ভারতীয় উপমহাদেশ
বিয়োগান্ত নাটকের তৃতীয় অঙ্ক
স্পার্তাক বেগলভ
একই ঘটনার কত বিভিন্ন রকমের মূল্যায়ন হতে পারে—জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ সম্পর্কিত বিতর্কে সেই মূল্যায়নের বিভিন্নতাই স্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছে। কতকগুলো প্রস্তাবের উত্থাপকরা বিবদমান দুই পক্ষকে ছাড়িয়ে দেওয়ার কথা বা সরিয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন, যেন এটা খুব সাধারণ, মামুলি লড়াই। কিন্তু আজকের এই পৃথিবীতে অনেক অসাধারণ ও উত্তপ্ত ঘটনা ঘটে। এবং যদিও সীমান্তের দুই দিকেই ট্যাঙ্ক এবং বিমান বহরের আক্রমণ চলছে, এই পরিস্থিতির মূল কারণ হলো এই যে, এই বিরোধের আসল ঘাঁটি সংস্থাপিত হয়েছে এবং এই যুদ্ধের প্রধান প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়েছে পাকিস্তানের মধ্যে।
ভারতীয় উপমহাদেশের বিয়োগান্ত নাটকের কয়েকটি অঙ্ক আছে। প্রথম অঙ্কটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের চিত্রনাট্য অনুযায়ী ২৫ বছর আগে অভিনীত হয়েছিল। সেই সাম্রাজ্যবাদীরা ভারতবর্ষ এবং পাকিস্তানের স্বাধীনতার ছক নিজেদের খুশিমত তৈরি করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল আর তা তৈরি হয়েছিল বিভেদ সৃষ্টি করে শাসন করার নীতির ওপর। ১৯৬৫ সালে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, সেই যুদ্ধ এই রক্তাক্ত চিত্রনাট্যের সঙ্গে জড়িত একটি অধ্যায়।
দ্বিতীয় অঙ্ক অনিবার্যভাবেই শুরু হলো একটা মানবজাতিগত এবং অর্থনৈতিক অসঙ্গতি থেকে, যে অসঙ্গতি পাকিস্তানের গঠনের মধ্যে, তার দুই অংশের মধ্যে নিহিত ছিল। ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত সারা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের একটি সভায় উপস্থিত থাকার সুযোগ বর্তমান লেখকের ঘটেছিল। অবশ্য ঢাকায় এই সভার অনুষ্ঠান একটা ব্যতিক্রম হিসেবেই হয়েছিল। পদ্ধতিগত বিরোধ নিয়ে দুই দলের মধ্যে সভার শুরুতেই যে বিরোধ বাঁধল, একজন বিদেশি পর্যবেক্ষক তা দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় না হয়ে পারে না। আর বিরোধের বিষয়টা হলো—কোন ভাষায় সভার কাজ চলবে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা উর্দু ভাষায় কথা বলে এবং তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা—বাংলা ভাষা বুঝতে পারে না। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা দাবি করলেন যে, যেহেতু সভা হচ্ছে তাদের দেশে পূর্ব পাকিস্তানে, সেহেতু বাংলা ভাষাকেই প্রধান সরকারি ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। পূর্ববর্তী উপনিবেশবাদীরা যে উত্তরাধিকার রেখে গেছেন, সেই উত্তরাধিকার অনুসারেই একটা মিটমাট হলো। ইংরেজি ভাষা একটি ‘তৃতীয়’ সরকারি ভাষা হিসেবে গৃহীত হলো। কিন্তু আসল জায়গায় এ দু পক্ষই ফেটে পড়ল। আর সেই বিষয় হলো পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থ এবং সম্পদের বণ্টন। পূর্ব পাকিস্তানের শিল্প অপরিণত। তাছাড়া সর্বনাশা বন্যা এবং খরার ফলে তার আদিম কৃষি ব্যবস্থা বিপর্যস্থ। সেইজন্য তার দাবি হলো—বেশি না হোক, অন্তত সমান সমান ভাগ আমাদের চাই। অন্যপক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা প্রধান শত্রু ভারতের বিরুদ্ধে জিগির তুলল। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ তাদের ন্যায্য দাবির কথাই বলেছিলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন সুবিচার, তাঁদের জন্য সুবিচার এবং যে দেশে তাঁরা জন্মগ্রহণ করেছেন, সেই দেশের জন্য সুবিচার। পাঁচ বছর আগে এভাবেই পাকিস্তানের প্রধান অসঙ্গতিগুলো উলঙ্গভাবে লোকচক্ষুর সম্মুখে দেখা দিয়েছিল।
তখনই এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, কল্পিত শত্রুর বিরুদ্ধে যত জঙ্গী জিগিরই তোলা হোক এবং দেশের মধ্যে জঙ্গী সামরিক শাসনের শৃঙ্খল যতই শক্ত করা হোক, তাতে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে না এবং এশিয়ায় শান্তির সম্ভাবনাও বাড়বে না।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে আশার আলো প্রজ্জ্বলিত করে। মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তাদের পার্টি আওয়ামী লীগ পাকিস্তানি সংসদের সভ্য নির্বাচনে অধিকাংশ আসন লাভ করে। এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জীবনে তাদের ন্যায্য স্বার্থ রক্ষার একটা সুযোগ আসে। কিন্তু তাদের সে আশা পূর্ণ হলো না। পূর্ব পাকিস্তানে ‘এক অমানুষিক’ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হলো। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে লক্ষ লক্ষ মানুষের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়েছে। এই অত্যাচারিত মানুষের সংখ্যা কত, তা এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি।
এক কোটিরও বেশি মানুষ প্রাণরক্ষার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় সীমান্তে প্রবেশ করেছে। এটা যে শুধু একটা শরণার্থী প্রবাহ, তা নয়৷ পূৰ্ব পাকিস্তানের আগ্নেয়গিরি উদ্গীরণের ফলে ভারতবর্ষে এমন একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো, যে পরিস্থিতিতে সে দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত হওয়ার মুখে এসে দাঁড়াল এবং তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিল। তবু পাকিস্তানের রাজধানী থেকে ঘন ঘন যেসব ভয় দেখানো বিবৃতি দেওয়া শুরু হলো তাতে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে যারা অমানুষিক দমননীতি চালিয়েছে তাদের উদ্দেশ্য হলো ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জিগির তুলে দেশের আগুন নির্বাপিত করা।
এবং যখন তারা যুদ্ধের আগুন নেভানোর জন্য ‘দু পক্ষের সৈন্যবাহিনী অপসারণের’ কথা বলে এবং ‘যুদ্ধ বিরতির’ কথা বলে তখন তারা ভুলে যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ইচ্ছা ও মনোভাবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান না করলে যুদ্ধের আগুন নির্বাপিত করা যাবে না।
সুতরাং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি স্থাপন এবং নিরাপত্তা বিধানের চাবিকাঠি রয়েছে পাকিস্তানি শাসকদের হাতে। তারা একটা সমগ্র জাতিকে সুবিচার থেকে বঞ্চিত করেছে। তারা ভেবেছে যে, তরবারি দিয়ে সবকিছুকে শায়েস্তা করা যায়। সুবিচার প্রতিষ্ঠার সময় এখনো আছে। তখন আর তরবারির প্রয়োজন হবে না। তরবারি তার খাপের মধ্যে ফিরে যাবে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বদাই চেয়েছে যে, ভারতীয় উপমহাদেশ শান্তির ক্ষেত্র হোক। সে দেশের জনসাধারণ অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিকাশের সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের উদ্যমকে পুরোপুরি নিয়োজিত করুক। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, ১৯৬৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতবর্ষ ও পাকিস্তানের মধ্যে তাসখন্দ চুক্তি সম্পাদিত করিয়ে আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনার হাত থেকে দুই দেশকে রক্ষা করেছিল। এই সামরিক সংঘর্ষের মুখে সোভিয়েত ইউনিয়ন চায় যে, এই রক্তক্ষয় বন্ধ হোক এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ন্যায্য অধিকারের ভিত্তিতে একটা রাজনৈতিক সমাধান হোক৷
৮ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা