ভারত উপমহাদেশে সংঘর্ষ ও মাওগোষ্ঠীর প্ররোচনামূলক ভূমিকা
জি ইয়াকুবোভ
ভারত উপমহাদেশে পক্ষকালব্যাপী সংঘর্ষ শেষ হয়েছে। এখন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বুঝতে চেষ্টা করছেন, কোনো গোপন উৎসমুখ থেকে এই রক্তপাত উৎসারিত হয়েছে এবং এর জন্য দায়ী কে।
সংঘর্ষ বাধার কারণ এই যে, পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা ডিসেম্বর ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সুস্পষ্টরূপে ব্যক্ত পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করেছিলেন এবং অলঙ্ঘনীয় গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য গণ-আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করেছিলেন অস্ত্রের সাহায্যে। ব্যাপক উৎপীড়নের ফলে ১০ লক্ষাধিক মানুষ নিহত হন এবং প্রায় ১ কোটি মানুষ পালিয়ে যান ভারতে। এসবই পাক-ভারত বিরোধের প্রচণ্ড অবনতি ঘটায়। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক তৎপরতা শুরু করে।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, পাকিস্তানের সামরিক শাসকরা এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের সাহস পেতেন না, যদি বাইরে থেকে প্ররোচনামূলক সমর্থন সম্পর্কে তাঁরা অবহিত না থাকতেন। আর এই সমর্থনটা ছিল বেশ বড় ধরনের।
ইসলামাবাদের কর্তৃপক্ষের অনুসৃত পীড়নের নীতিকে প্রকৃতপক্ষে উৎসাহ জুগিয়ে মার্কিন সরকার পূর্ব পাকিস্তানে একটা রাজনৈতিক মীমাংসার প্রয়োজনকে এবং শরণার্থী সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনকে উপেক্ষা করে। নিরাপত্তা পরিষদে এই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার সময়ে গৃহীত মার্কিন অবস্থানটি ছিল পূর্ববঙ্গের জনগণের বিরুদ্ধে এবং যেসব কারণে যুদ্ধ বেঁধেছে, তাকে দূর করতে তা সাহায্য করেনি। এই অবস্থান নানাভাবেই দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে।
১৭ ডিসেম্বরে প্রকাশিত, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে প্রেরিত বার্তায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ এড়ানো যেত, যদি সারা পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো, সর্বোপরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একমতে উপনীত হবার মতো এমন ব্যবস্থা ও এমন মূলনীতি প্রণয়ন করার জন্য তাদের প্রভাব বিস্তার করত, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থাকে যথাযথভাবে গণ্য করা হয়।
এই সংঘর্ষের জন্য অনেকখানি দায়িত্ব গিয়ে বর্তায় চীনা নেতাদের ওপর। তাঁরা জাতিতে জাতিতে বৈরিতার বীজ বপন করেন এবং যুদ্ধের উসকানিদাতার কাজ করেন।
নিজের একাধিপত্যমূলক দাবিগুলোকে একটু সম্ভ্রান্ত চেহারায় দেখাবার চেষ্টায় পিকিং জাতিসমূহের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার প্রতি সম্মানের কথা বলে এবং অপরাপর দেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে কথা বলে। ইতোমধ্যে, ভারত ও পাকিস্তান সম্পর্কে তার সমস্ত কার্যকলাপ থেকে দেখা যায় যে, এইসব শ্রুতিমধুর ঘোষণাগুলো কোনোমতেই পিকিংয়ের নেতাদের নীতির প্রকৃত উদ্দেশ্যকে প্রতিফলিত করে না।
১৯৫৯ সালে হিমালয়ের পার্বত্য এলাকায় চীন ও ভারতের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষের পর থেকেই চীনা নেতারা ভারতের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যভাবেই বৈরিতামূলক একটি পন্থা অনুসরণ করে আসছেন। তাঁরা সর্বপ্রকার চেষ্টা করছেন ভারতকে হেয় প্রতিপন্ন করতে, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনগণের চোখে এবং চেষ্টা করছেন তাকে বিচ্ছিন্ন করতে। এইভাবে, তথাকথিত তৃতীয় দুনিয়ায় তাঁদের পক্ষে একটি নেতৃস্থান গ্রহণ করার কাজকে তাঁরা সহজতর করে তুলতে চান। সেইসঙ্গে পিকিং চায় ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতি জটিল করতে এবং ভারতকে দুর্বল করতে।
এই কারণেই পিকিংয়ের নেতারা ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সংক্রান্ত প্রশ্নটির মীমাংসা বিলম্বিত করছেন এবং মাঝে মাঝে ভারতের সীমান্তে পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে, ১৯৬২ সালে ভারতের বিরুদ্ধে চীনা ফৌজের আক্রমণাত্মক তৎপরতা, সেপ্টেম্বর ১৯৬৫-তে ও সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ভারতের উদ্দেশ্যে পিকিংয়ের চরমপত্র ধরনের দাবিগুলোর কথা স্মরণ করা যাক।
ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মাওবাদীরা নির্লজ্জভাবে হস্তক্ষেপ করছেন। ভারতের স্বাধীন বিকাশের পথে অসুবিধা সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে তাঁরা প্রচণ্ড চেষ্টা করছেন। হঠকারী, চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে নৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে তাঁরা সেইসব বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোরই কর্মীবাহিনীকে বিভক্ত করেন, যারা বলিষ্ঠতর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সপক্ষে, ভারতে প্রগতিশীল সামাাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের সপক্ষে এগিয়ে আসে। এসবই করা হচ্ছে ভারতকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে এবং তার আন্তর্জাতিক মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করার উদ্দেশ্যে।
পিকিংয়ের প্রচার ভারতের পররাষ্ট্র নীতিকে ক্রমাগত আক্রমণ করে এই নীতি সম্পর্কে এশিয়ায় ও আফ্রিকায় অবিশ্বাস উদ্রেক করার চেষ্টায়। তিন-চার বছর আগে বার্মা, নেপাল ও সিংহলকে ভারতের বিরুদ্ধে সংগ্রামে টেনে আনার জন্য পিকিং তাদের ওপর চাপ দিয়েছিল। নেপাল ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে যেসব অসুবিধা দেখা দিয়েছিল, চীনা নেতারা তাতে সর্বপ্রকারে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন এবং চীনকে উপস্থিত করেছিলেন নেপালের রক্ষকরূপে। চীনের সমর্থন নিয়ে সম্প্রতি যেখানে একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী-বিদ্রোহী প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলন সক্রিয় হয়ে উঠেছিল, উত্তর বার্মার সেই জেলাগুলোকে তাঁরা ভারতের বিরুদ্ধে কাজে লাগাবেন বলে আশা করেছিলেন। পিকিংয়ের কূটনীতি সিংহলেও ভারতবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তোলার আশা রাখে। স্পষ্টতই পিকিংয়ের লক্ষ্য হলো ভারতকে এমন সব রাষ্ট্র দিয়ে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করা এবং ঘিরে ফেলা, যারা ভারতের প্রতি বৈরিভাবাপন্ন হবে; এবং এইভাবে ভারতকে বিচ্ছিন্ন করা।
বার্মা, নেপাল ও সিংহল যেহেতু দৃঢ়ভাবে তাদের স্বাধীনতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে এবং পিকিংয়ের ভারতবিরোধী নীতির হাতিয়ার হতে যেহেতু তারা ইচ্ছুক নয়, সেহেতু পিকিংয়ের সমরনীতিবিশারদরা ভারতের বিরুদ্ধে তাঁদের সংগ্রামে ইয়াহিয়া খাঁর হুকুমতের ওপরই সবেচেয়ে বড় আশা-ভরসা রেখেছিলেন।
চীনা নেতারা, পাক-ভারত বিরোধের নিষ্পত্তিতে সাহায্য করা তো দূরের কথা, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণে সর্বপ্রকার ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন, তাঁদের ভূ-রাজনৈতিক রণনীতির জালের মধ্যে পাকিস্তানকে টেনে আনার আশায় পাকিস্তানকে ভারতবিরোধী কার্যকলাপে প্ররোচিত করেছেন।
১৯৬৬ সালের তাসখন্দ ঘোষণা ১৯৬৫-তে পাক- ভারত সশস্ত্র সংঘর্ষের অবসান ঘটিয়ে ভারত উপমহাদেশে পরিস্থিতির স্বাভাবিকীকরণের পথ প্রশস্ত করেছিল। পিকিং এই তাসখন্দ ঘোষণাকে আক্রমণ করল। সোভিয়েত সরকারের নেতার সহায়তার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট কর্তৃক রচিত তাসখন্দ ঘোষণাকে চীনা প্রচার অভিহিত করল ‘পাকিস্তানের স্বার্থের বিনিময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মধ্যে যোগসাজসের’ একটি ফল ছাড়া আর কিছু নয় বলে।
তথাকথিত কাশ্মীর প্রশ্নেও পিকিংয়ের নেতারা সর্বপ্রকার ইন্ধন জোগান এবং পাকিস্তানি জেনারেলদের সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন। জুলাই ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানি এয়ার মার্শাল নূর খাঁর পিকিং সফরের সময়ে চীনা পক্ষের সঙ্গে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। ফেব্রুয়ারি ১৯৭০-এ কুয়ো মো-জো তাঁর পাকিস্তান সফরকালে অনুরূপ একটি বিবৃতি দেন। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁ পিকিং সফর করেন নভেম্বর ১৯৭০-এ। সেই সময়েও তাঁকে একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
এ কাজটি করার সময়ে মাওবাদীরা তাঁদের স্বভাবসিদ্ধ ভণ্ডামি দিয়ে একথাটি গোপন রেখেছিলেন যে, বেশ কয়েকবছর ধরে তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে তাঁদের সমর্থন গোষ্ঠীগুলোকে একত্রে জড়ো করার জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন; উদ্দেশ্য ছিল, পিকিংয়ের সংকীর্ণ স্বার্থের খাতিরে দরকার হলে তাদের কাজে লাগানো।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনের পর পাকিস্তানের পরিস্থিতির যখন আরো অবনতি ঘটল এবং পূর্ববঙ্গের জনসাধারণের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি ফৌজ যখন ব্যাপক অত্যাচার চালাতে শুরু করল, তখন এইসব কার্যকলাপকে পিকিং নিজের পক্ষপুটে আড়াল করলো। চীনের নেতারা স্থির করলেন যে, দক্ষিণ এশিয়ায় তাঁদের অবস্থানগুলোকে শক্তিশালী করার চেষ্টা চালাবার সময় হয়েছে। এই লক্ষ্য সামনে রেখেই পিকিং পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের নতুন নতুন হঠকারিতার দিকে ঠেলে দিতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন অত্যাচারের অবসান ঘটাবার আহ্বান দিয়েছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে সমস্যার এক সমাধানের জন্য আহ্বান জানিয়েছিল। সেই সোভিয়েত ইউনিয়নের নামে মাওবাদীরা কলঙ্ক লেপন করেন। ভারত পূর্ব পাকিস্তানে এক রাজনৈতিক মীমাংসা দাবি করেছিল এবং চেয়েছিল যে এমন একটা অবস্থা সৃষ্টি করা হোক, যাতে শরণার্থীরা স্বগৃহে ফিরে যেতে পারেন। সেই ভারতের নামে তাঁরা কুৎসা রটনা করেন। ইয়াহিয়া খাঁর কাছে ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল প্রেরিত বার্তায় চীনা লোকায়ত্ত প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন যে, ভারত সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে।
সেইসঙ্গে চীন পাকিস্তানকে প্রদত্ত সাহায্য বাড়িয়ে দেয়, স্পষ্টতই সেই দেশটিকে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। গত মে মাসের গোড়ার দিকে একটি পাকিস্তানি সামরিক প্রতিনিধিদল চীন সফর করে। জুন মাসে চীন দুটি পাকিস্তানি ডিভিশনের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করে পূর্ব পাকিস্তানে তৎপরতা চালাবার উদ্দেশ্যে। ১০ সেপ্টেম্বর চীনা সাহায্য ও চীনা ঋণ দিয়ে নির্মিত একটি অস্ত্র কারখানা তুলে দেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তানি সামরিক জেলার কমান্ডারের হাতে। নভেম্বরের গোড়ার দিকে একটি পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলকে পিকিংয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর মধ্যে ছিলেন পাকিস্তানের বিমান বহরের কমান্ডার, চীফ অব দি জেনারেল স্টাফ ও নৌ-বাহিনীর প্রধান। পাকিস্তানি সংবাদপত্র ‘পাকিস্তান টাইমস লিখেছিল, তারপর পাকিস্তানকে পিকিং ৪০০টি জঙ্গী ও বোমারু বিমান, ট্যাঙ্ক ও বিমান-বিধ্বংসী ব্যবস্থা সরবরাহ করতে শুরু করল।
আরো একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা এই বিষয়টির প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন যে, ভারতের সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধারম্ভ সম্পর্কে পাকিস্তানের ১০ দিনের নোটিশটি পাকিস্তানে চীনের যন্ত্রনির্মাণ শিল্পমন্ত্রী লি শুই- চিংয়ের নেতৃত্বে এক চীনা প্রতিনিধিদলের অবস্থানকালের সঙ্গে মিলে যায়। নোটিশে বর্ণিত মেয়াদ শেষ হয় ডিসেম্বর এবং সেইদিনই পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ভারতীয় বিমানক্ষেত্রগুলোর ওপর বোমাবর্ষণ করে।
চীনা নেতাদের এই সমস্ত কাজ, তৎসহ ওয়াশিংটনের পাকিস্তান-ঘেঁষা পন্থা ভারত উপমহাদেশে সামরিক সংঘর্ষ বাধিয়ে দিতে সাহায্য করেছে।
বিরোধের সময়েই, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো যখন বৈরিতার অবসান ঘটানোর জন্য এবং রাজনৈতিক মীমাংসার নিশ্চয়তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিচ্ছিলেন, তখন চীনা প্রতিনিধিরা সর্বপ্রকারে চেষ্টা করেছেন যাতে নিরাপত্তা পরিষদ উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারে।
এই কাজটি করতে গিয়ে মাওবাদীরা মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিস্ময়কর ঐক্যমত্য প্রদর্শন করেছেন। ভারতের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের চাপ দেওয়ার সময়টাও নজরে না পড়ে পারে না। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পেন্টাগন যখন বঙ্গোপসাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠা, তখন পিকিংও এগিয়ে এলো ভারতের উদ্দেশ্যে হুমকি নিয়ে, অভিযোগ করল ভারত নাকি হিমালয় অঞ্চলে সীমান্ত লঙ্ঘন করেছে।
পাকিস্তানি জঙ্গীশাহীর সমর্থনে চীন-মার্কিন জোট সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট বলেছে যে, চীনারা পাকিস্তানকে মদত দেয় রাজনৈতিকভাবে এবং অস্ত্র দিয়ে। নিক্সন প্রশাসনের পাকিস্তান-ঘেঁষা নীতি এই পরিস্থিতিতে প্রকৃতপক্ষে চীনকে পরিণত করেছে এক মিত্রতে। পত্রিকাটি বলেছে: “তাই চীনারা, ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের এইসব প্রবক্তারা পূর্ববঙ্গের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ইয়াহিয়া খাঁর জঙ্গীশাহীর রক্ষকে পরিণত হয়েছে।”
মাও সে তুঙের কর্মনীতির নীতিহীনতা ও হঠকারিতা ভারত-পাক সংঘর্ষের সময় আরো একবার প্রকট হয়েছে। এই সংঘর্ষ দেখিয়েছে যে, মাওবাদীরা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ‘মিত্র’, এমনকি ‘নেতারা’ ভান করলেও এই আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেন, যদি তাঁরা দেখেন যে তাঁদের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী স্বার্থসিদ্ধির জন্য প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে একটা সমঝোতা দরকার। এই সংঘর্ষ এটাও দেখিয়েছে যে, পিকিংয়ের নেতারা অনুসরণ করছেন এক বৃহৎ শক্তিসুলভ সামাজিক জাত্যাভিমানী কর্মপন্থা, যেটা প্রায়শই তাঁদের এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে একসঙ্গে মেলায়। সবশেষে সংঘর্ষের সময়ে চীনা নেতাদের আচরণ দেখিয়েছে যে, সোভিয়েতবিরোধী উন্মত্ততা জাগিয়ে তোলার জন্য তাঁরা প্রত্যেকটি সুযোগকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করছেন।
ভারত-পাক সংঘর্ষ পিকিংয়ের নেতৃত্বের পররাষ্ট্র নীতিগত পন্থাটির প্ররোচনামূলক চরিত্রকে স্পষ্ট করে তুলেছে; এই পন্থার লক্ষ্য হলো উত্তেজনার উর্বর ক্ষেত্র সৃষ্টি ও তাকে বাড়িয়ে তোলা। যুদ্ধের আগ্নেয়াস্ত্রগুলো যখন গর্জন করছিল, পিকিং তখন অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়েছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বৈরিতার উসকানি দিয়েছে। সেইসঙ্গে, এইভাবে প্রজ্জ্বলিত আগুনের আঁচে হাত গরম করার সঙ্গে সঙ্গে পিকিংয়ের নেতারা এবং তাঁদের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শরিকরা ‘শান্তিবিধায়কের’ ভঙ্গী করেছেন, কপটতাপূর্ণভাবে যুদ্ধবিরতি দাবি করেছেন। এখন যখন যুদ্ধ থেমেছে, তখন পিকিং থেকে প্রত্যহ প্ররোচনামূলক আহ্বান আসছে, পাকিস্তানি নেতাদের ‘বিজয়পূর্ণ পরিসমাপ্তি পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য’ আহ্বান জানানো হচ্ছে।
চীনা নেতৃত্বের পররাষ্ট্র নীতিগত পন্থা সারা পৃথিবীতে ধিকৃত। সিংহলী সাপ্তাহিক পত্র ‘ফরোয়ার্ড’ লিখেছে যে, সেদিন পর্যন্তও যাঁরা একথা মেনে নিতে রাজি হননি যে, চীনা নেতারা একটা বৃহৎ শক্তিসুলভ উগ্র জাত্যভিমানের নীতি অনুসরণ করছে, তাঁদের কাছে চীনের এই অবস্থান প্রচণ্ড আঘাতের মতো মনে হয়েছে।
বৈরুতের সংবাদপত্র ‘আল-শাব’ বলেছে যে, ‘ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সংঘর্ষের ব্যাপারে সোভিয়েত অবস্থানকে বিকৃত করা ও তার কুৎসা রটনার উদ্দেশ্যচালিত নীতি নিয়ে পিকিংয়ের নেতারা পরিণত হয়েছেন সাম্রাজ্যবাদী মতলব হাসিলের সহচরে।’
তীব্র আন্তর্জাতিক সংঘাতের সময়ে প্রগতি ও প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলোর অবস্থানের মধ্যকার সীমারেখাটি বিশেষ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ভারত উপমহাদেশের ঘটনাবলি এ জিনিসটি আরো একবার নিশ্চিতরূপে প্রদর্শন করেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও জাতীয় মুক্তির শক্তিগুলোর সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। আর প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে সমর্থন করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা পিকিংয়ের নেতারা।
প্রাভদা, ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা