ভারত-পাক সংঘর্ষ এবং
পিকিংয়ের সোভিয়েত-বিরোধিতা
ভারতীয় উপমহাদেশে পরিস্থিতির যেমন অবনতি ঘটছে, পিকিং প্রচারযন্ত্র তেমন একের পর এক সোভিয়েতবিরোধী বিবৃতি প্রচার করে চলেছে। শুধু গত তিন দিনেই প্রকাশিত হয়েছে একটি সিনহুয়ার বিবৃতি, তাসের বিবৃতি প্রসঙ্গে ‘জেনমিন জিপাও’-তে একটি প্রবন্ধ এবং ব্রিটিশ ‘সানডে টাইমস’-এর সঙ্গে চৌ এন-লাইয়ের সাক্ষাৎকার, এর সঙ্গে যদি জাতিসংঘে চীনা প্রতিনিধির পর পর সোভিয়েতবিরোধী ও ভারতবিরোধী বিবৃতিগুলো যোগ করা যায়, তাহলে পিকিংয়ে উগ্র সোভিয়েত-বিরোধিতার পরিমাণের একটা চিত্র পাওয়া যাবে।
পিকিংয়ের প্রচারযন্ত্র এক কুৎসামূলক অপবাদ দিচ্ছে যে, ভারত ও পাকিস্তানের ঘৃণ্য সংঘর্ষের কারণ ‘সোভিয়েত উসকানি’ এবং সোভিয়েত-ভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তি ‘ভারত হতে সশস্ত্র আগ্রাসন বাধাবার একটি হাতিয়ার’।
সত্য ঘটনা ও যুক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে চীনা প্রচার ও চীনা নেতৃবৃন্দ সত্যকে বিকৃত করছেন, চীনের জনগণকে ভুল সংবাদ দিচ্ছেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য দেশের মধ্যে বিভেদেও বীজ বুনতে চেষ্টা করছেন।
একই সময়ে পিকিং ১৯৭০, ডিসেম্বরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সর্বসম্মত সমর্থনকে অস্বীকার করছে। স্বশাসনের জন্য, মৌলিক নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সংগ্রামকে, এ বছর মার্চ মাসে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে আলোচনা ভেঙে দেওয়াকে, কর্তৃপক্ষ ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর পাইকারী দমনপীড়ন ও সন্ত্রাসকে পুরোপুরি অস্বীকার করা হচ্ছে। নির্মম দমনপীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের ভয়ে যে নিযুত নিযুত পূর্ব পাকিস্তানিকে ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে, তাদের সমর্থনে পিকিংয়ের প্রচারযন্ত্র একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি।
অহংবাদী লক্ষ্য অনুসরণ করে পিকিংয়ের প্রচারযন্ত্র পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের ওপর পাইকারী দমনপীড়ন ও সন্ত্রাসের ওপর চুনকাম করার, সেখানকার শান্তিপূর্ণ জনগণের ওপর রক্তাক্ত দমনপীড়নের পক্ষ সমর্থনের পথ গ্রহণ করেছে। জ্ঞাত তথ্যাদির সম্পূর্ণ বিপরীতে বিভিন্ন প্রবন্ধে বলা হচ্ছে যে, পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের সমস্যাটি নাকি সৃষ্টি হয়েছে ভারতের ‘অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম ও প্রচারের দরুন।
পিকিং তার প্রচারে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের খাঁটি প্রতিনিধিদের ‘পাকিস্তানের বিভেদ সৃষ্টিকারী’ হিসেবে এবং যারা পূর্ব পাকিস্তানি জনসাধারণের ওপর স্বেচ্ছাচারিতা চালাচ্ছে, তাদের ‘জনগণের স্বার্থের প্রবক্তা’ হিসেবে চিত্রিত করা হচ্ছে। কাজেই, নিরাপত্তা পরিষদে ভারতীয় উপমহাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাকালে পিকিংয়ের প্রতিনিধি যে নিরাপত্তা পরিষদের সভায় পূর্ব পাকিস্তানের জনসমষ্টির প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানাবার ও তাঁদের মতামত শোনার বিরোধিতা করেছিলেন, তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। আমেরিকান প্রতিনিধিদের সঙ্গে একযোগে জাতিসংঘে চীনা প্রতিনিধি মার্কিন খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। এই প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তানের জনসমষ্টির, এই এলাকায় শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থ হাসিল করে না।
ভারতের বিরুদ্ধে এক কোটি পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীকে ভারতে পালিয়ে যেতে ‘প্রলুব্ধ করার’ দোষারোপ করে চীনা প্রচারযন্ত্র তিব্বতে ১৯৫৯ সনের অভ্যুত্থানের কথা উল্লেখ করেছে, যখন ‘জেনমিন জি পাও’-এর মতে, ‘হাজার হাজার চীনা বাসিন্দা’ তিব্বত থেকে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল। এবারেও চীনা প্রচারযন্ত্র নিজ মুখোশ খুলে দিয়েছে। হাজার হাজার চীনা ও নিযুত নিযুত পাকিস্তানি নাগরিককে যখন রাজনৈতিক ও অন্যান্য কারণে আশ্রয় নেবার জন্য প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যেতে হবে, তখন খাস চীনেও সবকিছু ঠিক ঠিক চলছে না, এটাই মনে হবে।
ভারত-পাকিস্তানি সংঘর্ষের সূত্রে চীনা প্রচারযন্ত্রের তীক্ষ্ণ সোভিয়েত বিরোধিতা, পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পরিচালিত পাইকারী দমনপীড়ন ও সন্ত্রাসের, মুক্তি ও ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম দমনের সাফাই গাইবার প্রচেষ্টা—এ হলো আরও একটি প্রমাণ যে, চীনা নেতৃত্ব জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ভাগ্য এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের স্বার্থ সম্পর্কে মোটেই উৎকণ্ঠিত নয়। বস্তুতপক্ষে তারা এই সংগ্রামের বিরুদ্ধপক্ষের সঙ্গেই যোগ দিচ্ছে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করে মাওবাদী নেতৃত্ব ভারতীয় উপমহাদেশে ঘটনাবলির সূত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্পষ্ট অবস্থানকে বিকৃত করে দেখাবার চেষ্টা করছে। এই অবস্থান সুবিদিত—সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানে অতি সত্বর রক্তপাত বন্ধ করার এবং সেখানকান জনগণের আইনসম্মত অধিকার ও স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে রাজনৈতিক মীমাংসার পক্ষে অবিচলভাবে দাঁড়িয়েছে।
তাস, ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা