You dont have javascript enabled! Please enable it!

রক্তপাত বন্ধ করতে হবে এবং বাইরের শক্তিগুলোর জড়িত না হওয়া নিশ্চিত করতে হবে
মিখাইল ক্রিলভ, এপিএন ভাষ্যকার

ভারত-পাকিস্তানি সামরিক সংঘর্ষ দুই দেশের দীর্ঘ-পীড়িত জনসাধারণের পক্ষে এক ভয়াবহ বিপর্যয়মাত্র নয়। এটি বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার পক্ষে বিপদস্বরূপ। ইতিহাস, বিশেষ করে উত্তাল বিংশ শতকের ইতিহাস, তর্কাতীতভাবে প্রমাণ করেছে যে, বিশ্বশান্তি অবিভাজ্য। এক জায়গায় জ্বলে উঠলে সামরিক দাবানল অন্যান্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার এবং সমগ্র আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটার সম্ভাবনা থাকে।
এই কারণেই ভারতীয় উপমহাদেশে রক্তপাতে কোনো শান্তিকামী রাষ্ট্র উদাসীন থাকতে পারবে না। এই কারণেই রক্তপাতের অবিলম্বে অবসান ঘটাবার জন্য সর্বপ্রয়াস নিয়োজিত করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আইনসম্মত অধিকার ও স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে সেখানে রাজনৈতিক মীমাংসার মাধ্যমেই শুধু এ করা সম্ভব।
এরূপ মীমাংসা ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা সম্ভব নয়। ট্রাজেডির প্রধান কারণ হলো, ইসলামাবাদের সামরিক কর্তৃপক্ষ নির্বাচনী অভিযানে উক্ত পূর্ব পাকিস্তানি জনসমষ্টির ইচ্ছাকে স্বীকার করে নিতে অস্বীকৃত হয়েছিল। এর বদলে তারা গণপ্রতিহিংসা চালিয়ে এই জনসমষ্টিকে আঘাত করেছিল এবং নিযুত নিযুত নর-নারীকে ভারতে আশ্রয় নেবার জন্য পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল।
সুস্থ মস্তিষ্কে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে এবং সবচেয়ে খারাপটুকুকে ঠেকাবার চেষ্টা করে সোভিয়েত সরকার পাকিস্তান সরকারকে প্রতিহিংসামূলক কাজ বন্ধ করার জন্য এবং গণতান্ত্রিক উপায়ে দেশের কঠিন সমস্যাগুলোর সমাধান করার জন্য পুনঃপুন আহ্বান জানিয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত সোভিয়েত ইউনিয়নের এই আহ্বানে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করেনি। স্পষ্টতই তারা এটা করেছিল প্রধানত এই কারণে যে, ইসলামাবাদের বিপজ্জনক কাজ সম্পর্কে অন্যান্য বৃহৎ শক্তি ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছিল—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভুয়া নিরপেক্ষতা দেখিয়েছিল এবং চীন সামরিক হঠকারিতাকে প্রকাশ্য উৎসাহ জুগিয়েছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন সব সময়ই চেষ্টা করেছে ভারত ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দুটি নবীন রাষ্ট্র যাতে শান্তিতে মিলেমিশে বাস করতে পারে এবং তাদের জনসাধারণের হিত ব্যবস্থার উন্নয়নে সর্বপ্রয়াস নিয়োজিত করতে পারে, সেজন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন সবকিছু করেছিল।
একথা সবাই জানেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়নের উদ্যোগ ও মধ্যস্থতার দরুন ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাসখন্দে ভারত-পাকিস্তানি আলোচনার সফল সমাপ্তি ঘটেছিল এবং সেই সময় ভারতীয় উপমহাদেশে সংঘর্ষের বিপদ দূর করতে সাহায্য করেছিল।
বিশুদ্ধ মানবিক উদ্দেশ্য ছাড়াও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি সংরক্ষিত করার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই সত্যটি সম্পর্কে চোখ বুজে থাকতে পারে না যে, এই এলাকাটি তার দক্ষিণ সীমান্তের একেবারে সন্নিকটে অবস্থিত।
ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘর্ষ সম্পর্কে প্রচারিত তাস-এর সাম্প্রতিক বিবৃতিতে স্বাভাবিকভাবেই সোভিয়েত ইউনিয়ন একথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, এই এলাকায় বর্তমান ঘটনাবলি তার সীমান্তের একেবারে সন্নিকটে ঘটছে এবং তার নিরাপত্তার স্বার্থের ওপর আঘাত হানছে—একথা বিবেচনা করে এই ঘটনাবলি সম্পর্কে সোভিয়েত ইউনিয়ন উদাসীন থাকতে পারে না।
সোভিয়েত সরকার মনে করে যে, সবগুলো দেশের সরকারের এমনসব পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে নিবৃত্ত থাকা উচিত, যে সব পদক্ষেপে কোনো না কোনোভাবে এই সংঘর্ষে তাদের জড়িয়ে ফেলবে এবং পরিস্থিতির অধিকতর অবনতি ঘটাবে।
৭ ডিসেম্বরে ওয়ারশতে পোলিশ ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসে প্রদত্ত ভাষণে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেঝনেভ জোর দিয়ে বলেছেন যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন দৃঢ়তার সঙ্গে রক্তপাত বন্ধের, বাইরের শক্তিগুলোর কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়া জনসাধারণের ন্যায়সঙ্গত অধিকারসমূহ যথোপযুক্ত বিবেচনার মধ্যে রেখে উদ্ভূত সমস্যাদির শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক মীমাংসার এবং সেই এলাকার স্থায়ী ও ন্যায্য শান্তির সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির দাবি করছে।
এপিএন, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!