ভারত-পাক সামরিক সংঘর্ষের শিক্ষা
ভিয়াতোস্লাভ কোজলোভ
(এপিএন’র সামরিক ভাষ্যকার)
ভারতের সঙ্গে দু-সপ্তাহের সামরিক সংঘর্ষে পাকিস্তান বড় রকমের ঘা খেয়েছে। সে হারিয়েছে তার বিমান বাহিনীর এক-তৃতীয়াংশ এবং তার মোট ট্যাঙ্কের এক-পঞ্চমাংশ সে খুইয়েছে, সেইসঙ্গে ধ্বংস হয়েছে অনেকগুলো যুদ্ধজাহাজ৷ এ ছাড়া পূর্ববঙ্গে ইসলামাবাদের যত ফৌজ ছিল, সেটা ছিল গোটা দেশের সমস্ত স্থলবাহিনীর প্রায় এক-পঞ্চমাংশ, এদের আত্মসমপর্ণ করতে হয়েছে।
পরাজয়ের কারণগুলো ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করে পশ্চিম পাকিস্তান দাবি করছে যে, এই পরাজয় শত্রুর শক্তি বেশি বলে হয়নি, হয়েছে প্রধানত পাকিস্তানি সর্বোচ্চ সামরিক নেতৃত্বের তরফে অনুপযুক্ততার দরুন। এই ব্যাখ্যার সঙ্গে সঙ্গে চলছে অপরাধীদের শাস্তি দেবার এবং বিজয়ীদের ওপরে প্রতিশোধ গ্রহণের আহ্বান। এইভাবে দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধের জঙ্গী ধারণায় লালিত পাকিস্তানি জনগণের মধ্যে ঘৃণা ও প্রতিশোধস্পৃহার বীজ আবার বপন করা হচ্ছে।
এখানে অবশ্য ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ীগত উপাদানগুলোর প্রভাবকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা উচিত হবে না। কিন্তু সেইসঙ্গে একথাও মনে রাখা দরকার যে, বিষয়ীগত উপাদানগুলো কখনোই একটা চূড়ান্ত ভূমিকা পালন করে না। জেনারেলদের রণনীতিগত ক্ষমতা-দক্ষতার মাত্রার চেয়ে আরো বেশি গুরুতর উপাদান চিরদিনই প্রধান গুরুত্বসম্পন্ন।
সামরিক দিক থেকে বলতে গেলে, পাকিস্তানের চেয়ে সামরিক ক্ষমতায় অধিকতর শক্তিশালী ভারত ইচ্ছা করেই তার সমস্ত সুযোগ-সুবিধাগুলোর সদ্ব্যবহার করেনি। ঘটনা থেকেই দেখা যায়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সক্রিয় সামরিক তৎপরতার লক্ষ্য ছিল পূর্ববঙ্গের জনগণকে সাহায্য করা, যাদের কষ্টভোগ ভারতের পক্ষেও এক অসহনীয় পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। সেইসঙ্গে ভারত চেষ্টা করেছিল তার তৎপরতাকে পশ্চিম রণাঙ্গনে সীমাবদ্ধ রাখতে সেখানে উদ্দেশ্য ছিল শত্রুকে ঠেকিয়ে রাখা।
এই সংঘর্ষের উসকানিদাতা-পাকিস্তান কমান্ড—কোনো কোনো রণক্ষেত্রে অধিকতর শক্তিশালী ফৌজ কেন্দ্ৰীভূত করেছিল এবং কোনো কোনো জায়গায় উদ্যোগও গ্রহণ করেছিল। কিন্তু পশ্চিম রণাঙ্গনের একটি কি দুটি ক্ষেত্রে রণকৌশলগত সাফল্য ছাড়া পাকিস্তানি ফৌজ তাদের আক্রমণের লক্ষ্য সিদ্ধিতে ব্যর্থ হয়েছিল।
পাকিস্তানি কমান্ডের রণনীতিগত যোগ্যতার অভাব সংক্রান্ত কথাটি যদি সত্যি হয়ও, তবুও কিন্তু তা দিয়ে এই ব্যর্থতার ব্যাখ্যা করা যায় না। পাকিস্তানি সামরিক হুকুমতের বিপর্যয়ের কারণ আরো গভীর।
একটি গুরুতর সামরিক সংঘর্ষ থেকে একটি নির্দিষ্ট দেশের সামরিক কাঠামোর মতাদর্শগত ও তত্ত্বগত বুনিয়াদ এবং বাস্তব পরিচালননীতি অর্থাৎ তার সামরিক নীতি পরীক্ষার এবং তার মূল্যায়নের সুযোগ পাওয়া যায়। এই সামরিক নীতিকে সেই সময়ে রাখা হয় রাষ্ট্রের কর্মনীতির কাজে এবং তা এই কর্মনীতির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাকিস্তান নিয়মিত সামরিক সাহায্য পেয়েছে; ওয়াশিংটনের ছত্রছায়ায় ও অংশগ্রহণে গঠিত আগ্রাসী সামরিক জোটেও সে ভিড়েছে। পাকিস্তান তার সামরিক শক্তি গড়ে তোলার কাজে কুখ্যাত ‘গুয়াম তত্ত্বের’ প্রতিবিম্বস্বরূপ পেন্টাগনি তত্ত্বই অনুসরণ করেছে। এই তত্ত্বের লক্ষ্য হলো এশিয়াবাসীকে এশিয়াবাসীর বিরুদ্ধে প্রবৃত্ত করা।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পিকিংয়ের দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিল। পিকিং ‘গুয়াম তত্ত্ব-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় জাতিগুলোর মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করেছিল।
এই বিদ্বেষপূর্ণ তত্ত্বটি কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এ নীতি ব্যবহারের ফলে ঘটল গুরুতর পরাজয়, ঠিক যেমনটি হয়েছে ইন্দোচীনে। দু ক্ষেত্রেই কারণগুলো একই। ইন্দোচীনে মার্কির-সায়গনী ফৌজের মতো পাকিস্তানি ফৌজও তাদের ওপর চাপানো কসাইয়ের ভূমিকার ফলে প্রচণ্ড দুর্নীতিগ্রস্ত ও নৈতিক দিক দিয়ে অধঃপতিত ছিল। তার লড়াইয়ের ‘ধর্মীয় ও জাতীয়’ উদ্দেশ্যগুলো ছিল প্রকৃতপক্ষে একটা অলীক উদ্ভাবন। স্বভাবতই তা সৈন্যদের উচ্চ মনোবল ও সমর-দক্ষতা যোগাতে পারেনি।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ছিলেন পূর্ববঙ্গের জনগণের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিবৃন্দ, যাঁরা লড়াই করেছিলেন নিপীড়নের বিরুদ্ধে, গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য। এঁদের সাহায্য করার লড়াইয়ের ন্যায্য আদর্শ ও উদ্দেশ্য ভারতীয় সৈনিকদেরও অনুপ্রাণিত করেছিল। অতএব, শত্রুর অপেক্ষা তাদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব ছিল তর্কাতীত।
ন্যায়সঙ্গত এক যুদ্ধে জনসাধারণের দিক থেকে যুদ্ধের লক্ষ্য ও কারণ সম্পর্কে সুস্পষ্ট বোধ প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সেটাই জয়লাভকে নিশ্চিত করে—এই মর্মে লেনিন ইতিহাসের যে অমোঘ নিয়মটিকে সূত্রায়িত করেছিলেন, এইভাবে তা আরো একবার সুপ্রমাণিত হলো।
এই সবকিছু থেকেই আধুনিককালের অজেয় প্রক্রিয়া—সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মুক্তি আন্দোলন— ঠেকানোর জন্য বিশ্বের প্রতিক্রিয়ার শক্তির প্রচেষ্টার অন্তঃসারশূন্যতা দেখা যায়। সামরিক উপায়সহ কোনো উপায়ই এই অপ্রতিরোধ্য ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে না। এই উপায় গ্রহণ করতে পারে একমাত্র তারাই, যারা প্ৰগতিকে ঘৃণা করে, যাদের সর্বনাশ অবধারিত এবং যারা অন্ধভাবে সেই অনিবার্য ঘটনাকে বিলম্বিত করার জন্য বলপ্রয়োগকেই আঁকড়ে থাকে।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র মন্ত্রীদপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “হিন্দুস্তানে যুদ্ধের অবসান এই অঞ্চলে জনগণের মৌল স্বার্থের অনুকূল, জাতীয় বিকাশ ও প্রগতির পথ ধরে তাঁদের অগ্রযাত্রার প্রয়োজনীয় অবস্থা সৃষ্টি করে এবং পৃথিবীতে গুরুতর উত্তেজনার একটি ক্ষেত্রকে অপসারিত করে।’
সমস্ত শান্তিকামী দেশেরই কাজ হলো, ভারত উপমহাদেশে বসবাসকারী জনগণের বিধিসম্মত অধিকারকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে, সেখানে যথাশীঘ্র সম্ভব শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বপ্রকারে সাহায্য করা।
এপিএন, ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা