You dont have javascript enabled! Please enable it!

পিকিংয়ের নেতারা
জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতক
ভিকতর মায়েভস্কি, প্রাভদার রাজনৈতিক ভাষ্যকার

ভারত উপমহাদেশে সম্প্রতি যে আলোড়নসৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটে গেল, প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া প্রচার ও পিকিংয়ের প্রচার তাকে উপস্থিত করার চেষ্টা করে দুটি রাষ্ট্র-ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শুধু একটা সামরিক সংঘর্ষ হিসেবে। কিন্তু উপমহাদেশে যা ঘটেছে, প্রকৃতপক্ষে তা হলো মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার সহযোগী পিকিংয়ের নেতৃবৃন্দের সমর্থনপুষ্ট নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে ভারত ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তিগুলোর দ্বারা সমর্থিত পূর্ববঙ্গের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বৃহত্তম এক লড়াই। বাংলাদেশের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মুক্তির শক্তিগুলোর, বাঙালি জাতির বিজয় এশিয়া মহাদেশের জাতিসমূহের মুক্তি ও স্বাধীনতাকে সংহত করার পক্ষে বিরাট গুরুত্বসম্পন্ন।
পাকিস্তানের অস্তিত্বের একেবারে প্রথম বছরগুলো থেকেই সামরিক একনায়কতন্ত্র ডালেসের তৈরি ‘সেন্টো’ ও ‘সিয়াটো’ সামরিক জোটের মধ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিল এবং পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করেছিল।
এই নীতির চরম পরিণতি ঘটল পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব সন্ত্রাসের মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তানের এই জনসাধারণ তাঁদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাঁদের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। ইন্দোচীনের লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী মার্কিন শাসনচক্র পূর্ববঙ্গের মানুষের জীবনে এই মর্মান্তিক ঘটনা সম্পর্কে চোখ বন্ধ করে ছিল।
আর এই ঘটনাটি ছিল সত্যিই ভয়াবহ। তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে এই তিনটি সংখ্যা থেকে: প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ নিহত, তিন কোটি গৃহহীন, এক কোটি ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
এই সমস্যা সম্পর্কে পিকিংয়ের নেতারা কোন অবস্থান গ্রহণ করেছেন? বহুদিন ধরেই চীনা নেতৃত্বের কার্যধারা পরিচালিত ছিল পাকিস্তানকে এশিয়ায় পিকিংয়ের বৃহৎ শক্তিসুলভ জাত্যভিমানী নীতির এক হাতিয়ারে পরিণত করার দিকে এবং পাকিস্তানকে ভারতের সঙ্গে এক সশস্ত্র সংঘর্ষে ঠেলে দেওয়ার দিকে। এ কাজ করতে গিয়ে পাকিস্তানি জনগণের স্বার্থ সম্পর্কে মাওবাদীদের বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ ছিল না। পিকিংয়ের নেতৃত্ব প্রকৃতপক্ষে দ্বিগুণ বিশ্বাসঘাতকতামূলক এক খেলা খেলেছেন।
পূর্ব পাকিস্তানে চীনের চররা প্ররোচনামূলক কাজকর্ম শুরু করে। ‘বাঙালী বিপ্লবীদের প্রতি’ নামে একটি পুস্তিকা ছাড়া হয়। তাতে ছিল ‘মাও ও লিন পিয়াওয়ের রচনা থেকে উদ্ধৃতি”, ‘পাঞ্জাবি জমিদারদের’ (অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানিদের) বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান। চীনপন্থীরা প্রচুর আর্থিক সাহায্য পায়। বস্তুত তারাই ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে চীনের হস্তক্ষেপের হাতিয়ার।
সেইসঙ্গে মাওবাদী সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকচক্রের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করেন এবং ভারতের ওপর আঘাত হানবার জন্য তাদের সামরিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মদত দেন। কাশ্মীরের দিকে চীন কর্তৃক সামরিক গুরুত্বসম্পন্ন পথ নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে চলতে থাকে এবং বিদেশের পত্রিকার খবরে প্রকাশ, সীমান্ত এলাকায় কাজ চালিয়েছে মিলিত চীন-পাকিস্তানি নির্মাণকর্মীর দলগুলো।
ভারত উপমহাদেশের ঘটনাবলি বর্ণনা করে ‘বার্লিনার জাইটুঙ’ যথার্থই লিখেছে: “শক্তির নীতির স্বার্থচালিত হয়ে চীনা নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক সরকারের পক্ষ নিয়েছেন। এই সরকার চেষ্টা করেছিল–ব্যাপক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধিকারের জন্য. প্রগতিশীল সামাজিক রূপান্তর, ‘সেন্টো’ ও ‘সিয়াটো জোট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের গণতান্ত্রিক উপায়ে ব্যক্ত ইচ্ছাকে রক্তে ডুবিয়ে দিতে। তারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের এবং ভারতের বিরুদ্ধতা করেছিল।”
এই প্রেক্ষাপেট, পাকিস্তানি জনগণের ব্যাপারে বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ কাজের সাফাই গাইতে, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সমর্থনকারী সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত ও অন্যান্য দেশের কুৎসা করতে মাওবাদীদের কুৎসিত মূল্য কি?
এখানে এই ঘটনাটি চোখে পড়ে যে, ভারতবিরোধী ও সোভিয়েতবিরোধী অভিযানের অন্যতম প্রধান উসকানিদাতা ছিলেন চীনা লোকায়ত্ত প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই স্বয়ং। কয়েকদিন আগে তিনি এমন একটি বক্তৃতা দেন, যাতে সবকিছু উল্টে দেখানো হয়। পূর্ববঙ্গের জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক একনায়কতন্ত্র যে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়েছিল, তিনি তার সাফাই গাইবার চেষ্টা করেন। তিনি ভারতের নামে অভিযোগ করেন, সে ‘আগ্রাসী যুদ্ধ’ চালাচ্ছে বলে এবং অভিযোগ করেন যে, ‘সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদ’ (মাওবাদীদের উদ্ভাবিত) চেষ্টা করছে ‘ভারতের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে এবং দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে ও ভারত মহাসাগরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করতে’।
পিকিংয়ের নেতাদের ‘রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রবক্তারূপে বিভেদমূলক ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপের’ বিরুদ্ধে যোদ্ধারূপে নিজেদের জাহির করার চেষ্টা সত্যিই হাস্যকর মনে হয়। সকলেরই মনে আছে, নাইজিরিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী ওজুকু যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপের সাহায্যের ওপর, একচেটিয়াপতিদের সাহায্যের ওপর নির্ভর করে এবং পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোর অধিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে নাইজিরিয়াকে বিভক্ত করে একটি ক্রীড়নক রাষ্ট্র ‘বিয়াফ্রা’ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন, তখন পিকিং কী অবস্থান গ্রহণ করেছিল। বিভেদপন্থীরা তখন পিকিংয়ের নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন পেয়েছিল। পিকিং তখন নাইজিরিয়ার সার্বভৌমত্ব বা আঞ্চলিক অখণ্ডতা সম্পর্কে উদ্বেগ দেখায়নি। পূর্ব পাকিস্তানের যে লক্ষ লক্ষ মানুষ দীর্ঘকাল ধরে তাঁদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন এবং নিষ্ঠুর নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, পিকিংয়ের প্রচারকরা তাদের – অভিহিত করেন ‘মুষ্টিমেয় জাতীয় আবর্জনা’ বলে, অথচ এই একই প্রচারকদের কাছে একচেটিয়াপতিদের ভাড়াটে অনুচর বিচ্ছিন্নতাবাদী ওজুকু হলেন ‘যোদ্ধা’, ‘বীর’। এই ভদ্রলোক ‘অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে’ মাওকে আনুগত্যের বার্তা পাঠিয়েছিলেন।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও নাইজিরিয়াকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে এবং আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ওপর আঘাত হানার উদ্দেশ্যে ‘বিয়াফ্রার’ ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের’ ধারণাটিকে তুলে ধরেছিল। আজ আমরা দেখছি, পূর্ববঙ্গে একটি সফল জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে বাধা দেবার চেষ্টায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ‘জাতীয় সার্বভৌমত্বের’ রক্ষক হিসেবে নিজেকে জাহির করছে, আর পিকিংয়ের নেতারা ‘সেন্টো’ ও ‘সিয়াটো’ জোটে পাকিস্তানের শরিক ওয়াশিংটনের কপট নীতিকে সমর্থন করছেন। নেপালের নবীন খবর পত্রিকা লিখেছে, চীনা সরকার নিজেকে নিপীড়িত জনগণের পক্ষ সমর্থক ও জনগণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা বলে জাহির করতে চেষ্টা করছে, অথচ কার্যত বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে আক্রমণাভিযানে সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র।
পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করে আমেরিকার একটি উদারপন্থী পত্রিকা প্রোগ্রেসিভ গত আগস্ট মাসের সংখ্যায় বলেছে যে, মাওবাদীদের পতাকাতলে সমবেত হবার পরিবর্তে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনগণ চীনে অনুষ্ঠিত সংস্কৃতি বিপ্লবের ফলে চীনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এবং সাধারণভাবে, সে দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা খুবই খারাপ। পত্রিকাটি আরো বলেছে যে, মাওয়ের ‘উজ্জ্বল চিন্তাধারা’ চীনকে পরিচালিত করার অনুপযোগী দর্শন বলে আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে।
এই অবস্থায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে একটা বন্দোবস্ততে আসার বাসনা মাওয়ের অনুগামীদের মধ্যে জাগতে শুরু করে, সেইসঙ্গে চলে দক্ষিণপন্থী সরকারগুলোর প্রতি সমর্থন এবং সংগ্রামরত জাতিগুলো সম্পর্কে দু’মুখো কাজকর্ম; শেষপর্যন্ত তার অর্থ দাঁড়ায় তাদের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।
পিকিংয়ের দিক থেকে কিছু কিছু সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়ে মার্কিন শাসকচক্র বুঝতে পারে যে, চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে জটিলতার কোনো আশঙ্কা ছাড়াই তারা ইন্দোচীনে আরো কিছু জুয়াখেলায় প্রবৃত্ত হতে পারে। আর এর অর্থ হলো দক্ষিণ ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ায় আগ্রাসন বাড়ানোর সবুজ সংকেত। পশ্চিমী সংবাদপত্রগুলো মাঝে মাঝেই ইন্দোচীনের জন্য তাইওয়ান বিনিময়ের’ নানা রকমফের নিয়ে আলোচনা করে। এই ‘বিনিময়ের’ অর্থ হলো এমন একটা আপসরফা, যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের ওপরে চীনা লোকায়ত্ত প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌমত্বকে কোনো এক ধরনের স্বীকৃতি দিতে পারে, আর পিকিং যাতে ভিয়েতনামকে ‘শান্ত’ করার ব্যাপারে সাহায্য করে।
‘জাতিসমূহের মুক্তির’ প্রবক্তা বলে দাবি করলেও পিকিং চীন ভূখণ্ডের ওপরে ঔপনিবেশিক ছিটমহল—হংকং আর ম্যাকাওকে বজায় রাখছে। হংকং আর ম্যাকাওকে পিকিং গণ্য করে পশ্চিমের সঙ্গে, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও পর্তুগালের সঙ্গে বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থান বলে। তাই আশ্চর্যের কিছু নেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদের অন্যান্য নির্লজ্জতম প্রবক্তাদের সঙ্গে একযোগে পর্তুগিজ উপনিবেশবাদীরা ভারত উপমহাদেশে সংঘর্ষ সম্পর্কে আলোচনার সময়ে পিকিংয়ের সঙ্গে সংহতি দেখিয়েছিল।
তৃতীয় দুনিয়ার জনগণ ক্রমেই বেশি করে পিকিংয়ের নেতাদের ‘অত্যন্ত বিপ্লবী’ কথাবার্তা এবং তাঁদের প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপের মধ্যে বিরাট ব্যবধানটি উপলব্ধি করতে পারছেন। ঘটনাপ্রবাহ জাতিসংঘে মাওবাদীদের ‘শান্তিবিধানের প্রচেষ্টার’ প্রকৃত মূল্যও দেখিয়েছে। ভারত উপমহাদেশের সংঘর্ষ সম্পর্কে সেখানে আলোচনাকালে পিকিংয়ের প্রতিনিধি একটিই মাত্র লক্ষ্য অনুসরণ করেন—উত্তেজনা ও ভাবাবেগ জাগিয়ে তোলা এবং সংঘর্ষকে আরো বাড়িয়ে তোলা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংহতি প্রদর্শন করে পিকিংয়ের নেতারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সেন্টো ও সিয়াটোর অধীনে ‘মিত্রপক্ষীয় প্রতিশ্রুতি’ পালনের অজুহাতে ভারত মহাদেশে সশস্ত্র হস্তক্ষেপে উৎসাহ জুগিয়েছেন। আর যে সমস্ত অনুকূল উপাদান ভারত মহাসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের জাহাজগুলোর প্রবেশকে সম্ভব করে তুলেছে, চীনের অবস্থান নিঃসন্দেহে তার একটি।
ভারত মহাসাগরে আমেরিকার শক্তি প্রদর্শন ভারত এবং পূর্ববঙ্গের জনগণের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সমর্থক অন্যান্য দেশকে চাপ দেওয়ার চেষ্টার চাইতেও কিছু বেশি। এটি হলো আরব দেশগুলোর মনে ‘রেখাপাত’ করার এবং ইসরাইলকে মদত যোগাবার আরেকটি চেষ্টা। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পিকিংয়ের নেতাদের এবং ওয়াশিংটনের অবস্থানের মিল প্রকৃতপক্ষে আরব দেশগুলোর জনগণের বিরুদ্ধে, ইন্দোচীন, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনগণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবস্থানেরই মিল।
মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সম্পর্কে বিতর্ককালে জাতিসংঘে পিকিংয়ের প্রতিনিধিরা আরব জনগণের “বন্ধু” হিসেবে অভিনয় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তাঁরা সোভিয়েত ইউনিয়নের নামে এমন অভিযোগও করেছেন ‘জিওনিস্ট আগ্রাসনে’ তাদের হাত (অবাক হচ্ছেন?) আছে!
যাই হোক, একথা গোপন করা অসম্ভব যে, প্যালেস্টাইনীয় ও অন্যান্য আরব জাতিকে সমর্থনের কথা তারস্বরে ঘোষণা করলেও, মাওবাদীরা আসলে লিপ্ত আছেন নেপথ্যের ষড়যন্ত্রে। ইসরাইলি, জিওনিস্ট চরদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ স্থাপন করছেন। বৈরুত সংবাদপত্র আল-শার বলেছে, ‘লোকায়ত্ত চীন ও ইসরাইলের জন্য মিটমাট করে ফেলার জন্য মাওবাদীরা জিওনিস্ট চরদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করছে। সেখানকার আল-নিদা গত আগস্ট মাসে লিখেছিল যে, পিকিংয়ের নেতারা মধ্যপ্রাচ্যে কমিউনিস্টবিরোধী শক্তিগুলোকে সমর্থন করেছিল এবং এটি আর একবার তাদের ‘বিশেষ পথের’ সারমর্মটি উদ্ঘাটন করে দিয়েছে (এই পথের লক্ষ্য হলো বিশ্ব জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে ভেদ সৃষ্টি করে তাকে দুর্বল করা) এবং আমেরিকার সঙ্গে তাদের ‘মিটমাটের’ প্রকৃত অর্থটি প্রকাশ করে দিয়েছে।
ভারত উপমহাদেশে সংঘর্ষ সম্পর্কে বিতর্কের সময়ে চীনা প্রতিনিধিবৃন্দ সেখানে অবিলম্বে ‘যুদ্ধবিরতি’ দাবি করেছিলেন (পূর্ববঙ্গের জনগণের বিধিসম্মত অধিকারের স্বীকৃতি ছাড়া যার অর্থ হলো এই বিবাদ অব্যাহত রাখা এবং আরো গুরুতর করা), সেখানে মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা সম্পর্কে আলোচনায় তাঁরা আরব দেশগুলোকে যুদ্ধ শুরু করতে বলেছিলেন। এ কাজটিরও অর্থ হলো বিবাদকে আরো জটিল করা।
উভয় ক্ষেত্রেই মাওবাদীরা সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে খেলেছেন, যে সাম্রাজ্যবাদীরা তরুণ স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিবাদ জাগিয়ে তোলায় আগ্রহী, ‘এশীয়দের দিয়ে এশীয়দের বিরুদ্ধে, আফ্রিকানদের দিয়ে আফ্রিকানদের বিরুদ্ধে লড়াই’ বাধাতে আগ্রহী। এটা তারা করতে চায় এইজন্য যে, এ ধরনের যুদ্ধ জাতীয় মুক্তির শক্তিগুলোকে দুর্বল করে এবং নয়া-উপনিবেশবাদীদের নতুন সুযোগ যোগায়।
গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাবলির সারা পৃথিবীকে পিকিংয়ের নেতাদের আসল চেহারাটা দেখিয়ে দিয়েছে—জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি তাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করছেন, যেসব জাতি পৃথিবীতে মুক্তি, প্রগতি ও শান্তির জন্য লড়াই করে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সাম্রাজ্যবাদকে বিষয়গতভাবে তাঁরা সাহায্য করেন। সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তিও প্রগতির শক্তিগুলোর সংগ্রামে মাওগোষ্ঠী সাম্রাজ্যবাদের তরফে ভিড়েছে; এবং এখনও যাঁরা একথা বুঝতে পারছেন না, আজ হোক অথবা কাল হোক সত্য ঘটনা তাঁরা উপলব্ধি করতে পারবেনই।
প্রাভদা, ২২ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!