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে থেকেও পূর্ব পাকিস্তানে স্বশাসনের অধিকার দাবি করেছিল, সেই প্রদেশের গণতান্ত্রিক পরিবর্তন দাবি করেছিল এবং সামরিকগোষ্ঠী থেকে পাকিস্তানের সদস্যপদ প্রত্যাহার দাবি করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একবাক্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সমর্থন জানায়। কিন্তু এর ফলে, সে সমস্যার উদ্ভব হলো, গণতান্ত্রিকভাবে তার রাজনৈতিক সমাধান না করে পাকিস্তানি সরকার ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আওয়ামী লীগকে বে-আইনী ঘোষণা করল এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর ভোটদাতারা যে নির্দেশ দিয়েছিল তা নাকচ করল, মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাকে কারারুদ্ধ করা হলো এবং তাদের গোপন বিচার শুরু হলো। কিন্তু পাকিস্তানের সরকার এখানেই থেমে থাকল না। সরকার ঠিক করল যে, যারা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভোট দিয়েছে, তাদের শায়েস্তা করা হবে। এই ঘৃণ্য কাজের দায়িত্ব সেনাবাহিনী এবং গোঁড়া আধা-সামরিক রাজাকারদের ওপর অর্পিত হলো। তাদের সেই নিপীড়ন এখনও অব্যাহতভাবে চলছে।
এক কোটি বাস্তুহারা মানুষের ভাগ্য কি এ রকম অবস্থায় পরিবর্তিত হতে পারে? স্বেচ্ছায় বাস্তুহারাদের পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির নিষ্পাপ কথা বললেই কি অবস্থার পরিবর্তন হবে (মার্কিন খসড়া)? নাকি তাড়াতাড়ি লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারার স্বেচ্ছায় স্বদেশে ফিরে যাওয়ার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির কথা বললেই অবস্থার পরিবর্তন হবে (ইতালিয়ান-বেলজিয়াম খসড়া)? এর জবাব থেকেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

রাজনৈতিক সমাধানসহ যুদ্ধ বন্ধ
পাক-ভারত উপমহাদেশে শান্তি স্থাপনের জন্য সোভিয়েত প্রতিনিধি একটা খসড়া প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। এই প্রস্তাব রচনার সময় প্রতিনিধিদের মতামতের কথা মনে রাখা হয়েছিল। সোভিয়েত খসড়া প্রস্তাবে একটা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে অবিলম্বে যুদ্ধ এবং সামরিক অভিযান বন্ধের জন্য এবং একই সঙ্গে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ব্যক্ত পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অভিলাষ অনুযায়ী একটি রাজনৈতিক সমাধানের উপযুক্ত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাকিস্তান সরকারকে রাজি করাতে সমস্ত সংশ্লিষ্ট দেশকে আহ্বান জানানো হয়। প্রস্তাবে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ বন্ধ এবং রাজনৈতিক সমাধানের সমস্যা অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।
সমস্যার ন্যায্য সমাধানের উদ্দেশ্যে রচিত এই প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে কোনো কোনো প্রতিনিধি নিরাপত্তা পরিষদে এ সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা বন্ধ রাখার প্রস্তাব আনে এবং প্রশ্নটিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করে। অধিকাংশ প্রতিনিধি এই প্রস্তাব সমর্থন করে।
জাতিসংঘে শেষ পর্যন্ত কোন প্রস্তাব গৃহীত হবে, তা ভবিষ্যতই ঠিক করবে; কিন্তু পাক-ভারত উপমহাদেশে যদি সত্যিকারের শান্তি স্থাপনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়, তবে প্রধান কর্তব্য হলো অবিলম্বে রক্তপাত বন্ধ করা এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বার্থ ও ন্যায্য অধিকারের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান করা।
এপিএন, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা