পিকিংয়ের উসকানিদাতারা
ডি ভোস্কি
পূর্ব বাংলার অবস্থা যখন স্বাভাবিক হয়ে আসছে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে সমস্যাদি সমাধানের অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে, তখন একটি ঘটনা ক্রমেই স্পষ্টতর হয়ে উঠছে—চীনা নেতৃত্ব মরিয়া হয়ে এই প্রক্রিয়াকে বাধা দেবার চেষ্টা করছে। স্পষ্টতই পিকিং নিভে আসা সংঘর্ষকে আবার তাতিয়ে দেবার ওপর বাজির দান রেখেছে।
যেদিন সামরিক তৎপরতা বন্ধ হলো, সেদিনই পিকিংয়ে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই ঘোষণা করেন যে, ‘ঢাকার পতনের পরিণতি হবে দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশে সীমাহীন সংঘাত।’ পিকিংয়ের পরবর্তী কাজকর্ম ও প্রচার দেখিয়ে দিচ্ছে, চৌ-এন-লাইয়ের বিবৃতিটি ছিল সংশ্লিষ্ট চীনা মহলগুলোর প্রতি নির্দেশস্বরূপ।
বাস্তবক্ষেত্রে কিন্তু চীনা জনগণকে জানানোও হয়নি যে, যুদ্ধ শেষ হয়েছে। ২৭ ডিসেম্বর জেনমিন জিপাও-এ লেখা হয়েছিল কিছু কিছু ‘জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের কথা, যারা দাবি করেছিল ভারত ও পাকিস্তান অস্ত্র সংবরণ করুক’ যেন ১৬ ডিসেম্বরই ভারত সরকার এরূপ উদ্যোগ দেখায়নি, যেন পাকিস্তান এই উদ্যোগে সাড়া দেয়নি।
এই অদ্ভুত বিস্মরণশীলতা আদৌ বিস্ময়কর নয়। পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সন্ত্রাস ওদের নজরে পড়েনি, কিন্তু হঠাৎ ওরা দেখতে পেল ‘আগ্রাসী ভারতীয় ফৌজ’ ও ‘পূর্ব পাকিস্তানি বিদ্রোহীরা নিরীহ পাকিস্তানি জনগণের’ বিরুদ্ধে ‘বর্বরোচিত দমনপীড়ন নিষ্ঠুর নির্যাতন’ চালাচ্ছে। ২৬ ডিসেম্বর পিকিংয়ে এক বক্তৃতায় চীনা উপ-প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন-নিয়েন ঠিক এই শব্দসমষ্টিই ব্যবহার করেছেন। পূর্ববাংলায় ‘ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের’ কাল্পনিক ‘অপরাধসমূহের’ নিন্দা করার সময় পত্রিকাগুলো ও সিনহুয়া এজেন্সি আরও কড়া ভাষা ব্যবহার করেছে। একথা সত্যি, এই অপবাদের সমর্থনে কোনো তথ্য উদ্ধৃত করা হয়নি। কারণটা পরিষ্কার, কেননা তথ্য সম্পূর্ণ উল্টো, এমনকি ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের ও বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল নয় সেইসব পশ্চিমী সাংবাদিকরাও ভারতীয় সৈন্যদের উচ্চমাত্রার নিয়মানুবর্তিতার, পূর্ব বাংলার জনসাধারণের সঙ্গে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা স্বীকার করেন। অন্যরকম হলে কি শরণার্থীরা কোনোদিন স্বদেশ ফেরার কথা চিন্তা করতে পারত? একই সময়ে ভারত সরকার বারবার ঘোষণা করেছেন যে, পাকিস্তানের ব্যাপারে তাদের কোনো ভূখণ্ডগত দাবি নেই এবং প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দিন বাংলাদেশে তাঁদের সৈন্য রাখার অভিপ্রায় নেই। প্রায় এক লক্ষ পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীর সঙ্গে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মানবিক আচরণের মান অনুসারে এবং জেনেভা কনভেনশনের বিধান অনুসারে আচরণ করছেন।
শত্রুতার উসকানি
চীনা নেতাদের কিন্তু মাথায় আছে মাত্র একটি জিনিস, অর্থাৎ অবিশ্বাসের বীজ বপন করা এবং শত্রুতা উসকে দেওয়া। সিনহুয়া এজেন্সি ভারতকে ‘অর্থনৈতিক দিক থেকে পূর্ববঙ্গকে লুণ্ঠন করার অভিযোগে ‘অভিযুক্ত’ করার চেষ্টার কথাই ধরা যাক। পূর্ববঙ্গের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য পাট মাসের পর মাস গুদামে পড়ে ছিল; এই পাট ক্রয়ে ভারতের সম্পূর্ণ মানবিক করুণাপ্রসূত সিদ্ধান্তের এই ব্যাখ্যা করেছে সিনহুয়া। নিচের তথ্যটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এই একই সিনহুয়া এজেন্সি ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত পত্র-পত্রিকার বিরুদ্ধে এই বলে আক্রমণ চালায় যে, এরা নাকি সর্বশক্তি দিয়ে প্রচার করছে পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে।
পিকিংয়ের রাজনীতিবিদরা কি এভাবেই তাদের মতলব নিজেরাই ফাঁস করে দিচ্ছেন না?
হিন্দুস্থান উপদ্বীপ সম্পর্কে চীনের বর্তমান কর্মনীতির এটি অন্যতম প্রবণতা। তাছাড়া যে পাকিস্তানি মহলগুলো সামরিক প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবছে, পিকিং তাদের উৎসাহ জোগাচ্ছে। এটি শুধু ইসলামাবাদের রাজনীতিবিদদের অহঙ্কার বা ধর্মীয় অনুভূতিতে সুড়সুড়ি দেবার ব্যাপার নয়। এসোসিয়েটেড প্রেস জানিয়েছে, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে চীনারা বিমান যোগে বেশ কিছু ট্যাঙ্ক, বিমানধ্বংসী কামান ও অন্যান্য অস্ত্র পেশোয়ারে নিয়ে এসেছিল। স্পষ্টতই, সিনহুয়া এজেন্সি যে বিরামবিহীনভাবে পূর্ব বাংলায় ফৌজ প্রেরণে ইসলামাবাদের অধিকারের, ‘কাশ্মীর প্রশ্নটিকে স্বীকার না করার’ ভারতীয় অভিপ্রায়ের পেছনকার তথাকথিত ‘বিদ্বেষমূলক অভিসন্ধির’ কথা বলে চলেছে, তা অকারণ নয়।
এই অবস্থায়, ভারত ‘নিজেরই রোপিত বিষবৃক্ষের ফল কুড়াবে’ এই মর্মে পিকিং নেতৃত্বের পুনঃপুন হুমকির অর্থ সম্পূর্ণ পরিষ্কার হয়ে ওঠে। পিকিং স্পষ্টতই ভারতের অভ্যন্তরীণ জাতিগত ও ধর্মগত পার্থক্যগুলো নিয়ে ফাটকা খেলতে, সেখানে চরমপন্থী অংশগুলোর অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতাকে উৎসাহ জোগাতে চাইছে। এসবই করা হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নের ও সোভিয়েত-ভারত সহযোগিতার বিরুদ্ধে বিকারগ্রস্ত প্রচার অভিযানের সহযোগে। পিকিং এই সহযোগিতাকে তার বৃহৎ-হান মতলবগুলো রূপায়ণের পথে বাধা বলে মনে করে।
এই পথ পিকিংয়ের কর্মনীতির শক্তি নয়, দুর্বলতাকেই দেখিয়ে দিচ্ছে, তুলে ধরছে ব্যর্থতাগুলো পুষিয়ে নিতে তার কামনাকে। ভারতীয় উপমহাদেশে ঘটনা-বিকাশ চীনের বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির ওপর এক উল্লেখযোগ্য আঘাত হেনেছে এবং পিকিং এখন পাল্টা আক্রমণ করার চেষ্টা করছে। এই পাল্টা আক্রমণের ভিত্তি হলো মার্কিন প্রসাশনের তথাকথিত গুয়াম মতবাদের মতোই ‘এশিয়াবাসীর বিরুদ্ধে এশিয়াবাসীকে লাগিয়ে দেবার একই মূলনীতি। তাহলে কি আর বিশেষভাবে বলে দেবার দরকার আছে যে, চীনাদের বর্তমান রণনীতি ভারতীয় উপমহাদেশের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার পুরোপুরি পরিপন্থী?
এপিএন, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২
সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা