You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.11 | এশিয়ার শান্তির জন্য মূল কর্মনীতি - স্পার্তাক বেগলভ - সংগ্রামের নোটবুক

এশিয়ার শান্তির জন্য মূল কর্মনীতি
স্পার্তাক বেগলভ
এপিএন রাজনৈতিক সংবাদদাতা

সম্প্রতি সম্পাদিত সোভিয়েত-ভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি এশিয়ার পরিস্থিতিতে এক নতুন উপাদান যোগ করছে। এটি এমন একটি এলাকায় বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সুনির্দিষ্ট দৃষ্টান্ত উপস্থিত করছে, পৃথিবীর অন্য যেকোনো স্থানের চেয়ে যে এলাকাটির শান্তি বেশি দরকার।
প্রথমত এই চুক্তিটিকে দেখা দরকার এই অঞ্চলে শান্তি ও শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের স্থায়িত্ব আনয়নকারী উপাদান হিসেবে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার স্বরণ সিংয়ের ভাষায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির চুক্তি’ হিসেবে।
বাইরের দিক থেকে এশিয়ার দৃশ্যপটকে মনে হবে বিরোধ ও রাজনৈতিক কূটাভাসের গোলকধাঁধা বলে: পঁচিশ বছর ধরে ইন্দোচীনের যুদ্ধ; পূর্ব পাকিস্তানের ট্রাজেডি; ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা; জাপানের ‘নিজেরই পারমাণবিক বোমার দাবি’ (যদিও এই দেশটি হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার বিভীষিকার মধ্য দিয়ে গেছে); সিয়াটো, সেন্টো, এশিয়ান, আনজুস, আসপাক প্রভৃতি অসংখ্য চুক্তি, জোট ও মিতালী এবং ‘ভিয়েতনামীকরণ” “নিকসন মতবাদ’ প্রভৃতি অসংখ্য নতুন ও পুরনো রাজনৈতিক ছাপ ও মতবাদ; কুড়ি বছর ধরে আপসহীন বৈরিতার পর পিকিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে হাসি বিনিময়; এবং সবশেষে আরব ও ইসরাইলের মধ্যে অতি চরম সংঘাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে যুক্ত সমস্যাটির এক বিশেষ জট।

প্রধান উপাদান
কিন্তু শান্তি ও প্রগতির আদর্শের প্রতি অনুরক্ত সবার কাছে এই বাইরেকার জটিলতা যেন প্রধান উপাদানটিকে আবৃত করে দেয় না। এই প্রধান উপাদান হলো শান্তি ও যুদ্ধের শক্তিগুলোর মধ্যে, সাম্রাজ্যবাদ ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘাতের অবস্থা। এরই মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব ও সামাজিক সংস্কারসমূহের ভাগ্য এবং এক বিশাল অঞ্চলে শান্তির ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে। কিন্তু একই সময়ে, শান্তিকামী শক্তিগুলোর সংগ্রামকে বানচাল করে এবং তাদের ঐক্যকে বিশৃঙ্খল করে দেয়, এমন বহু উপাদানকে অস্বীকার করাও মূর্খতা হবে। একদিকে উপনিবেশবাদ ইচ্ছা করেই জাতিগুলোর মধ্যে বিরোধের ও অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর অঙ্কুর রেখে গেছে। এই অঙ্কুরকে লালনপালন করার জন্য সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদ যথাসাধ্য করে চলেছে। অপরদিকে প্রগাঢ় সামাজিক ও পরিবর্তনসমূহের আধেয়হীন হলে এবং অভ্যন্তরীণ প্রকৃতির প্রথম অসুবিধাগুলোর সামনেই পতন ঘটলে নগ্ন জাতীয়তাবাদ চরমে পৌঁছাতে পারে এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির মধ্যে এবং জাতিগত পার্থক্যের ও অর্থনৈতিক সাম্যের দাবির প্রতি আপসহীন মনোভাবের মধ্যে নির্গমনের পথ খুঁজতে পারে।
সাম্রাজ্যবাদ এবং যুদ্ধের শক্তিগুলো মোটের ওপর পরাজয় বরণ করছে, কারণ এই পরাজয় ইতিহাস কর্তৃক পূর্ব-নির্ধারিত। ভিয়েতনামের ওপর বর্ষিত ৬০ লক্ষ টন বোমা সামরিক-শিল্পপতি জোটের বিজয় আনেনি। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ যদি নিজের শর্ত চাপিয়ে দেবার চেষ্টা না করে, তাহলে তার অভিধা ও প্রকৃতিই অর্থহীন হয়ে পড়ে।
এশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সহজ ও সুসঙ্গত রণনীতি হলো আগ্রাসনের শিকার জনসাধারণের অধিকারসমূহ পুরোপুরি পুনঃপ্রতিষ্ঠার ও যুদ্ধের বিপজ্জনক উর্বর ক্ষেত্রসমূহ দূরীভূত করার অভীষ্ট সিদ্ধ করা। এই এলাকায় স্থায়ী শান্তির অভীষ্ট সিদ্ধ করা। অবশ্য এটা একতরফা দানখয়রাতের ব্যাপার নয়। এই ধরনের কর্মনীতির পূর্বশর্ত হলো প্রতিদান। এ ‘বৃহৎ শক্তিসুলভ স্বার্থপরতা’ থেকেও মুক্ত। যারা সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর বৃহৎ শক্তিসুলভ প্রবণতার অভিযোগ আনতে চাইছে—যেমন পিকিংয়ের ‘বামপন্থী’ সুবিধাবাদীরা-তারা দোষ দিচ্ছে ভুল ক্ষেত্রে। প্রভুত্বকারী আধা-আকাঙ্ক্ষা থাকায় চীনের নেতৃত্ব অতি সহজেই এই সাম্রাজ্যবাদী স্লোগানটি লুফে নেয় যে, পৃথিবীতে প্রধান বিরোধ নাকি ‘অতি বৃহৎ’ ও ‘স্বাভাবিক’ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার বিরোধ। ‘অতি বৃহৎ শক্তি’ সম্পর্কে সোরগোল তুলে পিকিং কিছু কিছু দেশকে অন্যদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবার জন্য যেকোনো উপায়কে কাজে লাগাচ্ছে। আর এখানেই ‘বাম’ সুবিধাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে মিল। এই সাদৃশ্যকে সবিশেষ স্বচ্ছভাবে দেখতে হলে ভারত-পাক বিরোধের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং পাকিস্তানের সর্বাধুনিক ঘটনাবলি চলাকালে পিকিং ও ওয়াশিংটনের আচরণের তুলনা করলেই যথেষ্ট হবে।
,
শান্তির জন্য পররাষ্ট্র নীতিগত মূল কর্মনীতিকে অবশ্যই হতে হবে আন্তরিক, সৎ ও প্রকাশ্য। ঠিক এইগুলোই সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভারতের সঙ্গে শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তি সম্পাদনের সিদ্ধান্ত নিতে চালিত করেছিল। ভারত স্বাধীন হওয়ামাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন তার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিল। অনুরূপভাবে সে পাকিস্তানের দিকেও বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিল। এতে অন্তর্নিহিত ছিল যে সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে পারস্পরিকতা থাকবে। কারণ এরূপ পারস্পরিকতা সাম্রাজ্যবাদের দিকে পর্দার অন্তরালে সামরিক শিল্পগত ইশারার এবং জাতিগুলোর মধ্যে সংঘাত উসকে দেওয়ার পরিপন্থী। তাসখন্দ বৈঠক হয়ে উঠেছিল স্বার্থলেশহীন সোভিয়েত মধ্যস্থতার প্রতীক এবং সেই সময় ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের অবসান বিশেষ পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিয়েছিল যে, শত্রুতার অগ্নিশিখা শুধু তাদেরই কাজে লাগে, যারা ভারত-পাক উপমহাদেশে তাদের ‘ভেদ সৃষ্টির সাহায্যে শাসনের’ পাদানি খুঁজছে।
সোভিয়েত জনগণ বিশ্বাস করেন যে, ঔপনিবেশিক জোয়াল থেকে সম্প্রতি মুক্ত জনসাধারণ সর্বাগ্রে আগ্রহী শান্তি ও সু-প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কে, শান্তির বুনিয়াদকে বিনষ্ট না করে বরং প্রতিষ্ঠিত করে এমন এক পররাষ্ট্র নীতিতে। সেই কারণেই সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বদাই ভারতের পররাষ্ট্র নীতির সমস্ত রচনাত্মক দিক সম্পর্কে, জওহরলাল নেহরু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত যে মূলনীতিকে তাঁর অনুগামীরা কার্যকর করার চেষ্টা করেছেন, সেই মূলনীতি সম্পর্কে সহানুভূতিপূর্ণ মনোভাব গ্রহণ করেছে।

প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য
বিরাট আন্তর্জাতিক তাৎপর্যসম্পন্ন সোভিয়েত-ভারত চুক্তির মধ্যে দুটি দেশের জনসাধারণের স্বার্থসমূহের অভিন্নতার সারসংক্ষেপ করা হয়েছে। এটি হলো শান্তি রক্ষা সংহত করার জন্য, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে, অস্ত্র প্রতিযোগিতার অবসানের জন্য এবং সর্বজনীন ও পরিপূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য সংগ্রাম। চুক্তিতে বলা হয়েছে, সর্বস্তরে দু’দেশের নেতাদের এবং কূটনৈতিক সংগঠনের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ এই লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম প্রধান পদ্ধতি। চুক্তিতে দুই পক্ষের বাধ্যবাধকতাগুলো স্থির করে নেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো অপরপক্ষের বিরুদ্ধে, উদ্যত কোনো সামরিক জোটে অংশগ্রহণ না করা, চুক্তির বিরোধী কোনো গোপন বা প্রকাশ্য দায়-দায়িত্বে আবদ্ধ না হওয়া, চুক্তিবদ্ধ কোনো একটি পক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষরত তৃতীয় কোনো দেশকে সাহায্যদান থেকে বিরত থাকা এবং কোনো এক পক্ষ আক্রমণের বা আক্রমণের হুমকির শিকার হলে অবিলম্বে পরামর্শ করা।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের জোট-নিরপেক্ষ নীতিকে শ্রদ্ধা করে, তেমনিভাবে ভারতও সোভিয়েত ইউনিয়নের শান্তির কর্মনীতির প্রতি শ্রদ্ধা জানায়।
এই রাজনৈতিক ধারাগুলো ছাড়াও চুক্তিতে অর্থনৈতিক, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা, পরিবহণ, যোগাযোগ, শিল্প-সংস্কৃতি প্রভৃতি অন্যান্য ক্ষেত্রেও সকল ধরনের সহযোগিতাকে কাজে লাগাবার কথা ভাবা হয়েছে।
দুটি রাষ্ট্র তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরস্পরের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে শ্রদ্ধা করবে, পরস্পরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে এবং সমানাধিকার ও পারস্পরিক উপকারের মূলনীতির ভিত্তির ওপর তাদের সহযোগিতাকে প্রতিষ্ঠিত করবে।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, সোভিয়েত-ভারত চুক্তি যত কার্যকর হতে থাকবে, ততই এর রচনাত্মক দিকগুলো অধিক থেকে অধিকতর পরিমাণে প্রকাশ করবে।
সোভিয়েত-ভারত চুক্তি কোনো তৃতীয় দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত নয়। দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত শান্তিপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতার যে ধাঁচটি খুঁজে পেয়েছে, সেটিই সেই এলাকায় এক নতুন ধরনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে অনুকরণযোগ্য মানদণ্ড।
১১ আগস্ট ১৯৭১

সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা