ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য
পি মেজেসেভ
গত বছর নভেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানে একটি প্রচণ্ড শক্তিসম্পন্ন ঝটিকাপ্রবাহ ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ধ্বংস ডেকে এনেছিল। এতে মারা যায় প্রায় ১০০০০০ লোক। বহু দেশ দুর্দশাপীড়িত জনগণকে সমবেদনা জানিয়েছে। ধ্বংসলীলার তৃতীয় দিনেই সোভিয়েত জাহাজ মেদ্নোগোরস্ক চট্টগ্রাম বন্দরে দুর্দশাপীড়িদের জন্য সাহায্য নিয়ে এসে পৌঁছায় প্রকৃতির রুদ্ররোষের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই আরও একটি ভীষণতর ট্রাজেডি পূর্ব পাকিস্তানের প্রপীড়িত জনগণের ওপরে নেমে এলো। ৭.৫ কোটি জনসংখ্যাবিশিষ্ট এই এলাকার প্রতিটি ব্যক্তিই কম বা বেশি পরিমাণে এই সঙ্কটে জড়িয়ে পড়েছিল।
ঘটনাটা কী ঘটেছিল? কেন লক্ষ লক্ষ লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রতিবেশী ভারতে পালিয়ে এসছিল?
স্মরণ করা যেতে পারে যে, পাকিস্তানের স্বাধীন বিকাশের ইতিহাসে গত ডিসেম্বর মাসেই সর্বপ্রথম জাতীয় পরিষদের (পার্লামেন্ট) জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে খ্যাতনামা রাজনৈতিক নেতা মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগও ছিল।
পাঁচ বছর পূর্বে উত্থাপিত ছয় দফা কর্মসূচী রূপায়িত করার স্লোগান নিয়ে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়। পাকিস্তানি রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যেই প্রদেশগুলো ব্যাপক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্ব-শাসন অনুমোদন করাই এই কর্মসূচীর সারাংশ। পাকিস্তানি রাষ্ট্র আগের মতোই প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়ে দেখাশোনা করবে। কর্মসূচীতে প্রগতিশীল সামাজিক অর্থনৈতিক সংস্কারসমূহ, বিশেষ করে, জমির সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ, ব্যাঙ্ক ও শিল্পের মূল শাখাগুলো রাষ্ট্রায়ত্তকরণের দাবি জানানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগের পররাষ্ট্র নীতিতে প্রতিবেশী ভারতসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের বৃদ্ধি এবং সিয়াটো ও সেন্টোর সামরিক জোট থেকে পাকিস্তানের বেরিয়ে আসার কথা বলা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টের আসনগুলোতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৩১৩-এর মধ্যে ১৬৭) লাভ করে এবং যুক্তিসঙ্গতভাবেই তাকে সরকার গঠন করতে আহ্বান করা উচিত ছিল। এটা অবশ্য ঘটলো না। নানা ছুতোয় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে দিলেন না। এছাড়া মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হলো ও ‘জাতীয় স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা’ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলো এবং তার অনুগামীবৃন্দ ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর অস্ত্র, ট্যাঙ্ক ও বিমানবহর নিয়ে গণনিপীড়ন শুরু করা হলো।
রাওয়ালপিণ্ডির সামরিক কর্তৃপক্ষের নিপীড়নমূলক কার্যকলাপের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সমগ্র উপমহাদেশের উত্তেজনার উৎস হয়ে উঠেছে। এই উত্তেজনা সমগ্র পৃথিবীর ন্যায়সঙ্গত উদ্বেগ উদ্রেক করছে।
সর্বপ্রথম রয়েছে ভারতে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীর সমস্যা, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী যার সংখ্যা হচ্ছে ১ কোটির কাছাকাছি। এত বিরাট সংখ্যক সহায় সম্বলহীন নিঃস্ব জনগণের আগমন ভারতের ওপর অত্যন্ত ভারী অর্থনৈতিক বোঝাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিসাব করে দেখা গিয়েছে যে, শরণার্থীদের শুধুমাত্র ভরণপোষণের জন্য দৈনিক ২.৫ কোটি টাকা ব্যয়িত হচ্ছে।
এটা কেউ না দেখে পারে না যে, পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন যে শরণার্থী সমস্যার জন্য দায়ী, তা ভারতীয় উপমহাদেশে দুটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্কের বিপজ্জনক অবনতি ঘটিয়েছে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট পাঠ করে দেখা যায় যে, ইতোমধ্যেই ভারত ও পাকিস্তানের সীমান্ত বরাবর বহু সৈন্য সমাবেশ করা হয়েছে। গোলাগুলি বিনিময়ের সময় শুধুমাত্র সামরিক ব্যক্তিই নয়, সীমান্তের উভয় পারের শান্তিপ্রিয় অধিবাসীরাও নিহত হয়েছেন। পরিস্থিতি ক্রমেই তীব্র হয়ে উঠছে এবং দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ বেঁধে যেতে পারে।
ভারত সরকারের নেতৃবর্গ বলেন যে, ভারত তার ভূখণ্ডে পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর ভরণপোষণের দায়িত্ব বহন করতে পারে না এবং তাঁরা ন্যায়সঙ্গতভাবেই নিরাপত্তার পরিস্থিতিতে শরণার্থীদের তাদের নিজ বাসভূমিতে দ্রুততম প্রত্যাবর্তন দাবি করেন। পাকিস্তানি নেতৃবর্গ তাঁদের দিক থেকে ঘোষণা করেন, তাঁরা ‘সকল খাঁটি পাকিস্তানি নাগরিকদের’ ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত এবং তাঁরা ইতোমধ্যেই তাঁদের প্রত্যাবর্তনের জন্য অভ্যর্থনা শিবির খুলেছেন এবং ভারত সরকার নাকি পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে আসায় ‘বাধা’ দিচ্ছেন।
অবশ্য বাস্তব ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে প্রচারিত ক্ষমা প্রদর্শন সত্ত্বেও বিশ্ব সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকেই জানা যায় যে, যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তাদের মধ্যে এক নগণ্য অংশকেই জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভায় সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে আইনসঙ্গতভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরসহ আওয়ামী লীগের অধিকাংশ সক্রিয় সদস্য জেলে পচতে থাকলেন এবং মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হলো। তাই এটা বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে, প্রত্যক্ষদর্শীদের খবর অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের এলাকায় অবস্থিত অভ্যর্থনা শিবিরগুলো হয় একেবারে শূন্য, নয়তো খুব কমসংখ্যক লোকই ভারত থেকে তার মাধ্যমে প্রত্যাবর্তন করেছে। সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার পূর্ব পাকিস্তানি অন্যদিকে প্রতিদিন সীমান্ত অতিক্রম করেই চলেছে।
বিশ্ব জনগণ এটা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করেন যে, লাহোরের মতো বড় বড় শহরগুলোসহ ভারত সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানি শহরগুলোতে সরকারি অনুমোদনে উগ্র জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিরা যে শোভাযাত্রা বের করছেন, তার স্লোগান হচ্ছে ‘ভারতের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ শুরু করা’ এবং ‘ভারতকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা’ প্রভৃতি। এটা প্রমাণের দরকার করে না যে, এ ধরনের কার্যকলাপ দুই দেশের সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার পরিপন্থী এবং এটা পরিস্থিতির আরও অবনতিই মাত্র ঘটাতে পারে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে শরণার্থী সমস্যা গুরুতর অসুবিধা সৃষ্টি করেছে। তাহলেও এটা তাদের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষের কারণ হওয়া উচিত নয়। ভারত ও পাকিস্তানের বহু রাজনৈতিক নেতা এটা অনুধাবন করেন যে, এ ধরনের সংঘর্ষ যদি বেঁধে যায় তাহলে উভয় দেশের জরুরি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানের প্রচুর নিহিত সম্পদকে পথভ্রষ্ট করবে। এটা কঠিন মানবিক ও বৈষয়িক ত্যাগের পথে নিয়ে যাবে এবং চূড়ান্ত বিচারে নতুন সমস্যাসমূহ সৃষ্টি করবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও অন্যান্য ভারতীয় নেতাগণ ঘোষণা করেছেন যে, ভারত সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সংঘর্ষ চায় না।
পূর্ব পাকিস্তানি সমস্যার রাজনৈতিক মীমাংসার ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান জটিলতা দূর করা যেতে পারে। সামরিক প্রশাসনের উচিত পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করা এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের গৃহে প্রত্যাবর্তনের প্রয়োজনীয় অবস্থা সৃষ্টির ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এইরকম একটি সমাধানই সর্বোপরি খোদ পাকিস্তানের স্বার্থসম্মত এবং উপমহাদেশে শান্তি রক্ষার আদর্শসম্মত হবে।
প্রাভদা, ৩ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা