You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারত উপমহাদেশে শান্তির জন্য
ভি শুরিগিন

এ মাসের শুরুর দিকে ভূমণ্ডলের মানচিত্রে দেখা দিয়েছিল আরেকটি অগ্নিগর্ভ ক্ষেত্র, সেটি হলো ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ।
শান্তি ও নিরাপত্তার আদর্শকে, নিজেদের ভবিষ্যতের ও নিজেদের ভাগ্যের মালিক হবার অধিকারের জন্য সংগ্রামরত জাতিসমূহের মুক্তির আদর্শকে যাঁরা উচ্চ মূল্য দেন, ভারত উপমহাদেশের ঘটনাবলি তাঁদের সকলের মধ্যেই উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
সকলেই জানেন, সঠিক রোগ নির্ণয় না করলে রোগ নিরাময় করা অসম্ভব। শুধু ওষুধের ক্ষেত্রেই যে একথা প্রযোজ্য, তা নয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে উত্তেজনার ফলে সশস্ত্র সংঘর্ষ বেঁধেছে, তার প্রকৃত কারণ স্থির না করে কার্যকরভাবে এই বিরোধের মীমাংসা করা অসম্ভব এবং উপমহাদেশে এক স্থায়ী ও সুদৃঢ় শান্তির উপযোগী অবস্থা নিশ্চিত করা অসম্ভব।
সেখানে যে পরিস্থিতি রূপ পরিগ্রহ করেছে তার অনেকগুলো কারণ আছে। তার একটি হলো, রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের পর, বিশেষত গত কয়েক বছরে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘটনাবলির চরিত্র।
যে সমস্ত বিষয়গত উপাদান পাকিস্তানের স্বাধীন বিকাশের পক্ষে অসুবিধা সৃষ্টি করেছে, তার মধ্যে একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে এই ঘটনাটি যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রয়েছে ১৬০০ কিলোমিটার ভারতীয় ভূখণ্ড, যার ফলে দুটি প্রান্তের মধ্যে যোগাযোগ চালাতে হয় প্রধানত বিমান পথে এবং সমুদ্র পথে, গোটা উপমহাদেশটি ঘুরে। এই অবস্থা আরো জটিল হয়েছে জাতিগত গঠনবিন্যাসের পাঁচমিশেলী রূপের ফলে-পূর্ব প্রান্তে বাঙালিরাই হলো মোট জনসমষ্টির বিরাটতম সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, আর পশ্চিম অংশে বসবাস করে অন্যান্য জাতীয় গোষ্ঠী—পাঞ্জাবী, পশতু, সিন্ধি, বেলুচ ও আরো কতকগুলো সংখ্যালঘু জাতি।

সামরিক শাসন ও অর্থনীতি
১৯৫৮ সালে সরকারের পর পর অনেকগুলো সংকটের পরে পাকিস্তানে ক্ষমতায় আসে একটি সামরিকগোষ্ঠী। অর্থনৈতিক ক্ষমতা সামান্য সংখ্যক কিছু শিল্পপতি ও ধনকুবের এবং বড় বড় জমিদারের হাতে কেন্দ্রীভূত হবার পক্ষে সামরিক হুকুমতের অবস্থা অনুকূল ছিল। জনৈক পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ এম হকের তৈরি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৬৭ সালে ২০টি বড় বড় একচেটিয়াগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণ করত পাকিস্তানের সমগ্র শিল্পের ৬৬ শতাংশ, সমস্ত বীমা তহবিলের ৭৯ শতাংশ এবং ঋণের মোট পরিমাণের ৮০ শতাংশ। একথা বলা দরকার যে, এই গোষ্ঠীগুলো সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের।
অর্থনীতিতে বৃহৎ পুঁজি ও সামন্ত জমিদারদের আধিপত্য এবং দেশের রাজনৈতিক জীবনের ওপর তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিফলিত হলো শ্রমজীবী জনসাধারণের ওপর তীব্রতর শোষণ ও গণতান্ত্রিক অধিকার দমনের মধ্যে। একথা বলাই যথেষ্ট যে, পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র গত ডিসেম্বর মাসে, স্বাধীনতা অর্জনের ২৩ বছর পরে। দেশের অভ্যন্তরে এই রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সুযোগ নিয়েছে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো, সর্বোপরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তারা পাকিস্তানকে ভিড়িয়ে নিয়েছে আগ্রাসী সামরিক জোট ‘সিয়াটো’ ও ‘সেনটো’তে।
১৯৬৮-র পর থেকে পাকিস্তানে একটা অভ্যুত্থান লক্ষ করা যায় জনসাধারণের কর্মতৎপরতার মধ্যে। তাঁরা দেশের রাজনৈতিক জীবনের গণতন্ত্রীকরণ ও এক স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণের দাবি করেন। এই আন্দোলন বিশেষভাবে বিরাট রূপ নেয় পূর্ব পাকিস্তানে। সেখানে সাধারণ গণতান্ত্রিক দাবির সঙ্গে যুক্ত হয় একটি অভিন্ন রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যেই স্বায়ত্তশাসনের দাবি। প্রধানত বাঙালিদের নিয়ে গঠিত পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যথার্থ কারণেই মনে করতেন যে, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কার্যকর করার সময়ে কেন্দ্রীয় প্রশাসন পূর্ব পাকিস্তানের দিকে যথাযথ মনোযোগ দেন না এবং মাঝে মাঝে সেখানকার ব্যাপারে বৈষম্যের ঘটনাও ঘটেছে। এই বৈষম্য বহু বিচিত্র রূপ পরিগ্রহ করেছে—পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিকাশের প্রয়োজনের জন্য ব্যয়-বরাদ্দ হ্রাস থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ রাষ্ট্রযন্ত্র ও সেনাবাহিনী উভয় ক্ষেত্রেই উঁচু পদগুলোতে বাঙালিদের প্রবেশাধিকার বস্তুত ছিল না।
গণআন্দোলনের চাপে পাকিস্তান সরকার গত বছর ডিসেম্বর মাসে সংসদীয় ও স্থানীয় বিধান সভাগুলোর নির্বাচন করেন। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় যে, সে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল হলো মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানি আওয়ামী লীগ। পার্লামেন্টের ৩১৭টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৬৭টি এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিধান সভার ৩১০টি আসনের মধ্যে পায় ২৮৮টি। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সুস্পষ্টভাবে মত প্রকাশ করেছিলেন পার্টির কর্মসূচীর সপক্ষে, যে কর্মসূচিতে জনজীবনের গণতন্ত্রকরণ ও এক স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণের দাবি জানানো হয়েছিল।

সন্ত্রাসের আবহাওয়া
এখানে জোর দিয়ে বলা দরকার যে, আওয়ামী লীগের কর্মসূচী সংক্রান্ত দলিলপত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা প্রদান সম্পর্কে কোনো ধারা ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের ওপর নিজের মর্জি চাপিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে সরকার যে ব্যাপক নিপীড়নের আশ্রয় নেন, তারই জবাবে গণআন্দোলনের ধারায় এই দাবি ওঠে নিচের তলা থেকে। পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশ ঘোষণার মধ্যে স্বাভাবিক রাজনৈতিক বিকাশকে নিশ্চিত করতে অক্ষম বলে প্রমাণিত শাসক-চক্রের নীতির প্রতি, পূর্ব পাকিস্তানের জনসমষ্টির প্রাথমিক মানবিক অধিকারকে যে সরকার পদদলিত করেছে তার নীতির প্রতি জনগণের ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রতিফলিত। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ যে দমননীতির আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন তার ব্যাপকতাও উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ। শাস্তিমূলক তৎপরতার সময়ে কামান, ট্যাঙ্ক ও বিমান ব্যবহৃত হয়েছে নিরস্ত্র জনসাধারণের বিরুদ্ধে গ্রামকে গ্রাম নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে, গ্রামের অধিবাসীদের গুলি করে মারা হয়েছে। নির্বাচনে ধর্মীয় ও মতান্ধ পার্টি ও সংগঠনগুলো তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর আক্রোশ মেটাবার জন্য এবং তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সন্ত্রাসের আবহাওয়াকে ব্যবহার করেছে।
সরকারের অদূরদর্শী নীতির ফলে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যে যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে, তার ব্যাপ্তি নির্ণয় করা কঠিন। শাস্তিমূলক তৎপরতা চলাকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কতকগুলো এলাকা পরিদর্শন করেছেন এমনকিছু বিদেশি প্রত্যক্ষদর্শীর হিসেবে নিহতদের সংখ্যা হলো কয়েক লক্ষ। যে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের দুর্দশার পরিমাপ করা যাবে কী করে!

সোভিয়েত হুঁশিয়ারি
সোভিয়েত ইউনিয়ন তার পররাষ্ট্র নীতির মূলনীতিগুলো অনুযায়ী জাতিসমূহের মুক্তির সংগ্রামকে ব্যতিক্রমহীনভাবে সমর্থন করে। মানবিক বিবেচনাবোধের দ্বারা চালিত হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তান সরকারের কাছে নিপীড়ন বন্ধ করতে এবং সংকটের এক রাজনৈতিক মীমাংসার উপায় উদ্ভাবন করতে বার বার আবেদন জানিয়েছে। এই পদক্ষেপটি করার সময়ে সোভিয়েত সরকার পাকিস্তানি নেতাদের কাজ উপমহাদেশে শান্তির পক্ষে কতখানি বিপজ্জনক, সেদিকে তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
জনগণের ইচ্ছার ওপর সামরিক দমন-পীড়নের প্রত্যুত্তরে জনগণের পক্ষ থেকে এসেছে সশস্ত্র প্রতিরোধ। সরকারি ফৌজের বিরুদ্ধে জনগণের মুক্তিবাহিনীর দলগুলো গেরিলা তৎপরতা চালিয়েছে। এ বছরের বসন্তকালে ভারত- পাক সীমান্তে এইভাবেই উদ্ভব হয়েছে এক উত্তেজনাময় পরিস্থিতি। রাজনৈতিক সংকটের সামরিক মীমাংসা বাতিল করে এবং জনগণের ইচ্ছা পূর্ণ করে উত্তেজনা প্রশমিত করতে পারতেন একমাত্র পাকিস্তান সরকারই।
এই অবস্থায় ভারত সরকার যে সংযম ও ধৈর্য দেখিয়েছেন, তা প্রশংসার্হ। শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও তাঁরা এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে বিরত থেকেছেন, যাতে পূর্ব পাকিস্তানে একটা রাজনৈতিক মীমাংসা ব্যাহত হতে পারে। ৩ ডিসেম্বরে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী পশ্চিম দিকে ভারতের বিরুদ্ধে বিরাট সামরিক তৎপরতা শুরু করার পরে এবং ১২টি ভারতীয় বিমান বন্দরের ওপর বোমাবর্ষণ করার পরে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ভারত বার বার বলেছে যে, শরণার্থী সমস্যার উদ্ভব হয়েছে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের নীতি ও কার্যকলাপের দরুন, তাঁরাই পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস চালিয়েছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পিকিংয়ের নেতৃত্ব তাঁদের ভারতবিরোধী প্রচারের সাহায্যে পাকিস্তানি নেতাদের জনবিরোধী কার্যকলাপে উৎসাহ জুগিয়েছেন। সংঘর্ষ বাধার পর পিকিংয়ের নেতারা বস্তুত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে জোট বাঁধার মতো নিচে নেমে যান এবং মুক্তির জন্য সংগ্রামরত পূর্ব পাকিস্তানি জনগণের প্রকাশ্য শত্রুরূপে কাজ করেন।
সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন প্রতিনিধি যখন পাকিস্তানি নেতাদের সমর্থন করেন, তখন এদিকে মার্কিন সরকার ভারতের ওপর স্থূলভাবে চাপ দেন। মার্কিন সরকার ঘোষণা করেন—ভারতকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া বন্ধ করা হলো, সপ্তম নৌবহরের মানোয়ারি জাহাজ বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করেছে এবং ভারত উপমহাদেশের কাছেই আছে।
এই পরিস্থিতিতে বিরোধের কারণগুলো উপেক্ষা করে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব সত্যিকার শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। এইসব প্রস্তাব কোনোমতেই ভারত উপমহাদেশে পরিস্থিতির স্বাভাবিকীকরণের কাজকে সহজতর করে না, বর্তমান বিরোধের জন্য দায়ী পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের গৃহীত ব্যবস্থাবলি যথার্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেও প্রমাণ করতে পারে না এবং তা এরূপ কঠিন অগ্নিপরীক্ষায় দুর্দশাভোগী ভারত উপমহাদেশের জনগণের ক্ষতিই করে।
ভারত ও ও পাকিস্তানের জনগণ তাঁদের জাতীয় অর্থনৈতিক বিকাশের সমস্যাগুলো সমাধান করার জন্য তাঁদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য এবং দারিদ্র্য, বেকারি ও মূল্যবৃদ্ধির মোকাবেলা করার জন্য শান্তি চান। সামরিক সংঘর্ষ এইসব সমস্যাকে আরো জটিল করে তোলে। ভারত সরকারের সরকারি মুখপাত্র পুনরায় ঘোষণা করেছেন যে, পাকিস্তানের প্রতি ভারতের কোনো ভূখণ্ডগত দাবি নেই। এ থেকে আরও একবার দেখা যায় যে, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিধিসম্মত অধিকার ও স্বার্থকে যথাযথভাবে গণ্য করে পূর্ব পাকিস্তানে এক রাজনৈতিক মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত এই বিরোধের কার্যকর সমাধান এবং ভারত উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি অর্জন করা যাবে না।
শান্তিকে যাঁরা মর্যাদা দেন তাঁদের সকলকেই, ভারত ও পাকিস্তানের জনগণের সকল বন্ধুকেই এই ভিত্তিতে বিরোধের অবসান ঘটাবার এক বাস্তবসম্মত উপায় সন্ধানের জন্য যথাসাধ্য করতে হবে, এবং নিজেদের আর্থিক স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে যারা এই দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত করতে চায় এবং উত্তেজনাকে চিরকাল জিইয়ে রাখতে চায়, তাদের মতলব ব্যর্থ করার জন্য যথাসাধ্য করতে হবে।
প্রাভদা, ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!