কপটতা
ভি কুদ্রিয়াসেভ
এখন যখন ভারতীয় উপমহাদেশে সামরিক তৎপরতা বন্ধ হয়েছে, তখন এই এলাকায় পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক করার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। এই সমস্যাটি বিবেচনা করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে একটি প্রস্তাব পাশ করেছে। এই প্রস্তাবে ভারতীয় উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি আদায় করার মুখ্য প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং এতৎসম্পর্কিত কিছু কিছু ব্যবস্থার রূপরেখা দেওয়া হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড এই প্রস্তাবের ওপর ভোটদানে বিরত ছিল। সোভিয়েত প্রতিনিধি বলেছিলেন, যদিও প্রস্তাবটিতে এমনকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে, যেগুলো এই উপমহাদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার সহায়ক, তাহলেও প্রস্তাবটি একথা বলে দিতে পারেনি যে, পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত’ প্রতিনিধিরাই’ এখানকার ভবিষ্যৎ স্থির করতে পারেন। প্রস্তাবে সম্মত হলেও ভারত কিন্তু এই আপত্তি রেখেছে যে, এই বিষয়টির অনুপস্থিতি প্রস্তাবটির দুর্বল স্থান।
সোভিয়েত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে, রক্তপাত বন্ধ করতে এবং জাতিগুলোর ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে যথোপযুক্ত বিবেচনার মধ্যে রেখে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যথাসাধ্য করেছে। নিরাপত্তা পরিষদে সমস্যাটি যে এত দীর্ঘ সময় ধরে আলোচিত হয়েছে। এই ঘটনাটির এবং তৎকর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবের ত্রুটিবিচ্যুতির জন্য দায়ী আমেরিকার এবং লোকায়ত্ত চীনের প্রতিনিধিরা। এঁরা মিলেমিশে কাজ করেছেন এবং জাতিসমূহের ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে স্বীকার করতে অনিচ্ছুক থেকেছেন। তাঁরা চেষ্টা করেছেন বিশ্ব জনমতের সামনে নিজেদের শান্তি প্রতিষ্ঠাতা’ হিসেবে জাহির করার উদ্দেশ্যে এবং একই সময়ে এশিয়ায় প্রভুত্বকামী লক্ষ্য অর্জনের সংকীর্ণ আত্মস্বার্থে সোভিয়েত ইউনিয়নের শান্তিকামী নীতিকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে নিরাপত্তা পরিষদের আলোচনা কাজে লাগাতে। যাহোক, আমেরিকা ও লোকায়ত্ত চীনের ‘শান্তি স্থাপনের প্রথম ধারণাটি খুবই ধোঁকা সৃষ্টি করে। আমেরিকার শান্তিকামিতা আগ্রাসী মোড়কে বাঁধা।
মূল কারণ
প্রথমত, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদ উভয় স্থানেই আমেরিকা মরিয়া হয়ে বিরোধিতা করেছে এমন একটি প্রস্তাব গ্রহণের, যে প্রস্তাবের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে সশস্ত্র সংঘর্ষের কারণগুলো দূর করবে। সবাই জানে যে, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকারগুলো এবং ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের পার্লামেন্টারি নির্বাচনে অভিব্যক্ত ইচ্ছাকে নির্মমভাবে দমন করায় এই বিরোধের উদ্ভব ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও ইচ্ছাকে যথোপযুক্ত বিবেচনার মধ্যে রেখে রাজনৈতিক মীমাংসা ছাড়া অন্যকিছুই এই কারণ দূর করতে পারে না। কিন্তু মার্কিন শাসক মহল ঠিক এটিই এড়াবার চেষ্টা করছে, কারণ তারা ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তিতে আগ্রহী নয়, পরন্তু ‘গুয়াম মতবাদের’ সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এশিয়ায় তাদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী।
এশিয়া মহাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে তার ‘শান্তি স্থাপন’ সবাইকে ‘আগ্রাসনকারী’ আখ্যা দেবার মার্কিন নেতাদের আচরণের মতোই চূড়ান্ত কপটতার শামিল। ইতিহাসের সমস্ত গতিপথ দেখিয়ে দিয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই সর্বাপেক্ষা আগ্রাসনকারী শক্তি। মার্কিন শাসক মহল বহু বছর ধরে ভিয়েতনামে আগ্রাসী যুদ্ধ চালাচ্ছে। এই যুদ্ধ লাওসে ও কম্বোডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে। আমেরিকার আগ্রাসনকারীরা নৃশংস বর্বরতার পরিচয় দিয়েছে, বেসামরিক জনসাধারণের ওপর ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে, নাপাম ও অন্যান্য বোমা ব্যবহার করেছে, রাসায়নিক পদার্থের সাহায্যে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বনাঞ্চলের এক-সপ্তমাংশ বিনষ্ট করে দিয়েছে।
মার্কিন প্রশাসন এখন বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে এই বলে যে, সে ইন্দোচীনে সশস্ত্র আগ্রাসন ‘হ্রাস করেছে”. এমনকি এটাকে আমেরিকার ‘শান্তিকামিতা’র প্রকাশ বলে চালাতে চাইছে। যাহোক, এসবেরই লক্ষ্য হলো আগ্রাসনে বিচলিত আমেরিকান ও বিশ্ব জনমতকে শান্ত করা। আংশিক ফৌজ অপসারণ আগ্রাসনের অবসান বোঝায় না। যুদ্ধের ভিয়েতনামীকরণের পথ নেওয়া হয়েছে। এটির অর্থ আগ্রাসন চালিয়ে যাওয়ার প্রধান বোঝা সায়গনের পুতুল সেনাবাহিনীর ঘাড়ে চালান করে দেওয়া। অবশ্য ওদের পেছনে থাকবে আমেরিকান সামরিক অস্ত্রশস্ত্রের গোটা শক্তি।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, মার্কিন শাসক মহল, চরম নৃশংসতা সহকারে ইন্দোচীনের জনসাধারণের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। আর এরপরেও এরা ভারত-পাক সংঘর্ষে নিজেদের ‘শান্তি স্থাপনকারী’ হিসেবে চিত্রিত করার স্পর্ধা দেখায়।
সৎ মধ্যস্থ
মার্কিন পত্র-পত্রিকার একাংশের মত হলো, ভারতীয় উপমহাদেশে আমেরিকাকে ‘সৎ মধ্যস্থের’ ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সময়ে এই মতের ধারকরা মধ্যপ্রাচ্যের উল্লেখ করছে, যেখানে তাদের মতে আমেরিকা ইতোমধ্যেই এরূপ ‘মধ্যস্থের’ ভূমিকা পালন করছে, মীমাংসা সম্পর্কে দুটি বিরুদ্ধপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে।
সকলেই বেশ ভালোভাবে জানেন, এই ‘সৎ মধ্যস্থতা’ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলি আগ্রাসনকারীকে সমর্থন করছে, আগ্রাসন চালিয়ে যেতে তাকে উৎসাহ জোগাচ্ছে, তাকে মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র, বিশেষ করে ফ্যান্টম ও স্কাইহক জাতের জঙ্গি বিমান সরবরাহ করছে। তথাকথিত রজার্স- উদ্যোগের কথা সকলেরই মনে আছে। সুয়েজ খাল দিয়ে জাহাজ চলাচল ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার ন্যায় ‘অন্তবর্তী’ সমাধান ছাড়া এই উদ্যোগ আর কিছুই নয়। এর ফলে এই জাহাজ চলাচলকে ইসরাইলের স্বার্থের অনুকূলে স্থায়ী করা যাবে। আর আগ্রাসনকারীকে উৎসাহিত করার এই ভূমিকাকে আমেরিকার কিছু কিছু লোক ‘সৎ মধ্যস্থের’ ভূমিকা বলে অভিহিত করার স্পর্ধা রাখে। আমেরিকা হয়তো ভারতীয় উপমহাদেশে এই একই ভূমিকার পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা করছে।
সংবাদে প্রকাশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রবর্তন করেছে, তাকে প্রতিশ্রুত ঋণ দানে অস্বীকৃত হয়েছে। এই পদক্ষেপের সাফাই গাইতে গিয়ে আমেরিকান প্রতিনিধিরা বলেছে, তারা দীর্ঘকাল আগে পাকিস্তানে সামরিক সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এই হালে আমেরিকান প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন পাকিস্তানকে সামরিক সরবরাহ বন্ধ করার ব্যাপার ‘কিছুটা বিলম্বিত’ করা হয়েছে, যাতে করে পিকিং কৰ্তৃপক্ষ বিরক্ত না হয়। প্রকাশ পেয়েছে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী কিসিংগারের প্রথম পিকিং সফরকালেই মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে সামরিক সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া সম্পর্কিত আদেশটি মুলতবী রেখেছিল। মাৰ্কিন পত্ৰ- পত্রিকা হয়তো বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের একটি স্কোয়াড্রন প্রেরণকেও এরূপ ‘সৎ মধ্যস্থতা’ বলে গণ্য করবে।
পিকিংয়ের সঙ্গে রফা
এসব ঘটনা থেকে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন শাসক মহল ভারতীয় উপমহাদেশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করায় মোটেই উৎকণ্ঠিত নয়, ঠিক যেমন নাকি তারা বহুমাস ধরে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের গুরুতর ভবিতব্যকে উপেক্ষা করে আসছিল। তারা সাম্রাজ্যবাদী খেলা খেলছে, যার অন্যতম লক্ষ্য হলো সংগ্রামী জনসাধারণের স্বার্থ বলি দিয়ে পিকিংয়ের মাওবাদী নেতৃত্বের সঙ্গে একটা রফায় আসা। পিকিং নেতারাও সোভিয়েত বিরোধিতায় অন্ধ হয়ে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যোগসাজস পরিহার করছে না, জনসাধারণের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের আদর্শ ও স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছেন।
মার্কিন শাসক মহলের কপটতা শেষপর্যন্ত কাউকে প্রতারিত করবে না। জনসাধারণ এখন শত্রু মিত্র চিনতে শিখেছেন। আর কোনো ছদ্মবেশই এই শাসক মহলকে সাহায্য করবে না। বিশ্ব জনগণ ক্রমেই স্পষ্টতরভাবে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২৪শতম কংগ্রেসে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির রিপোর্টে সাম্রাজ্যবাদের কাজকর্মের মূল্যায়নের অভ্রান্ততা দেখতে পাচ্ছেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘সাম্রাজ্যবাদ সর্বত্র প্রভুত্ব করতে চাইছে। অন্যান্য জাতির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে, স্বেচ্ছাচারীর মতো এদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার ও সার্বভৌমত্বকে পদদলিত করছে এবং বল প্রয়োগ, ঘুষ প্রদান ও অর্থনৈতিক অনুপ্রবেশের সাহায্যে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও পৃথিবীর সব এলাকার ওপর তার ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে চাইছে।’
ইজভেস্তিয়া, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা