You dont have javascript enabled! Please enable it!

দক্ষিণ এশিয়ায় যুদ্ধের অগ্নিশিখা
ভি কুরিয়াভৎসেভ
(‘ইজভেস্তিয়ার’ রাজনৈতিক ভাষ্যকার)

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সামরিক তৎপরতা দ্বিতীয় সপ্তাহে প্রবেশ করায় সর্বত্র উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, বিশেষত যখন মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধের উর্বর ক্ষেত্রগুলোকে নিশ্চিহ্ন করার সব প্রচেষ্টাই এ যাবৎ ব্যর্থ হয়েছে।
ভারত উপমহাদেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে বিভিন্ন ভাষ্য থেকে দেখা যায় যে, বহু বুর্জোয়া রাজনীতিক ও সংবাদপত্র এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বাধাবার মতো ক্ষেত্র সৃষ্টির কাজে যারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, প্রথমত তারাই এমন একটা ভান করে যেন ভারত উপমহাদেশে সামরিক তৎপরতা একেবারে আকস্মিকভাবে ঘটেছে। বিরোধের প্রকৃত কারণ থেকে জনসাধারণের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে তারা আক্রমণকারীকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করে কে প্রথম গুলি ছুঁড়েছিল তাই দিয়ে; যদিও একথা সকলেরই জানা যে, ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বিমানবাহিনী কোনোরূপ উসকানি ছাড়াই ভারতীয় বিমান ক্ষেত্রগুলোর ওপর বোমাবর্ষণ করে। যাই হোক, ঘটনাগুলো এত বাঙ্ময় যে, কিছু কিছু বুর্জোয়া সংবাদপত্র পর্যন্ত বিরোধের সত্য কারণ স্বীকার না করে পারেনি।
সংবিধানের বিধি অনুযায়ী পাকিস্তানে যখন প্রথমবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে চূড়ান্তরূপে বিজয়ী হয়।
সংবিধানের বিধি অনুযায়ী আওয়ামী লীগেরই সরকার গঠন করার কথা; কিন্তু বিজয়ী দলের নেতারা একদিকে যখন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন, তখন ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য প্রেরণ করলেন। এই সৈন্যবাহিনী জনসাধারণের ওপর নিষ্ঠুর আক্রমণ চালাল এবং মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের কারাগারে নিক্ষেপ করল। পশ্চিম পাকিস্তানি ফৌজ পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ মানুষকে হতাহত করে। প্রায় এক কোটি পূর্ব পাকিস্তানি ভারতে পালিয়ে যান, যার ফলে ভারত অত্যন্ত অসুবিধাজনক অবস্থায় পড়ে। এক কোটি যদি ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রতিবেশী একটি দেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, তাহলে সন্ত্রাসের ব্যাপকতা যে কতখানি, সেটা কল্পনা করা যায়!
পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যে গেরিলা কায়দায় মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করে অত্যাচারী ও হত্যাকারীদের প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করেন, সে দেশের অধিবাসীদের জীবন ও মর্যাদা রক্ষা করেন, সেটি কি আশ্চর্য কিছু?
ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা মুসলমানদের হিন্দুর বিরুদ্ধে, আর হিন্দুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে লাগাবার উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করেছিল। ভারত উপমহাদেশের বিভাগের সময়ে তাদেরই বাধিয়ে-দেওয়া ধর্মীয় বিরোধকে তারা ব্যবহার করেছিল এবং এইভাবে একটি বিলম্বে কার্যকর ‘মাইন’ পেতে রেখেছিল। উপনিবেশবাদীদের সহায়তায় যে ধর্মীয় কুসংস্কার উপ্ত হয়েছিল, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বর্তমান ব্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে জনগণ যে তা ক্রমেই সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করবেন, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। এরূপ অবস্থাতেই জন্মগ্রহণ করেছে বাংলাদেশ সরকার।
লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানি শরণার্থী স্বদেশে ফিরে যেতে পারতেন, পূর্ব পাকিস্তানে যদি সন্ত্রাস বন্ধ হত এবং স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হত। পূর্ব পাকিস্তানি শরণার্থীদের সমস্যা মানবিকতাবাদের সমস্যা ততটা নয়, যতটা রাজনৈতিক; কিন্তু বুর্জোয়া ছদ্ম-মানবতাবাদীরা সে সম্পর্কে চোখ বন্ধ করে থাকেন।
পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্র রক্ষা করার জন্য এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে সন্ত্রাস ও বিনাশের হাত থেকে, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তাঁরা যে ভয়াবহ কষ্ট ভোগ করেছেন তা থেকে রক্ষা করার জন্য পশ্চিমের ‘মানবতাবাদীরা’ যথাসময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি কেন?
এখানে খোলাখুলি বলা দরকার যে, দুটি দেশের মধ্যে বিরোধ বিভিন্ন ধরনের সাম্রাজ্যবাদী উসকানিদাতার স্বার্থানুগ ছিল, কারণ তা এশিয়া সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামকে দুর্বল করে। মারাত্মক সংঘর্ষের ফলে উভয় দেশই দুর্বল হয়ে পড়ুক—তাঁরা এটাই চেয়েছিল। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর প্রতিনিধিরা ভান করেন যে, তাঁরা ভারত উপমহাদেশে শান্তির সপক্ষে, তখন তাঁদের বক্তৃতা ও প্রস্তাবাদিতে কপটাচারের পরিচয়ই পাওয়া যায়।
পাক-ভারত সংঘর্ষের ব্যাপারে মার্কিন শাসকচক্র তাঁদের ‘পক্ষপাত শূন্যতা’ দেখাতে চান এই বলে যে, এ সম্পর্কে তাঁরা একটা ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান গ্রহণ করে আছেন। কিন্তু এই ‘নিরপেক্ষতা’ আত্মপ্রকাশ করে এই ঘটনায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের প্রতি (এবং একমাত্র ভারতের প্রতিই) অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করে। প্রাথমিক চুক্তি সত্ত্বেও সে দেশকে মোট ৮ কোটি ৭৬ লক্ষ ডলার ঋণ দিতে সে অস্বীকার করেছে এবং এইভাবে এটাও দেখিয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘সাহায্য’ দেয় স্বাধীন উন্নয়নশীল দেশগুলোকে শক্তিশালী কারার জন্য নয়, এইসব দেশে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্যই। এই ‘সাহায্যে’ যখন কাজ হয় না, তখন প্রয়োগ করা হয় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা।

পিকিংয়ের উদ্ভট অবস্থান
পিকিং সরকার গ্রহণ করেছেন সবচেয়ে কোলাহলমুখর এবং সেই সঙ্গেই রাজনীতিগতভাবে উদ্ভট এক অবস্থান। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক প্রশ্নের ব্যাপারে কোলাহলটা কখনোই যুক্তিসঙ্গত ছিল না। এটা সাধারণত ব্যবহার করা হয় যুক্তির দুর্বলতা বা অনুপস্থিতি ঢাকবার জন্যে। সংবাদপত্রে এবং সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের মঞ্চ থেকে চীনা লোকায়ত্ত প্রজাতন্ত্রের প্রতিনিধিরা ভারতের নামে আগ্রাসনের অভিযোগ তোলেন এবং এইভাবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একযোগে কাজ করে পূর্ব পাকিস্তানের বিধিসম্মত অধিকারকে পদদলিত করেন। যাই হোক, স্মরণ করা দরকার যে, সামরিক তৎপরতা শুরু হবার বহু আগেই পাকিস্তানি নেতা ভুট্টো তাঁর দেশের প্রধান প্রধান সামরিক নেতাদের সঙ্গে পিকিং গিয়েছিলেন, বেশ আগে থাকতেই পাকিস্তানকে প্রদেয় সামরিক সাহায্য সম্পর্কে বন্দোবস্ত করার উদ্দেশ্যে। একথাও সুবিদিত যে, চীনা লোকায়ত্ত প্রজাতন্ত্রের সরকার এরূপ সাহায্য ও সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অন্তত অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে তো বটেই। পিকিংয়ে, সেইসঙ্গে ওয়াশিংটনেও একথা সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা হয়েছিল যে, পাকিস্তান সরকারকে সামরিক সাহায্য দেবার অর্থ শুধু সে দেশটিকে ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণে ঠেলে দেওয়াই নয়, বাঙালিদের নির্দয়ভাবে দমন করার কাজে তাকে সাহায্য করাও বটে।
এই কাজ করার সময় পিকিং সরকার এশিয়ায় তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষাই অনুসরণ করছিলেন। পাকিস্তান এই বৃহৎ-শক্তিসুলভ নীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। একথাও বলা দরকার যে, ব্যাপক জনসাধারণকে বর্বরভাবে দমন করে এমনসব সরকারের পক্ষাবলম্বন পিকিংয়ের নেতাদের ক্ষেত্রে এটাই প্রথম নয়।
পিকিংয়ের প্রতিনিধি সম্মিলিত জাতিপুঞ্জে যত উচ্চস্বরে কথা বলেন, ততই বেশি করে তাঁরা তাঁদের বৃহৎশক্তিসুলভ উগ্র জাত্যাভিমান প্রকাশ করেন, ততই বেশি করে তাঁরা কার্যক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সঙ্গে তাঁদের সংযোগ প্রকাশ করেন। দর্পণে নিজের দিকে দৃষ্টিপাত না করে তিনি ঘোষণা করেছেন যে, ভারত ক্রমাগত ‘তার প্রায় সকল প্রতিবেশীকেই ভীতি প্রদর্শন’ করেছে! কেউ যদি তার প্রতিবেশীদের ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করে থাকে, তবে সেটি হলো মাওবাদী গোষ্ঠীটিই; আর পৃথিবীতে, বিশেষত এশিয়ায় কেউই সেকথা ভোলেনি। প্রাক্তন চৈনিক সম্রাট পু ই-র অধীনে জাপানি সমরবাদীদের দ্বারা একদা সৃষ্ট মাঞ্চুকুয়োর সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের তুলনা করতে লজ্জাবোধ করেননি। এটা শুধু পূর্ব পাকিস্তানে সন্ত্রাসের বলিদের প্রতি অপমানই নয়, উত্তর-পূর্ব চীনে জাপানি সন্ত্রাসের শিকারদের প্রতি অসম্মানও বটে। চীনা প্রতিনিধিদলের নেতা এই বিষয়টি উল্লেখ করেননি যে, পিকিংয়ের কর্তৃপক্ষ পু ই-কে কারাগার থেকে শুধু মুক্তিই দেননি, তিনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশেই বেঁচে থেকে স্মৃতিকথা লিখেছিলেন এবং তা প্রকাশ করেছিলেন পিকিং সরকার।
এ পি এন, ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র: বাংলাদেশের সংগ্রাম ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!